ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মৃণালিনী

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ২৬ জানুয়ারি ২০১৬

মৃণালিনী

চেনা-চেনা লাগছিল, অচেনাও হয়ত। চোখে ঘন দাগের কাজল, নাকছাবি যে সেকেলে, কারুকাজ দেখলেই স্পষ্ট। গেটে কড়া নাড়ার শব্দ। শান্তিনিকেতনে পৌষের অস্তবিকেল, গোধূলিগগনে মেঘে তখনও ঢাকেনি তারা। আড্ডা দিচ্ছি বারান্দায়। জনাকয়েক। ওঁরা বাংলাদেশের, বিশ্বভারতীর ছাত্রছাত্রী। আড্ডায় চা, কচুরি, সিঙ্গাড়া আসছে ঘোষের দোকান থেকে। কড়া নাড়লেও গেট মূলত খোলা। চোর, কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল আসবে না। এলে আড্ডাবাজ কেউ। নর বা নারী, ছাত্র বা ছাত্রী, বাংলাদেশের বা কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের, ভারতের ভিন রাজ্যেরও হতে পারে। ঢুকলেন যিনি, বয়স পঞ্চাশের কম বা বেশি হতে পারে। সুঠাম, মজবুত স্বাস্থ্য। সঘন-ঝলমলে সুন্দরী। তিলোত্তমা। মৃদুকণ্ঠে, পরিষ্কার বাংলায় জিজ্ঞাসা, ‘লীলাদি আছেন?’ - না। আসেননি, বলি। এলে দেখা হতো, অনেকদিন অন্নদাবাবু-লীলাদির সঙ্গে দেখা হয়নি। কলকাতায় গেলেও দেখা করার সময় হয় না। বললেন। বললুম, বসুন। মোড়া এগিয়ে দিই। না, বসেননি। কথা বলেন দাঁড়িয়েই। হয়ত তাড়া আছে, রিকশা অপেক্ষমাণ। শান্তিনিকেতনের প্রায়-প্রত্যেককে চিনি, অন্নদাশঙ্কর-লীলা রায়ের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনকেও। কিন্তু তিনি কে? আগে কখনও দেখিনি, চাক্ষুষ হয়নি। আপনার পরিচয় জানলে কলকাতায় ফিরে দাদুদিদুকে (অন্নদাশঙ্কর-লীলা রায়) আপনার কথা বলব নিশ্চয়। আমার নাম মৃণালিনী, মৃণালিনী সারাভাই। আপনি মৃণালিনী সারাভাই? কী আশ্চর্য! আড্ডাবাজদের কথায় খৈ ফোটে না আর, প্রত্যেকের চোখ কপাল ছাড়িয়ে চাঁদিতে উঠে আবার ফিরে আসে ঠিকই, বিস্ময়ে ঘোর কাটে না আমাদের। ১৯৭৭ সালের ২২ ডিসেম্বরের কথা বলছি। মৃণালিনী সারাভাইয়ের ছবি দেখেছি পত্রপত্রিকায়, বিশেষত নাচের। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবির সঙ্গে চেহারা মিলিয়ে চেনাচেনা, অচেনাও বটে। মৃণালিনী সারাভাইকে ছেড়ে দেব? না। রিকশা বিদায় করলুম। বিব্রত, অস্বস্তিও বোধ করছেন, চোখেমুখে প্রকাশিত। আমরা নাছোড়। দুদিনের জন্য পৌষমেলায় এসেছেন, কাউকে জানান না দিয়ে, উঠেছেন এক সহপাঠিনীর বাড়িতে (তাঁর নাম বলেননি)? মৃণালিনীকে নানা প্রশ্ন আমাদের। রবীন্দ্রসান্নিধ্য থেকে শুরু করে তিরিশ দশকের শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী, পৌষমেলা, পঠনপাঠন, মানুষজন, পল্লি প্রকৃতি ইত্যাদি? জীবনানন্দের আর্তনাদ ‘হায়’, লিখে রাখিনি? বলছিলেন (স্মৃতি প্রতারক, হুবহু কথামালা ঠিক নয় নিশ্চয়। বয়ান অনেকটাই কাছাকাছি হয়তো, যতদূর মনে পড়ে। ‘যতদূর মনে পড়ে, খুবই ফাজিল, ভেজাল, মিথ্যে শব্দ। সত্যতা যাচাই মুশকিল। নিরুপায়।), তেরো