ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ ৮৩তে পা রাখলেন মুহিত

‘৮২ পার করলাম জীবনের শ্রেষ্ঠতম একটা বছর হিসেবে’ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

‘৮২ পার করলাম জীবনের শ্রেষ্ঠতম একটা বছর হিসেবে’ -স্বদেশ রায়

আজ ৮৩তে পা রাখলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আজকের দিনটিও তিনি কাটাবেন ব্যস্ততম দিন হিসেবে শুধু নয়-দেশ, রাষ্ট্র ও মানুষের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে। যেখানে অনেক কাজ থাকবে সৃষ্টিশীল। অনেক কাজ থাকবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। আবার এর ফাঁকেই গাড়িতে বসে বা কোন এক সময়ে পড়বেন পছন্দের কোন নতুন বই। এমনকি আজও তিনি হয়ত শত কাজের ফাঁকে কোন এক সময়ে লিখতে পারেন সৃষ্টিশীল কোন লেখা। ২৫ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন। এই দিনটি মিলে যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মদিনের সঙ্গে। মধুসূদন ছিলেন বিস্ময়কর প্রতিভা। তাঁর জীবন ছিল স্বল্পায়ুর। আবুল মাল আবদুল মুহিত বিস্ময়কর প্রতিভা নন, কিন্তু বহু গুণের অধিকারী একজন মানুষ। যাকে কখনই সীমাবদ্ধ করা যায় না অর্থনীতির ভিতর বা একজন ভাল ব্যুরোক্র্যাট বা ভাল রাজনৈতিক মন্ত্রীর ভিতর। ইতিহাস, সাহিত্য, সমাজ বিজ্ঞান, সঙ্গীতসহ ললিত কলার সব দিক তাঁকে আকর্ষণ করে। তিনি সেখানে পৌঁছে যান অবলীলায়। অর্থাৎ রমাঁ রে্যাঁলার সেই আদর্শ মানুষ তিনি, যিনি নিজের ভিতর সৃষ্টি করতে পেরেছেন অনেকগুলো জগত। আর সব জগতে আছে তাঁর স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ। এর সঙ্গে তিনি পেয়েছেন দীর্ঘ সুস্থ জীবন। ৮৩তে পা রাখার তিন দিন আগে তাঁকে জিজ্ঞেস করি, তিন দিন পরেই তো ৮২ পার হয়ে যাবে, এ বছরটিকে কিভাবে দেখছেন? না, খুব বেশি সময় নেননি, সামান্য একটু সময় নিয়ে- হঠাৎই সোফার ওপর সোজা হয়ে বসে বললেন, জীবনের শ্রেষ্ঠতম বছর। তাঁর বলার ভঙ্গিমা, দৃঢ়তা সব দেখে কিছুটা অবাক হয়ে যাই। ভাবতে চেষ্টা করি, কী অপরিসীম জীবনীশক্তির একটি মানুষ যে, তাঁর জীবনের ৮২তম বছরটিকে বলছেন জীবনের শ্রেষ্ঠতম বছর। তিনি বললেন, দেখ প্রায় সমগ্র বছরটি পেয়েছি নিরবচ্ছিন্ন কাজ করার। অর্থনীতিকে ক্ষতি করার মতো কোন অপরাজনীতি এ বছর ছিল না। সবকিছু ছিল শেখ হাসিনার নিয়ন্ত্রণে। তাই এ বছর যতগুলো স্বপ্ন দেখেছি তা সবই করেছি বা করার পথ তৈরি করেছি। এ বছর আমাদের ৭ পার্সেন্ট গ্রোথ হবেই। এ নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া গোটা বছর অর্থনীতি খুব ভাল করেছে। এমনকি সরকারি বিনিয়োগও বাড়িয়েছি ৩ পার্সেন্ট। তাছাড়া এ বছরই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়েছে। পদ্মা সেতু এখন শুধু শেষ হতে যা সময় নেবে আর কি। এছাড়া আরও বড় অনেকগুলো কাজের প্রস্তুতি বা অনেকখানি শুরু হয়ে গেছে এ বছরই। যেমন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে যমুনা থেকে পদ্মা পর্যন্ত নদীর তীর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হবে। ওই বাঁধের ওপর দিয়ে ফোর লেনের স্ট্রাকচার করা হবে। হয়ত আপাতত ডাবল লেন চালু হবে। পরে শুধু কার্পেটিং করে ফোর লেন করা যাবে। পাশাপাশি ভাঙ্গন ঠেকানোর জন্য যমুনার মতো করে পদ্মায়ও একই ব্যবস্থা নেয়া হবে। নদীর