ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

উচ্ছেদ নয়, সমাধান কাম্য

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

উচ্ছেদ নয়, সমাধান কাম্য

রাজধানীর কল্যাণপুরে বস্তি উচ্ছেদ নিয়ে যা ঘটে গেল, তাকে নাটক বললেও কম বলা হয়। অবশ্য এহেন নাটক অনেক আগে থেকেই চলছে। সব সরকারের আমলেই বস্তি উচ্ছেদের নাটক ঘটে, ভাঙ্গাগড়া চলে, প্রয়োজনে আগুনও লাগানো হয়। আবার কিছুদিন না যেতেই যথা পূর্বং তথা পরং। বস্তির ব্যবসা চলে জমজমাট। অনেক সময় বস্তিগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে ভোটব্যাংক হিসেবেও কাজ করে। বস্তিতে ছোটবড় বিভিন্ন অপরাধ, মাদক ব্যবসা, অবৈধ কার্যকলাপ, জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ইত্যাদির খবরও শোনা যায়। মোটকথা রাজধানীতে বস্তি যেমন বাস্তবতা তেমনি একে ঘিরে গড়ে ওঠা ভূমিহীন ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র, জীবন জীবিকা তথা জীবন সংগ্রামও একটি কঠোর নির্মম বাস্তবতা। এর মানবিক এবং অমানবিকÑ দুটো দিকই গভীর এবং তাৎপর্যপূর্ণ। কল্যাণপুর বস্তিটি মিরপুরের হাউজিং এ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মালিকানাধীন ৫০ একরের মধ্যে ১৫ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। সেখানে কয়েক হাজার ঝুপড়ি ঘরে কমপক্ষে ২২ হাজার মানুষের বসবাস। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে অনেক চাঞ্চল্যকর অপরাধ, ঘটনা, দুর্ঘটনা সর্বোপরি অগ্নিকা-ের সাক্ষী এই বস্তি। সেই থেকে নাম পোড়াবস্তি। সেই পোড়াবস্তিতে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে আবারও। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সরকারী উদ্যোগে বস্তি উচ্ছেদের চেষ্টা চলে। যথারীতি আবারও আদালতের স্থগিতাদেশ। এর পরদিনই আগুন লাগার ঘটনা। অগ্নিকা-ে প্রাণহানি না ঘটলেও বেশ কিছুসংখ্যক ছাপড়ার গৃহ পুড়ে ছাই। মাঘ মাসের হাড় কাঁপানো শীতে বস্তিবাসীর দুর্ভোগ ও কষ্ট নিঃসন্দেহে অবর্ণনীয়। বস্তিবাসীর অভিযোগ আগুন লাগেনি, লাগানো হয়েছে। এমনকি দমকল বাহিনীর গাড়ি আসার পথে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। এসবই অমানবিক এবং নিন্দনীয়। তবে একটি আধুনিক ও ডিজিটাল মহানগরীতে বছরের পর বছর অগণিত বস্তি এবং বস্তিবাসীও আদৌ কোন সমাধান নয়। আর এর জন্য শুধু ঢাকা নয়, বরং বিশ্বের প্রায় সব শহর-নগর থেকে বস্তি উচ্ছেদ ও আগুন লাগানোর ঘটনা ঘটে থাকে। বাংলাদেশ একটি জনসংখ্যাবহুল দেশ। এখানে ভূমির অনুপাতে লোকজন অনেক বেশি। স্বভাবতই ভূমিহীনের সংখ্যাও বেশি। এর সঙ্গে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘার মতো রয়েছে নদী ভাঙন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খরা-বন্যা মাড়ি ও মড়ক সর্বোপরি দৈনন্দিন আয় ও কর্মসংস্থানের প্রকট অভাব। সচরাচর এসব কারণেই গ্রামের মানুষ পাড়ি জমায় শহর-বিশেষ করে রাজধানীতে। অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা, ঢাকার আকাশে-বাতাসে টাকা ভেসে বেড়ায়। ফলে বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ে। একজনের হাত ধরে গ্রাম-গঞ্জ-জেলা-উপজেলা থেকে দশজন উঠে আসে বস্তিতে। বস্তি নিয়ে অনেক এনজিও ও বেসরকারী সংগঠন কাজ করে থাকে। তারা প্রায়ই মানবাধিকারের কথা বলে। পুনর্বাসনের কথাও প্রায়ই উচ্চারিত হয়। কিন্তু বস্তি ও বস্তিবাসীর সমস্যার সমাধান আদৌ ঘটে না। মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা কোন সমাধান নয়। বরং গ্রাম-গঞ্জ-জেলা-উপজেলায় পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হলে, নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করা গেলে অসহায় মানুষ আর রাজধানীমুখী হবে না সহজে। এর জন্য সরকারের উন্নয়ন নীতিকে ঢেলে সাজাতে হবে। শুধু শহর-বন্দর-নগরের উন্নয়ন নয়, বরং উন্নয়ন হতে হবে প্রায় সর্বত্রÑ অগ্রসর অঞ্চলের পাশাপাশি অনগ্রসর অঞ্চলেও। শুরু থেকেই যদি গার্মেন্টস শিল্প কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক না হয়ে জেলা-উপজেলাভিত্তিক গড়ে উঠত, তাহলে আমাদের এমন দুর্দশা হতো না। তবে সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যদি স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়, তাহলে আগামীতে বস্তি উচ্ছেদের অবসান হতে পারে।
×