ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রাজস্ব আয় বাড়াতে কর ও ভ্যাট ফাঁকি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ

বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

বাজেট বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জের মুখে

এম শাহজাহান ॥ জাতীয় বাজেটের আকার বাড়াতে কর ও ভ্যাট ফাঁকি নিয়ন্ত্রণে এবার কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য হলো রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করে বাজেটের আকার ও আয়তন বৃদ্ধি করা। এজন্য উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অতিমাত্রায় কর ফাঁকি এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী নতুন করদাতা শনাক্ত না হওয়ায় কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। এতে করে নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এই বাস্তবতায় জাতীয় রাজস্ব আয় বৃদ্ধিতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ গ্রহণ করে কৌশলপত্র প্রণয়ন করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। কৌশলপত্র অনুযায়ী সরকারের চলতি মেয়াদে ৩০ লাখ এবং রূপকল্প-২১ সালের মধ্যে ৫০ লাখ ব্যক্তিকে কর সীমার আওতায় আনা হবে। বর্তমান দেশে ১২ লাখ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর দিচ্ছেন। সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে প্রত্যক্ষ করকে রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাতে পরিণত করা হবে। কর ফাঁকি রোধ করে সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি সমতার নীতি প্রতিষ্ঠিত করবে সরকার। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। জানা গেছে, এবারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৮ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। এতে রাজস্ব বোর্ডের হিস্যা হচ্ছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এই অর্থ আদায় হবে আয়কর, মূসক, সম্পূরক শুল্ক এবং আমদানি শুল্ক খাত থেকে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায় করা যায়নি। এক্ষেত্রে অতিমাত্রায় কর ও ভ্যাট ফাঁকি, নতুন করদাতা কাক্সিক্ষত হারে চিহ্নিত না হওয়া এবং এনবিআরের সক্ষমতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজস্ব আদায় বাড়াতে তাই ইতোমধ্যে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এনবিআর। এছাড়া একটি কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হচ্ছে। এতে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার রোধে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে। ভ্যাট ফাঁকি রোধে চলবে অভিযান। ৫০ লাখ টাকা রাজস্ব বকেয়া আছে এমন করদাতাদের তলব করা হবে। সম্পদশালীদের আয়-ব্যয়ের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পাচার করা অর্থ থেকে রাজস্ব আদায় করতে ৩২টি দেশে চিঠি পাঠিয়েছে এনবিআর। এছাড়া রাজস্ব আদায়ে এনজিও, ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় সংক্রান্ত হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কর আদায় বাড়াতে রাজস্ব খাত সংস্কার করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি বাজেট বক্তৃতায় কর ও ভ্যাট ফাঁকি নিয়ন্ত্রণসহ রাজস্ব আদায় বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। গত ছয় বছরে রাজস্ব বোর্ডের জনবল ও দফতর বেড়েছে ব্যাপকভাবে এবং ওই সময় তারা একটি বছরে আদায়ে প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশের বেশি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আয়কর দেন সামান্য কতিপয় ব্যক্তি। কিন্তু সরকারের লক্ষ্য হলো জাতীয় রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করে সরকারী বাজেটের আকার ও আয়তন বাড়ানো। ১৬ কোটি মানুষের দেশে ৩ লাখ কোটি টাকার বাজেট মোটেই পর্যাপ্ত নয়। তাই করদাতা বৃদ্ধির উদ্যোগ অব্যাহত রাখা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, এই মেয়াদের শেষ বছর ২০১৮-১৯ সালে সক্রিয় করদাতা ৩০ লাখে উন্নীত করতে হবে। শুধু তাই নয়, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে তথা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ করকে রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাতে পরিণত করার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে করে নিকট ভবিষ্যতে সামগ্রিক অর্থনীতিতে একটি সমতার নীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। আর সমতার নীতি বাস্তবায়নের প্রধানতম পদক্ষেপ হলো করভিত্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে আয়কর আইনের সার্বজনীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মোঃ নজিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ে এনবিআর বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র এক ভাগ মানুষ রাজস্ব জালের আওতায় রয়েছেন। অথচ মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ রাজস্ব জালের আওতায় আনা অসম্ভব কিছু নয়। নিজস্ব অর্থায়নে বাজেট প্রণয়ন ও অবকাঠামো খাত উন্নয়নে রাজস্ব আদায় বাড়াতেই হবে। তিনি বলেন, গত অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে রাজস্ব আদায়ে বড় অঙ্কের ঘাটতি থাকলেও অর্থবছরের শেষ হিসাবে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়। অর্থবছরের প্রথম ভাগের চেয়ে শেষ দিকে আদায় বাড়ে। শুধু তাই নয় দুর্বলতা চিহ্নিত করে রাজস্ব আদায়ে বৃদ্ধিতে নতুন কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে এনবিআর। নতুন উদ্যমে কাজ করছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। আশা করছি, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় করা সম্ভব হবে। ই-পেমেন্ট সফটওয়্যার আধুনিকায়ন ॥ অনলাইনে ব্যাংক এ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বড় অংকের কর পরিশোধে ই-পেমেন্ট সফটওয়্যারকে আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। এতে সক্ষমতা বাড়লে সব তফসিলি ব্যাংকের এ্যাকাউন্টে যে কোন করদাতা, যে কোন পরিমাণ কর পরিশোধ করতে পারবেন। এজন্য বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) তথ্য কেন্দ্রের সফটওয়্যার হোস্টিংয়ের (সিস্টেমটি বিসিসির সার্ভারের স্থাপন) কাজ চলছে। এর মাধ্যমেই খুব শীঘ্র ই-পেমেন্ট সিস্টেম আধুনিকায়নের কাজ শেষ হবে। ২০১২ সালের ২৬ মে এ পদ্ধতি চালু হওয়ার পর এ পর্যন্ত ই-পেমেন্ট পদ্ধতিতে অল্প করদাতাই কর দিয়েছেন। তবে সংখ্যার বিচারে এটি খুব বেশি না হলেও এর সাড়ায় আশাবাদী এনবিআর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এনবিআর চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ই-পেমেন্টের মাধ্যমে কর পরিশোধের বিষয়ে করদাতাদের মধ্যে দিন দিন আগ্রহ বাড়ছে। ইতিমধ্যেই সিটি ব্যাংক এবং স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ই-পেমেন্টের মাধ্যমে কর নিতে তাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। অন্য ব্যাংকগুলোকেও বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অনুরোধ জানানো হবে। জানা গেছে, বর্তমান ই-পেমেন্ট সিস্টেমে কর প্রদানের ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাও দূর করা হচ্ছে। বর্তমানে কিউ ক্যাশ নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত ২৬টি তফসিলী ব্যাংকের এ্যাকাউন্ট বা কার্ড ব্যবহার করে ই-পেমেন্ট সিস্টেমে অল্প পরিমাণ কর পরিশোধ করা যায়। কর প্রদানের জটিলতা দূর করা হচ্ছে ॥ রাজস্ব আদায় বাড়াতে করদাতাদের হয়রানি ও করপ্রদানে জটিলতা দূর করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আইন ও বিধিমালা সংশোধন করে সহজ সরল করা হয়েছে। আইন সংস্কারের ক্ষেত্রে নতুন মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক আইন চলতি বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে এনবিআর। এছাড়া নানা হিসাব পদ্ধতিতে জটিলতা হ্রাস করে করজালে কর প্রদানকারীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে হচ্ছে কর অফিস ॥ করের আওতা বৃদ্ধিতে উপজেলা পর্যায়েও কর অফিস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় সার্ভে করা হয়েছে। এতে বিপুলসংখ্যক নতুন করদাতা চিহ্নিত করতে পেরেছে এনবিআর। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের উপজেলা পর্যায়ে কর অফিস স্থাপন করার কাজ এগিয়ে চলছে। উপজেলায় সক্ষম করদাতা থাকলেও অনেকে কর দেন না। শহরের চেয়েও বেশি কর দিতে সক্ষম অনেকে এর বাইরে থেকে যান। ফলে রাষ্ট্রীয় সুবিধা বঞ্চিত হন তারা। বর্তমানে ৬২ উপজেলায় কর অফিস রয়েছে। সেগুলোতেও অধিকাংশ করযোগ্য ব্যক্তি ই-টিআইএন নিচ্ছেন না। নিলেও কর দিচ্ছেন না। জরিপ আর মাঠ প্রশাসনের তদারকির অভাবে অনেকে রয়ে যাচ্ছেন এর আওতার বাইরে। এখানে জরিপের মাধ্যমে ‘ন্যূনতম’ কর দিতে সক্ষম ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার নির্দেশনা দিয়েছে এনবিআর। করজাল বাড়ানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে এনবিআর এবারই প্রথম ৮৬টি উপজেলায় করমেলার আয়োজন করে। ২০১৮ সালের মধ্যে সব উপজেলায় কর অফিস স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে। সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ এ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) নিবন্ধিত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির সংখ্যা ১ লাখ ৪ হাজার ৩০০টি। এর মধ্যে মাত্র ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থেকে ট্যাক্স আদায় করে এনবিআর, যা মোট কোম্পানির মাত্র ৩০ দশমিক ৬৯ শতাংশের সমান। বাকি সব প্রতিষ্ঠানের কোন তথ্য-উপাত্তই এনবিআরের কাছে নেই। কোটিপতি আমানতকারীদের দিকে এনবিআরের নজর ॥ কর আদায় বাড়াতে এবার কোটিপতি ব্যাংক আমানতকারীদের দিকে নজর রাখছে এনবিআর। দেশে বাড়তে শুরু করেছে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত তিন মাসে ব্যাংকিং খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ৬৩৫ জন। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ১ কোটি টাকার ওপরে আমানত রেখেছেন এমন গ্রাহক রয়েছেন ৪৫ হাজার ৬৯৮ জন। এসব আমানতকারীর পাশাপাশি যারা গাড়ি ব্যবহার করছেন অথচ কর দেন না তাদেরও চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে এনবিআর। এছাড়া ঢাকাসহ শহর এলাকার বাড়ির মালিকরা নিয়মিত কর পরিশোধ করছেন কি না সে বিষয়ে এনবিআর নজরদারি বাড়িয়েছে।
×