ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লেফটহ্যান্ড ফ্লাইওভার! -জাকারিয়া স্বপন

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৬

লেফটহ্যান্ড ফ্লাইওভার!  -জাকারিয়া স্বপন

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজেটের এবং বিতর্কিত ফ্লাইওভারটির নাম হলো মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার। এই ফ্লাইওভারটির কাজ শুরু হওয়ার পর ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে মাত্র ১২২ বার। কোন একটি প্রজেক্ট কাজ শুরু হওয়ার পর কেন এতবার তার ডিজাইন পরিবর্তন করতে হলো, কেউ কি একবার চিন্তা করে দেখেছেন? একবার দু’বার নয়, ১২২ বার! এটি সরকারী টাকায় তৈরি সবচেয়ে বড় ফ্লাইওভার প্রজেক্ট। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারটি দৈর্ঘ্যে সবচেয়ে বড়। কিন্তু ওটা ছিল পিপিপি অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এই ফ্লাইওভারটি পুরোটাই সরকারী টাকায়। ২০১১ সালে প্রকল্পটি একনেকে পাস করা হয়। ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এলজিইডির ওয়েবসাইটে প্রকল্পটি সম্পর্কে তথ্য হলো, এটি ২০১১ সালে শুরু হয় এবং ২০১৪ সালে শেষ হওয়ার কথা। যদিও এখন ২০১৬ সাল, তাদের ওয়েবসাইটে আপডেট তথ্যগুলো নেই। সেখানে উল্লেখ রয়েছে, এটা ৭৭২ কোটি টাকার প্রকল্প। যে তথ্যগুলো নেই তা হলো, প্রথমে যখন এই প্রকল্প অনুমোদন করা হয় তখন বাজেট করা হয়েছিল ৩৪৩ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপে এটাকে বাড়িয়ে করা হয়েছিল ৭৭২ কোটি টাকা। পরবর্তীতে এটাকে আবারও বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২১৮ কোটি টাকা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এটা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও এটা এখন আবার নতুন সময় ঠিক করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় এটা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও আশা করা হচ্ছে এটা ২০১৭ সালের জুলাই মাসে গিয়ে শেষ হতে পারে! তাদের ওয়েবসাইটে বলা নেই, বারবার এভাবে ডিজাইন পরিবর্তনের ফলে ওই এলাকার মানুষের কী ভোগান্তি হচ্ছে, কত ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে এবং আরও শত শত কোটি টাকার ক্ষতির বিনিময়ে হতে যাচ্ছে এই ফ্লাইওভার। বাংলাদেশের আর কোন বড় প্রকল্প এত বিলম্ব হয়েছে কি-না আমার জানা নাই। বার বার ডিজাইন পরিবর্তনের জন্য বলা হচ্ছে, সঠিক ম্যাপিং করা হয়নি। অর্থাৎ রাস্তার নিচ দিয়ে কোন্ কোন্ পাইপ গিয়েছে (পানির পাইপ, সুয়ারেজ পাইপ, হাইভোল্টেজ বিদ্যুতের তার, টেলিফোনের তার, ফাইবার অপটিক কেবল, গ্যাসের পাইপ ইত্যাদি) সেগুলো যেমন সঠিক নয়, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওঠা এবং নামার জায়গাও পরিবর্তন করা হচ্ছে এবং দৈর্ঘ্যও পরিবর্তন করা হচ্ছে। এগুলো কি ডিজাইনের সময় দেখা হয়নি? এখন এসে এগুলো পরিবর্তন করা হচ্ছে কেন? ॥ দুই ॥ একটি ফ্লাইওভার কেন এত ভুলে ভরা তা নিয়ে অনেক মানুষের অনেক রকমের মতবাদ রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে হরেক রকমের সংবাদ এসেছে। কেউ বলছেন কোন্ সড়ক দিয়ে উঠবে, আর কোন্ সড়ক দিয়ে নামবে এগুলো সঠিকভাবে নির্ধারিত হয়নি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বলা হয়ে থাকে যে, মাটির নিচে যে অনেক রকমের তার/পাইপ গিয়েছে সেগুলো সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এই অব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। এত বিশাল একটি প্রজেক্টে এমন কাঁচা কাজ হবে, তা আমার মনে হয় না। যখন ফ্লাইওভার ডিজাইন করা হবে, তখন তো এগুলোই সবচেয়ে প্রথম খেয়াল করা হবে। নইলে কিসের ভিত্তিতে ডিজাইন হবে যে, কোথায় কোন্ পিলার বসবে! বিষয়টি নিয়ে খটকা লাগাতে আমি বেশ কিছু সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুকে বিষয়টি জিজ্ঞাস করলাম। তারা যা বলল তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম। যদিও ফ্লাইওভারটি বাংলাদেশ সরকারের টাকায় করা; কিন্তু এর ডিজাইন করেছে আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠান। আমরা সবাই জানি যে, আমেরিকাতে গাড়ি চালানো হয় বাঁ হাতে রাস্তার ডানদিক দিয়ে (যা বাংলাদেশের ঠিক উল্টো)। পুরো ফ্লাইওভারটি ডিজাইন করা হয়েছে লেফটহ্যান্ড ড্রাইভিং মাথায় রেখে। ফলে রাস্তার যেদিক দিয়ে ফ্লাইওভারে ওঠার কথা সেদিক দিয়ে নামতে হচ্ছে, আবার যেদিক দিয়ে নামার কথা সেদিক দিয়ে উঠতে হচ্ছে। আরও বিপদ হলো, টার্ন নিয়ে যেদিকে যাওয়ার কথা (ফ্লাইওভার যেভাবে আপনাকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছে দেবে) এখন তো সেটা উল্টো হয়ে যাবে। যেমন ধরুন, আপনি এফডিসির সামনে থেকে ফ্লাইওভারে ওঠে যাবেন মৌচাক। মূল ডিজাইনে আছে ফ্লাইওভারে উঠতে হবে ডানদিক দিয়ে (আমেরিকাতে গাড়ি ডানদিক দিয়ে চলে বলে)। কিন্তু আপনি তো আছেন বাঁদিকে। এবারে ওই ফ্লাইওভারে উঠবেন কিভাবে? কঠিন সমস্যা বটে! যেহেতু পিলার সব উঠে গেছে, এখন ওই ডিজাইনকেই ভেঙ্গেচুরে কোন রকমে ঠিক করে দেয়া হচ্ছে। ফ্লাইওভারটি তো একদিনে ডিজাইন করা হয়নি। একদিনে কাজে হাত দেয়া হয়নি। দেশী-বিদেশী অনেক প্রকৌশলীর হাত ঘুরে এটা নির্মাণ কাজে এসেছে। আমেরিকার ডিজাইনার নিজের দেশের মতো করে একটা সুন্দর ফ্লাইওভার ডিজাইন করে দিয়েছে। এটা তো আমেরিকার জন্য ডাল-পানি-ভাত, কারণ ওখানে হাজার হাজার ফ্লাইওভার। কিন্তু দেশী যারা এই ডিজাইন নিয়ে কাজ করেছেন, তারা কি একটিবারের জন্যও খেয়াল করেননি যে, গাড়ি কোন্দিক দিয়ে উঠবে, আর কোন্দিক দিয়ে নামবে? বিদেশী একটি প্রতিষ্ঠান কিছু একটি ডিজাইন করে দিল, আর আমরা চোখ বন্ধ করে সেটা তৈরি করতে লেগে গেলাম! আমরা কি এমনি অন্ধ? বিদেশীদের ওপর কি আমাদের এমন নিখাদ নির্ভরতা? নিজের জিনিসটি বুঝে নেয়ার মতো কি কেউ ছিল না আমাদের? ॥ তিন ॥ এত ব্যয়বহুল একটি প্রকল্পে যদি এমন ক্ষুদ্র ভুলের জন্য একটি শহরের লাখ লাখ মানুষকে কষ্ট পোহাতে হয়, শত শত কোটি টাকার শ্রাদ্ধ হয়, তাহলে এমন ঘটনা কি আমাদের দেশে আরও হতে পারে না? কিংবা আগে যে হয়নি সেটা হয়ত আমরা জানিই না। এটা যেহেতু অনেক বড় একটি প্রকল্প, তাই হয়ত সবার নজরে এসেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, দেশে বড় অনেক প্রকল্প হচ্ছে। এটা বলতেই হবে যে, বর্তমান সরকার বিশাল বাজেটের প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত দিয়েছে। এমন বিশাল বিশাল কাজ একসঙ্গে পরিচালনা করতে গিয়ে হয়ত সঠিক লোকবল সঠিক জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু উন্নয়নের গতি তো তার জন্য থেমে নেই। তবে এই ধরনের ভুল কি এড়ানো যেত না? সরকার পদ্মা সেতুতে হাত দিয়েছে, পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রে হাত দিয়েছে, বিশাল হাইটেক পার্ক হচ্ছে গাজীপুরে, এমন অনেক বড় ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরির কাজে হাত দিয়েছে সরকার। কিন্তু সেগুলো আসলে দেখে কে? আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনীতি দেখার মানুষ আছে, শিক্ষাব্যবস্থা দেখার মানুষ আছে, প্রযুক্তি দেখার মানুষ আছে, নারী বিষয়ক কর্মকা- দেখার মানুষ আছে; কিন্তু ভৌত অবকাঠামো দেখার মানুষটা কে? খুব সাদামাটাভাবে দেখলে সরকারের অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং বিভাগ রয়েছে যারা এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি দেখতে পারে। মূলত তাদেরই এগুলো দেখার কথা। উপরের ফ্লাইওভারটি যেহেতু এলজিইডি করছে, সেহেতু তাদের প্রকৌশলীদেরই এটা দেখার কথা ছিল। কিন্তু তারা এটা দেখেননি। তখন মনে হলো আওয়ামী লীগের ভেতর কি কেউ আছেন যিনি এই বিষয়গুলো দেখেন? বিষয়টি মাথায় আসার পর একটু আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইট ভিজিট করলাম। সেখানে বর্তমান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। ওখানে দেখতে পেলাম বিশাল একটি তালিকায় যেখানে রয়েছে এমপি এবং মন্ত্রীদের নাম। কিছু উদাহরণ দেয়া যাক- আ হ ম মুস্তফা কামাল হলেন ফিন্যান্স ও প্ল্যানিং সেক্রেটারি, আব্দুল মতিন খসরু হলেন আইন বিষয়ক সেক্রেটারি, ড. আব্দুর রাজ্জার হলেন কৃষি বিষয়ক সেক্রেটারি, এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন দেখেন তথ্য ও গবেষণা, ড. হাসান মাহমুদ দেখেন প্রকাশনা, স্থপতি ওয়াফেস ওসমান দেখেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, নূরুল ইসলাম নাহিদ দেখেন শিক্ষা, আসাদুজ্জামান নূর দেখেন সংস্কৃতি ইত্যাদি। কিন্তু ভৌত অবকাঠামো দেখার জন্য নির্দিষ্ট কোন মানুষ নেই। এই সরকার যেহেতু যথেষ্ট পরিমাণে ভৌত অবকাঠামো তৈরি করছে, সেক্ষেত্রে এটা বিবেচনা করে দেখতে পারে যে, এ বিষয়ে বিশেষ একটি সেল গঠন করাসহ কিছু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে এই বিষয়ে প্রস্তুত করা যায় কি-না। প্রয়োজনে একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা যেতে পারে। বিশেষ করে বড় প্রকল্পগুলো যেন এভাবে ঝুলে না যায়, তা দেখার জন্য সরকারের ভেতরে নিজস্ব লোক থাকাটা জরুরী হয়ে পড়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের দক্ষতাও বৃদ্ধি পাবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ২৩ জানুয়ারি ২০১৬ লেখক : তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়. কম ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×