ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শরিফুল ইসলাম সীমান্ত

শীতের ক্যাম্পাস...

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

শীতের ক্যাম্পাস...

রাসেলের ক্লাস সকাল ৯টায়। মোবাইলের এ্যালার্ম বার বার রেডি হওয়ার জন্য তাগাদা দিলেও লেপের তলার ওম ছেড়ে বাইরের হাড় কাঁপানো শীতে বের হতে একটু ইচ্ছে করছে না ওর। বরঞ্চ রুমের বাইরে কুয়াশা মোড়া আর শিশিরভেজা ক্যাম্পাসের কথা ভাবতেই লেপের ভেতর আরও একটু সেধিয়ে যাচ্ছে ও। গোসল করা তো দূরের কথা ওয়াশরুমের ঠা-া পানিতে হাত মুখ ধোয়ার কথা ভাবতেই সর্বাঙ্গে কাটা দিচ্ছে ওর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আবাসিক হলের শিক্ষার্থীদের শীতের সকালের চিত্রটা কিন্তু মোটামুটি এমনই। আর সকাল সকাল যাদের পরীক্ষার তাড়া থাকে তাদের মতো অসুখী মনে হয় ক্যাম্পাসে আর দ্বিতীয়টি নেই। কথায় আছে ‘মাঘের শীতে বাঘে কাঁপে।’ তা নাদুস-নুদুস বাঘ মামাদের যদি শীতে এমনতরো কাঁপাকাঁপি অবস্থা হয় তাহলে বনের অন্যদের অবস্থাটা কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়। কুয়াশাভেজা রাস্তা ধরে কèাসে যাওয়ার সময় তাই জাবির ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ইমরানের মনে কৌতুক জাগে বনের বাঘ মামা আর তার সঙ্গী সাথীদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণের। ‘বৃক্ষের পদতলে জীর্ণপত্রের অশেষ উৎসব/বাতাসে কিসের গন্ধ/কাদের সঙ্গীত/একদিন ঘুম ভেঙে দেখি/এসে গেছে শীত’ কবির ভাষায় এভাবেই প্রকৃতিতে আগমন ঘটে কুয়াশার চাঁদর মুড়ি দেয়া শীতের বুড়ির। শীত বুড়ির ঠা-া হিমেল হাওয়ার পরশে বিবর্ণ হয়ে উঠে প্রকৃতি। প্রকৃতি যেন হারিয়ে ফেলে তার আপন রং। দিন শেষে সন্ধ্যা নেমে এলেও কোন কোনদিন দেখাই মেলে না শীতকালের বহু আকাক্সিক্ষত সূর্য্যমিামার। তাই তো এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের মালি চাচারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে রংহীন ক্যাম্পাসে একটু রঙের ছোঁয়া লাগাতে। তাদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় হলুদ গাঁদা, ডালিয়া আর কসমস ফুলে ভরে উঠে ক্যাম্পাস। তবে যত শীতই হোক না কেন বেলা বাড়তেই শিক্ষার্থীদের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা উৎসবমুখর পদচারণায় ক্যাম্পাস যেন আবারও প্রাণ ফিরে পায়। গায়ে শীতের কাপড় জড়িয়ে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে যখন ওরা আড্ডায় মেতে উঠে তখন মনে হয় যেন শীতের বুড়িকে ওরা উপহাস করছে। ক্যাম্পাসের আনাচে-কানাচে ছোট্ট পিঠার দোকানগুলোতে বন্ধুরা মিলে যখন একসঙ্গে পিঠা খাওয়া হয় তখন নিজের অজান্তেই ক্ষণিকের জন্য মনে পড়ে যায় গ্রামের বাড়িতে চুলার ধারে বসে মায়ের হাতের পিঠা খাওয়ার কথা। তাই তো পরিবার-পরিজন থেকে শত শত মাইল দূরের ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা মিলে আয়োজন করে থাকে পিঠা উৎসবের। সে উৎসবে যোগ দেয় তাদের প্রিয় শিক্ষকরাও। কুয়াশার চাদর ভেদ করে সূর্য্যমিামা যখন পৃথিবীতে উকি দেয় তখন যেন ঝলমল করে উঠে পুরো ক্যাম্পাস। শিশিরভেজা দূর্বাঘাসে নরম রোদের ছোঁয়া লাগতেই নতুন করে জেগে উঠে শিক্ষার্থীদের প্রাণ। ভবন আর গাছের ছায়া এড়িয়ে হলুদ গাঁদা ফুলের পাশে যে জায়গাটুকু জুড়ে মিষ্টি এক চিলতে রোদ ছড়িয়ে থাকে সে জায়গায় বসে আড্ডা দিতে ভুল হয় না কারোরই। মাঝে মাঝে শিক্ষকদেরও দেখা যায় ঠা-ায় জমে যাওয়া ক্লাস থেকে বেরিয়ে চা খেতে খেতে সেখানটাতে জমিয়ে আড্ডা দিতে। শীতের মৌসুমে ক্যাম্পাসের অরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে শিক্ষা সফর। এ সময় যেন ক্যাম্পাসে শিক্ষা সফরে যাওয়ার জন্য হিড়িক পড়ে যায়। শিক্ষা সফরের জন্য তারা বেছে নেয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, কিংবা সেন্টমার্টিনের নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যম-িত স্থানগুলোকে। তাই তো প্রতিদিনই শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও দেখা যায় শিক্ষা সফরে যাওয়ার বাসটির সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে সেলফি তোলার মহড়া দিতে। ঠা-ায় জমে যাওয়ার হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে এ সময় প্রায় সবারই হাত নিশপিশ করে একটু ব্যাডমিন্টন কিংবা ক্রিকেট খেলার জন্য। তাই তো হলের কিংবা বিভাগের খোলা প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থী আর শিক্ষকদের দেখা যায় ব্যাডমিন্টন খেলতে খেলতে ঘেমে একাকার হতে। বিভিন্ন ইনডোর গেমস যেমন, টেবিল টেনিস, দাবা, লুডু, ক্যারামও এ সময় হলের শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। রুমের ভেতর কাঁথা কম্বল জড়িয়ে বন্ধুরা মিলে বেশ মজা করে মুভি দেখাটাও হয়ে উঠে বেশ আনন্দদায়ক। পাহাড় ঘেরা সবুজ ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার ছাত্র সেতু বলেন, প্রচ- ঠা-ায় শরীর জমে গেলেও পড়াশোনার পাশাপাশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়া আর শীতকালীন নানান খেলাধুলায় বেশ উপভোগ্যই হয়ে উঠে শীতকাল। রোদের তীব্রতা আর প্রাকৃতিক কোন দুর্যোগের আশঙ্কা না থাকায় মূলত শীতকালের বার্ষিক শিক্ষা সফরটা হয়ে উঠে বেশ আনন্দদায়ক। পরীক্ষা আর ক্লাসের অবসরে টিএসসি অথবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চা আর পিঠা খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শীতকালকে বেশ উপভোগ্যই মনে হয়, জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী রাবেয়া খাতুন। একটু আলাদা করে বলতে হয় দেশের অন্যতম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরের কথা। এখানে যেন শীত একটু ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসে। শীতের আগমনি বার্তার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পাসে আগমন ঘটে হাজারো অতিথি পাখির। তাদের কলকাকলি আর উড়া-উড়িতে মুখরিত হয়ে উঠে পুরো ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের প্রায় এক ডজন স্বচ্ছ পানির লেকে ফুটে থাকা রক্তকমলের মাঝে জলকেলিতে মেতে উঠে ওরা। এই অতিথি পাখিদের দেখতে ক্যাম্পাসে ছুটে আসে ঢাকা শহর ও তার আশপাশের এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। ক্যাম্পাসের পিঠা চত্বরে মজার মজার পিঠা খেতে খেতে তারা উপভোগ করে পাখিদের এই মিলনমেলা। হাজারো এসব অতিথি পাখি আর তাদের দেখতে আসা অতিথিদের উৎসবমুখর পদচারণায় ক্যাম্পাসে তৈরি হয় অন্যরকম আনন্দময় আবহ। তাই তো প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজনে করা হয় পাখিমেলার। অনুষ্ঠিত হয় বাহারী ডানার রঙ্গিন প্রজাপতি মেলা। ছোট্ট মেয়ে রিমি ও তার আম্মুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা জিরাবো সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সানোয়ার হোসেন বলেন, শীতকালে জাহাঙ্গীরনগরে অতিথি পাখি দেখতে আসা আর মজার মজার সব পিঠা না খেলে কোথায় যেন শীতকালের একটা অপূর্ণতা থেকে যায়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত হয় শীত বরণীয়া বর্ণিল হিম উৎসব। কয়েকদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই হিম উৎসবের নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন ও পিঠা মেলায় ক্যাম্পাসজুড়ে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। কথায় আছে কারও পৌষমাস আবার কারও সর্বনাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য শীতকাল অন্যরকম আনন্দবার্তা নিয়ে এলেও খেটে খাওয়া বস্ত্রহীন মানুষের জন্য হয়ে উঠে পীড়াদায়ক। তাই তো শিক্ষার্থীরা মিলে এসব শীতার্ত মানুষগুলোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকে। ভূপেন হাজারিকার ‘মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য’ গানটির চর্চাটা যেন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এসব শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই।
×