কূলে ওই ভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো হবে। যেমনটি যমুনায় করা হয়েছে। এই বাঁধ ও রাস্তায় বিশ্বব্যাংক সাড়ে তিন থেকে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। এ ছাড়া যমুনা ও পদ্মায় সর্বক্ষণিক ড্রেজিংয়ের জন্য নেয়া হচ্ছে অনেক বড় প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক এই ড্রেজিং প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে ২ বিলিয়ন ডলার। তিনি জানালেন, দুটো প্রস্তাব এখনও বিস্তারিত আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে। তাই এই বিনিয়োগের পরিমাণ পরে আরও বাড়তে পারে। ড্রেজিংয়ের কথা বলতে বলতে তিনি তাঁর স্বভাব সুলভ হাসি মুখ নিয়ে বললেন, দেখ আমাদের নদীগুলোকে ঠিক রাখার জন্য সর্বক্ষণিক ড্রেজিং যে কত প্রয়োজন, এ কিন্তু বঙ্গবন্ধুর পরে নেত্রী (শেখ হাসিনা) ছাড়া আর কেউ বোঝেননি। বঙ্গবন্ধু তো নানান কথার ভিতর বার বার গুরুত্ব দিতেন ড্রেজিংয়ের কথা। একটি সত্য তথ্য হলো পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে এ দেশে ড্রেজার কেনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপরে প্রথম ড্রেজার কেনা হয় ২০০৯-এ নেত্রী ক্ষমতায় আসার পরে। নেত্রী পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ওই গুণ। তাঁর ভিতর দেখি, বঙ্গবন্ধুর পছন্দ, সিদ্ধান্তগুলোই খুব বেশি প্রতিফলিত হয়। এর থেকে একটা বিষয় বোঝা যায় যে, তিনি (শেখ হাসিনা) তাঁর বাবাকে খুব গভীরভাবে অবজারভ করতেন। যার প্রতিফলন এখন তাঁর (শেখ হাসিনা) কাজের ভিতর প্রতি মুহূর্তে দেখা যায়। যে কারণে নেত্রী আমাদের নদী ড্রেজিংয়ের ওপর সব থেকে বেশি গুরুত্ব দেন। ইতোমধ্যে যদিও আমাদের সরকার কয়েকটি ড্রেজার কিনেছে। তবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আর বাংলাদেশে নদী ড্রেজিংয়ের সমস্যা থাকবে না। বাজেটের কাজ এখন প্রায় সারা বছরই চলে। তাই আগামী বাজেটের অনেক প্রস্তুতি ইতোমধ্যে নেয়া হয়ে গেছে। তাই আগামী বাজেট নিয়ে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে, তিনি বলেন, দেখ এটাই হবে আমার লাইফের শ্রেষ্ঠ বাজেট। এর পরেরটা সম্পর্কেও আমার একটা চিন্তা করা আছে। তবে সেটা আমি নেত্রীকে বলব। এর আগে কাউকে নয়। অর্থনীতিকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নেয়া, ৭ পার্সেন্ট গ্রোথ নিশ্চিত করা, ভবিষ্যতমুখী ৬ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সর্বোপরি জীবনের সেরা বাজেটটি তৈরি করা। এসব কাজই তিনি তাঁর ৮২তম বছরে করেছেন। তাই তাঁর মুখে ছিল অনেক প্রশান্তি। এই প্রশান্তির ছেদ টানতে চাননি, তবে তারপরেও যে বছরটি তিনি পার করে এলেন, এ বছরে ব্যক্তিগত কথা আসতেই তাঁর মুখে একটা ছায়া নেমে এলো। অনেকটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই বললেন, আসলে রাশেদের এমন সুন্দর শরীর স্বাস্থ্য ওর কেন যে এবার এই চারটে বাইপাস করতে হলো। পিতা হয়ে ছেলের এ ধরনের অসুস্থতার ধাক্কা সামলানো যে কত কষ্টের তা যে কোন পিতাই উপলব্ধি করতে পারেন। কিন্তু তাঁর ছেলের এ অসুস্থতার সমস্ত ব্যথা ও ভার বহন করেছিলেন সাবিহা মুহিত। পিতা আবুল মাল আবদুল মুহিত মাত্র একবার সিঙ্গাপুর যেতে পেরেছিলেন, তাও সামান্য সময়ের জন্যে। বাদবাকি গোটা দায়টা