বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আজ ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। ১৯৬৯ সালের এই দিনে আইউব শাহীর গুলিতে নিহত হয় ছাত্রলীগের কর্মী নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান। যার বুক পকেটে লেখা ছিল- ‘মা শেখ মুজিবকে মুক্ত করতে যাচ্ছি’। এর আগে আগরতলা মামলায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তখন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকরের সব ব্যবস্থাই করে ফেলেছিল পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুব খান। যার প্রতিবাদে জাগ্রত ছাত্রসমাজ তখন ফুঁসে উঠে। ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলে শোষিত মানুষের পক্ষে মুক্তিকামী ছাত্রসমাজ ১১ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এ অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে।
ঊনসত্তরের ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে সারাদেশে আন্দোলনের আগুন জ্বলে উঠে। মতিউর-মকবুল-রোস্তমের বুকের তাজা রক্তে সারাদেশে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়। ওই গণঅভ্যুত্থানের মুখেই পতন ঘটে স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের। ছাত্রসমাজের তীব্র আন্দোলনের মুখেই ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তি পান এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি লাখো মানুষের সমাবেশে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। মূলত ’৬৯-এর এই দিনটিতেই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল।
আজ সেই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এক তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা, পরবর্তীতে ১১ দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালী জাতি অর্জন করে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম অর্জন মহান স্বাধীনতা।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানী শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্ত করতে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। এতে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্রতর হয়। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী আন্দোলনকে নস্যাত করার হীনউদ্দেশ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে। এ মামলার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দুর্বার ও স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন গড়ে তোলে।
পাকিস্তানী সামরিক শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের এই দিনে সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে রাজপথে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণীর ছাত্র মতিউর রহমান। প্রতিবাদে সংগ্রামী জনতা সেদিন সচিবালয়ের দেয়াল ভেঙ্গে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষুব্ধ জনগণ আইয়ুব-মোনায়েম চক্রের দালাল, মন্ত্রী-এমপিদের বাড়িতে এবং তাদের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান ও পাকিস্তান মর্নিং নিউজে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর শহীদ আসাদের আত্মদানের পর ২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি শোক পালনের মধ্য দিয়ে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয় এই দিনে। শোষিত মানুষের পক্ষে মুক্তিকামী ছাত্রসমাজের ১১ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে এ অভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়।
জনগণ আইয়ুব গেটের নাম পরিবর্তন করে আসাদ গেট নামকরণ করে। জনতার রুদ্ররোষ এবং গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকলকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পতন ঘটে আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্রের। অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আজও দেশের মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।
দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনে সবাইকে ঊনসত্তরের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা, পরবর্তীতে ১১ দফা ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পথ বেয়ে রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ১৯৬৯ সালের এই দিনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে জমায়েত, বকশীবাজারের নবকুমার ইনস্টিটিউটে শহীদ মতিউরের স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন ও আলোচনা সভা।