বছর বয়সে (১৯৩১) শান্তিনিকেতনে আসি কবিগুরুর আশ্রমে সুইটজারল্যান্ড থেকে। ওখানেই আমার শৈশব। পশ্চিমা ধ্রুপদী নাচের তালিমও নিই। বাবা ছিলেন নামী ব্যারিস্টার, বিত্তবান। খুব স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন ওখানে। মা গোঁ ধরলেন ভারতে ফিরবেন। মা নাচ করতেন, ভারতীয় ক্লাসিক (মায়ের নাম বলেননি। আমাদের জানা, মায়ের নাম মৃদুলা। তিনিও রবীন্দ্রসান্নিধ্যধন্যা, শান্তিনিকেতনে আশ্রমী, বিশ্বভারতীর প্রথম যুগের ছাত্রী, নাচের তালিমও ওখানে)? মায়ের রক্ত শরীরে, তো, নাচ বাদ দিই কী করে? তোমরা জানো না, গুরুদেব খুব বড়ো নর্তক ছিলেন। আমাদের জ্বালিয়ে খেতেন, কঠোর অনুশীলন, একটু ভুল হলেই ধমক নয়, চোখ রাঙাতেন, গোস্বা করতেন। চোখ রাঙানোই ছিল সবচেয়ে ভয়ের। তালিম-শেষে গুরুদেবের পায়ের কাছে বসতাম, বলতেন, জাপানী ক্যারাটে কোত্থেকে শিখলি। তোরাই আমাকে ঘায়েল করবি একদিন। এইরকম রসিকতার পরে, মুদ্রা ও ছন্দ কী, নিজেই নেচে-নেচে দেখিয়ে দিতেন। তাঁর মতো শিক্ষক কখনও পাইনি। আমার বাংলা শুনে বলতেন, কাঁটাঅলা মাছ খেলে তোর দক্ষিণী (মালয়ালি ) আপদ কাটবে, বাংলা শিখতে পারবি। গুরুদেবের সময়ে শান্তিনিকেতন যা ছিল, ছিটেফোঁটাও নেই আজকে। দেখে কষ্ট হয়। রানীদি (রানী চন্দ) বললেন, শান্তিনিকেতনের শ্মশানে কেন এসেছিস। আমাদের সময়ের শান্তিনিকেতন আর আজকের শান্তিনিকতনের চেহারাচরিত্রে আকাশপাতাল তফাত। তবু আসি সময়সুযোগ পেলে, শান্তিনিকেতন আমার প্রাণের নিকেতন। মৃণালিনীর সঙ্গে আরও কয়েকবার দেখা, নানা জায়গায়, নানা উপলক্ষে। ওঁর আহমেদাবাদের বাড়িতেও। ওঁরই আমন্ত্রণে একবার (মার্চ, ১৯৮২) আহমেদাবাদে গিয়েছিলুম, দর্পণা একাডেমি অব পারফরমিং-এর ইন্টারন্যাশনাল ড্যান্স ফেস্টিভালে? গিয়ে জানলুম, বান্ধবী মল্লিকা সারাভাই নিমন্ত্রণপত্র এবং প্লেনের টিকিট পাঠিয়েছিলেন। মল্লিকার সঙ্গে বন্ধুতা বন্ধু প্রীতীশ নন্দীর দৌলতে। প্রীতীশ কবি, অনুবাদক (এখন অ্যাড-ম্যাগনেট।)। মল্লিকার সঙ্গে গাঢ় বন্ধুতার গূঢ় কথা থাক, লেখক হাসান ফেরদৌস একটি লেখায় ফাঁস করেছেন। মৃণালিনীর কথায় ফিরি। জানতুম না, জানলুম মৃণালিনীদির মুখে (ইতোমধ্যে আমরা মৃণালিনীদি বলতে শুরু করেছি।), ওঁর বড়ো বোন লক্ষ্মী সেহগল একদা ভয়ঙ্কর বিপ্লবী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর আই এনএ বাহিনীতে যোগ দেন এবং সরাসরি সেনানী। নেতাজির অন্তর্ধানের তিন বছর পরে গ্রেফতারও হন। জেলে ছিলেন। লক্ষ্মীও নাচ করতেন, ভরতনাট্যম। আমার চেয়ে ভাল নাচতেন। জেল থেকে বেরিয়ে নাচ ছাড়েন, বিপ্লব ছাড়তে সময় লাগে আরও কয়েক বছর। কমিউনিজম বিশ্বাস করতেন। দিদির আগে আমার বিয়ে হয়। জানলুম, গুজরাটে এবং দক্ষিণে (বিশেষত কেরালায়) অধিকাংশ মেয়ের নাম (অন্তত ষাট দশক পর্যন্ত) বাংলা থেকে নেয়া, বাংলা উপন্যাস, গল্প, কবিতা থেকে নেয়া। এমনকি ছেলেদের নামও। বাংলা