বহন করতে হয়েছে সাবিহা মুহিতকে। সাবিহা মুহিতের এই নীরব ত্যাগের হিসাব বাংলাদেশের উন্নয়নের ইতিহাসে কোন দিন থাকবে না। যদি সত্যি বলা হয়, তাহলে বলতে হবে, সাবিহা মুহিত শুধু তাঁর সন্তানকে চিকিৎসা করাননি, তিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীকে নিশ্চিন্তে তাঁর দেশ নিয়ে, অর্থনীতি নিয়ে ওই বিপদের সময়ও কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আর যে কারণে অর্থমন্ত্রী বলতে পারছেন, তাঁর জীবনের ৮২তম বছরটি তিনি পার করলেন শ্রেষ্ঠতম বছর হিসেবে। আগামী বাজেটটি তিনি করতে যাচ্ছেন তাঁর জীবনের সেরা বাজেট হিসেবে। বাস্তবে সাবিহা মুহিতের এ ত্যাগের বাকি যেটুকু প্রকাশের থাকে, তা মনে হয় গদ্যে লেখা যায় না। কেবল কবি পারেন এ নিয়ে একটি দীর্ঘ এমনকি এক লাইনে একটি দীর্ঘতম কবিতা লিখতে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কর্মজীবনের মতো তাঁর ব্যক্তিজীবনও কিন্তু আরেক দিগন্ত। যেমন ২০১৬তে ৮৩তম জন্মদিনের মাত্র দুই দিন আগে এই আলাপচারিতায় একপর্যায়ে তাঁর লাইব্রেরীতে বই পড়ার প্রসঙ্গ আসে। এক সময়ে তো তিনি ছাত্রজীবনে বংশালে বুক শপে বসেও সারাদিন বই পড়েছেন। এদিন আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, তিনি প্রকৃত অর্থে নিজেকে এনলাইট করার সুযোগ পেয়েছেন ১৯৮৭ থেকে ২০০০ অবধি। যখন তিনি অনেকটা এক্সাইল জীবন কাটাচ্ছেন। এই সময়ে তিনি সকাল ১১টা থেকে রাত ১০-১১টা অবধি নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরী, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরীসহ বিভিন্ন লাইব্রেরীতে নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা করেছেন। আর সাহিত্য থেকে অর্থনীতিতে তাঁর সুইস ওভারটা হয়েছে ১৯৬২ থেকে ৬৪ এই সময়ে। এ সময়ে ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট অর্গানাইজ করার দায়িত্ব পড়ে তাঁর ওপর। ওই সময়ে ট্রান্সপোর্টের ওপর যে স্টাডি পেপার সেটা পড়তে গিয়ে তাঁকে বিশ্ব অর্থনীতির অনেক বই পড়তে হয়। সেখানে ইস্ট পাকিস্তান ও ওয়েস্ট পাকিস্তানের অর্থনীতিও ছিল। সব মিলে ওই সময়টা তাঁকে টেনে নিয়ে যায় অর্থনীতিতে। যা তাঁকে হার্ভার্ড থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রী নিতে উদ্বুদ্ধ করে। আজ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ৮৩তম জন্মদিন। এ দিনটি তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা নানান অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে পালন করবেন। কিন্তু তরুণদের জন্য বা আগামী প্রজন্মের জন্য এ দিনটি কিন্তু উপলব্ধির। অর্থাৎ তাঁর মতো মানুষ আমাদের দেশে এখন সংখ্যা গণনায় খুব বেশি নেই। তাই তাঁর জন্মদিনে তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেয়া অনেক বড় বিষয়। অন্তত এটুকু শিক্ষা তো তরুণ প্রজন্ম নিতে পারে, যে জীবন কেমন বহতা নদী তা আবুল মাল আবদুল মুহিতের জীবন থেকে শেখা যায়। এখানে থেমে থাকার কিছু নেই। নিজেকে উত্তরণ ঘটাতে হয় এবং সেটা যে কোন সময়ে। আর সব কিছুরই মূলে জ্ঞানার্জন। জ্ঞানই কিন্তু তৈরি করেছে একজন আবুল মাল আবদুল মুহিতকে। অন্য কোন উপাদান নয়। তাই আবুল মাল আবদুল মুহিতের জন্মদিন তরুণরা পালন করতে পারে জ্ঞানার্জনের শপথ নিয়ে। [email protected]
×