ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চাপে সরকার

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করতে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরামর্শ

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করতে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরামর্শ

তৌহিদুর রহমান ॥ পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নে পক্ষ-বিপক্ষের চাপে রয়েছে সরকার। দেশের মধ্য থেকে বিভিন্ন মহলের পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের জন্য চাপ রয়েছে। তবে বিদেশী কয়েকটি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পরামর্শ দেয়া হয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার জন্য। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করছে সরকার। কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানায়। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যেই সরকারকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দেশ দুটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সার্ক এবং ওআইসির সদস্য দেশগুলোর মধ্যেও অনৈক্য তৈরি হবে। কেননা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়েই এ দুটি সংস্থার প্রভাবশালী সদস্য। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দেশ দুটি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের সেই অবস্থান সরকারকে ইতোমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে। সূত্র জানায়, সৌদি আরবের সন্ত্রাসবিরোধী জোটে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয়েই যোগ দিয়েছে। এছাড়া মুসলিম দেশ হিসেবে দুই দেশের মধ্যেই সুসম্পর্ক চায় সৌদি আরব। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে সৌদি আরব মনে করে পাকিস্তানের সঙ্গে কোনভাবেই বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত নয়। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করার জন্য পরামর্শ দিলেও বাংলাদেশের মধ্যে থেকে এ সম্পর্ক ছিন্নের জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের জন্য যুদ্ধাপরাধ গণবিচার কমিটি ও গণজাগরণ মঞ্চ ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সেক্টর কমান্ডারস ফোরামও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের দাবি তুলেছে। এদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে ইতোমধ্যেই সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাকিস্তানের কোন অনুষ্ঠানে কোন প্রতিনিধি যাবেন না। এছাড়া বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও পাকিস্তানের সঙ্গে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এদিকে যুদ্ধাপরাধ বিচারকে কেন্দ্র করে ঢাকা-ইসলামাবাদ দেশের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছে, সে বিষয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করছে ঢাকা। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রগুলো নিয়ে এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। কেননা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এখন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে রয়েছে। দু’দেশই এখন সার্ক, কমনওয়েলথ, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম ও সংস্থায় একযোগে কাজ করছে। দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হলে এসব ফোরামেও কি ধরনের প্রভাব পড়তে পারে সেটাও খতিয়ে দেখছে সরকার। তবে এখনই পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা সম্ভব না হলেও দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অবনমন চলছে। পাশাপাশি পাকিস্তানও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক অবনমনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সে কারণে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন তলানিতে ঠেকেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের মূল্যায়ন হচ্ছে। আর দুই দেশের কূটনীতিককে প্রত্যাহার ও পাল্টা প্রত্যাহারের ঘটনায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, এটা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য সহায়ক নয়। আমরা ধৈর্য্য সহকারে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক রাখার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে বাংলাদেশ কোন আপোস করবে না বলেও তিনি জানিয়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ছিন্নের বিষয়ে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনীতিককে পরস্পর তলব ও প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য দাবি জোরালো হচ্ছে। তবে আমি বলবো, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করাটা ঠিক হবে না। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করে দেশটি যেন বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চায়, সে বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করা উচিত। এটি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা অব্যাহত রাখার জন্য আহ্বান জানান তিনি। ঢাকা-ইসলামাবাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একটি শীতল সম্পর্কের সৃষ্টি হলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধী বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদ-ে নাখোশ হয়ে গত ২২ নবেম্বর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায় পাকিস্তান। পাকিস্তানের ওই প্রতিক্রিয়ার প্রতিবাদে গত ২৩ নবেম্বর দেশটির ঢাকায় নিযুক্ত হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে সরকার। সে সময় পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে জানিয়ে দেয়া হয়, পাকিস্তান সরকার সরাসরি এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে পাকিস্তান সরকার কোনভাবেই যেন আর হস্তক্ষেপ না করে, সে বিষয়ে তাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। এদিকে ৩০ নবেম্বর ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে তলব করে পাকিস্তান সরকার। তাকে তলবের পর ১৯৭১ সালের হত্যাকা-ে সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান। তলব ও পাল্টা তলব নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরই মধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে প্রত্যাহার করে নেয় দেশটি। ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দেয় বাংলাদেশ। তারই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামাবাদ থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহারের দাবি জানায় পাকিস্তান। সে কারণে গত ৫ জানুয়ারি মৌসুমী রহমানকে প্রত্যাহার করে নেয় বাংলাদেশ। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা বা নৃশংসতাকে পাকিস্তান অস্বীকার করছে। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষেও অবস্থান নিয়েছে দেশটি। পাকিস্তান সরকার একাত্তরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অভিযোগকে ভিত্তিহীন ও ধারণাপ্রসূত হিসেবে আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে নৃশংসতার কোন ঘটনা ঘটেনি। আর গণহত্যার ঘটনার জন্য পাকিস্তানের কোন দায় ছিল না। পাকিস্তানের ওপর আনা এসব অভিযোগ সত্য থেকে অনেক দূরে। বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে ভিত্তিহীন ও অমূলক অভিযোগ আনছে বলে মনে করে দেশটি। এসব নিয়ে দুই দেশের কূটনীতিককে দফায় দফায় তলব ও পাল্টা তলব করা হয়। এছাড়া দুই দেশের কূটনীতিককে প্রত্যাহার ও পাল্টা প্রত্যাহারেরও ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার ধারবাহিকতায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্নের দাবি উঠেছে।
×