উপন্যাস-গল্প গুজরাটে, কেরালায় সবচেয়ে বেশি অনূদিত। গুরুদেবের চেয়ে শরতবাবু বেশি পঠিত, প্রায়-প্রত্যেক ঘরে। গুরুদেবের গান থেকে আমার কন্যার নাম মল্লিকা রেখেছি। মৃণালিনী সারাভাইয়ের ভরতনাট্যম যারা দেখেন, আফসোস করবেন আজীবন। মুদ্রা ও ছন্দিত অলংকরণ কাকে বলে, না দেখলে অবিশ্বাস্য। অবশ্য, ছিদ্রান্বেষী নিন্দুকের ভাষ্য, পাশ্চাত্যের মিশেল। তাই কী? জিজ্ঞেস করি। হেসে উত্তর, কি করে হবে। আমাদের ধ্রুপদী নাচ-গান সবই পরম্পরা। এর মধ্যে ফিউশন মানেই গোঁজামিল। ওড়িশি নাচিয়ে (এবং ভরতনাট্যম ) সোনাল মানসিং-এর কাছে শুনেছি, মৃণালিনী সারাভাইয়ের নাচে যে পারফেকশন, অন্য কোনো নৃত্যশিল্পীর নাচে পাওয়া দুষ্কর, এমনকি যামিনী কৃষ্ণমূর্তির নাচেও নেই। এই কারণেই নৃত্যজগতে, ভারতের নৃত্যভুবনে মৃণালিনী সারাভাই ‘আম্মা’। আমৃত্যু তাঁকে আম্মাই (জননী ) বলা হতো। যতবার দেখা হয়েছে, আম্মা নয়, দিদি সম্বোধন করতুম। মৃণালিনীর বিয়ে ১৯৪২ সালে, স্বামী বহুমান্য পদার্থবিদ এবং ভারতীয় সৌর গবেষণার পিতৃদেব। বিমান দুর্ঘটনায় নিহত, সত্তর দশকে (৭৫ কি ৭৬ সালে, ঠিক মনে পড়ছে না।)। একমাত্র সন্তান (কন্যা) মল্লিকা। নাচিয়ে। বলিউডের নায়িকা, তিন-চারটে ছবিতে অভিনয় করেও সুবিধে করতে পারেননি। আর্থিক অনটন হয়নি কখনও, হবেও না। ভারতে ধনীকুলের একজন, ওঁদেরই বিখ্যাত সারাভাই ওষুধ কোম্পানি। ওষুধ ছাড়াও আরও ব্যবসা। স্বাধীনতার এক বছর পরে (১৯৪৮) মৃণালিনী সারাভাই আহমেদাবাদে দর্পণা একাডেমি অব পারফর্মিং আর্ট প্রতিষ্ঠা করেন, দেড় বিঘে জমির উপরে। ছাত্রছাত্রীর জন্যে স্কলারশিপের ব্যবস্থাও আছে (বছর পঁচিশ আগেও ছিল, এখনও চালু কি না, অজানা।)। জওহরলাল নেহরুর প্রিয় নৃত্যশিল্পী ছিলেন মৃণালিনী সারাভাই। গুজবে প্রকাশ, জওহরলাল নাকি নিমন্ত্রিত না হয়েও একবার (দিল্লীতে) মৃণালিনীর নৃত্যানুষ্ঠানে হাজির। মৃণালিনী পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ উপাধি পেলেও, এই শিরোপার পালক বহুমূল্য নয় তাঁর জন্য। আমরা দেখেছি, আজীবন সংগ্রামী, প্রতিবাদী তিনি। নরেন্দ্র মোদি যখন মুখ্যমন্ত্রী গুজরাটে, মুসলিমনিধন-দাঙ্গায় আহমেদাবাদসহ গুজরাট উত্তাল, বয়সের ভারে কাবু সত্ত্বেও দাঙ্গার বিরুদ্ধে পথে নেমেছেন, সঙ্গে মল্লিকাও। দাঙ্গা-বিরোধী, সাম্প্রদায়িকপ্রীতি মানুষদের নিয়ে। মোদির সমর্থক, দাঙ্গাবাজ, পুলিশের রক্তচক্ষু, অত্যাচারে মৃণালিনী-মল্লিকা ভয়ানক বিপদে, ঘর ছেড়ে পলাতক। সারাভাই পরিবার অবাঞ্ছিত। মোদির বিরুদ্ধে মৃণালিনী, মল্লিকা যতটা উচ্চকণ্ঠ, গোটা গুজরাটে আর কেউ নয়। নির্বাচনেও প্রকাশ্যে মোদির বিরুদ্ধাচারণ। জনসভাতেও সোচ্চার। তো, মৃণালিনীর মৃত্যুতে মোদির কোন শোকবার্তা নেই, মোদির অসহিষ্ণুতা ষোলআনা, প্রকাশিত। কিচ্ছু যায় আসে না। মৃণালিনী ‘আম্মা’ চিরকালীন, মল্লিকাকে বললুম, ফোনে। লেখক : কবি, জার্মান প্রবাসী [email protected]
×