ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সিঙ্গাপুর বিভ্রান্ত তারুণ্য ও উদ্ধারপর্ব

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

সিডনির মেলব্যাগ ॥ সিঙ্গাপুর বিভ্রান্ত তারুণ্য ও উদ্ধারপর্ব

উন্নয়ন আর অগ্রগতির পাশাপাশি স্থিতির ব্যাপারটাও দরকারী। এই স্থিতি যদি দেশের স্থিতিশীলতা বোঝায় তাহলে জামায়াত আর বিএনপির অন্যায় সহ্য করা এর আওতায় পড়ে না। তবে গণতন্ত্র বা উদারতার খাতিরে নিয়মের বিষয়গুলো মানতে হবে। তার একটা গাইড লাইন থাকা জরুরী হলেও নেই। যার যেমন খুশি বা যেভাবে ইচ্ছে আচরণ করার নাম গণতন্ত্র নয়। দেশে বিরোধী দলের অস্তিত্ব বিলোপের পথে। সরকারী দল যতটা দায়ী বিরোধী দলের দায়ও ততটা। আমরা জানি বাংলাদেশ এখনও বহুমুখী গণতান্ত্রিক দেশের মতো সুস্থ রাজনীতির দেশ হতে পারেনি। দেশ ও জাতির মৌল বিষয়ে বিরোধ জাগিয়ে রাখা দলগুলো সেটা হতে দিচ্ছে না। তাদের আপোসহীনতার নামে দুর্মর মনোভাব জঙ্গীপনা আর নিয়ম না মানার কারণে আজ আমরা দেশের বাইরেও বিপদে আছি। দেশের ছায়া বিদেশে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। মাত্র ক’দিন আগে সিঙ্গাপুরে যা ঘটল তাতে জাতির মাথা হেঁট হওয়ার বিকল্প নেই। সে প্রসঙ্গে লেখার আগে বলতে চাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে মৌলবাদ বা সন্ত্রাস তা আমাদের প্রভাবিত করলেও জঙ্গী হওয়ার খায়েশের পেছনে আছে রাজনীতি। বিএনপি ও তাদের সমর্থক নামে পরিচিতদের ভেতর সন্ত্রাস প্রক্রিয়া দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে আসছে। নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি অনীহা আর গদির মোহে তারা দেশের পাশাপাশি বিদেশেও নিজেদের নেটওয়ার্ক খুলে মদদ দিয়ে চলেছে। যেসব তরুণ সিঙ্গাপুরে আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তি ও পরিচয়কে বিপন্ন করেছে, তাদের খবর নিয়ে দেখুন এরা কেউ কোনদিন মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি করেনি। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি বা স্বদেশপ্রেম থাকলে তারা এমন উগ্র হতে পারত না। দীর্ঘকালের প্রবাসী জীবনে আমি দেখেছি মানুষ মূলত তার শিকড়ের আচরণকেই শেষপর্যন্ত আঁকড়ে ধরে। যে যেভাবে বড় হয় বা বড় হয়ে ওঠে তার প্রভাব আসলে এড়াতে পারে না। এই যে বিপথগামী যুবকরা এরা দেশ ছেড়ে এমন একটি দেশে গিয়েছিল যেখানে জীবন আনন্দের। যেখানে জীবন নিরাপদ। প্রথমত আমরা নিরাপত্তা ও জীবিকার কারণেই দেশ ছাড়ি। সিঙ্গাপুর নিরাপত্তা দিয়েছিল। ভাল উপার্জনও দিয়েছিল। সেদেশে কয়েকবার যাবার সুবাদে আমার জানা আছে, কেমন নিয়ম মেনে চলা দেশ এটি। মানুষ নির্মিত প্যারাডাইস। তারপরও এদের তা ভাল লাগেনি। এই ভাল না লাগার কারণ যদি আদর্শ হতো বলার কিছু ছিল না। কিন্তু খেয়াল করে দেখুন তারা ঠিকই সেদেশের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। সেদেশের কিছু ভোগ করার পর দেশটি এবং জন্মভূমির বিরুদ্ধে এ ষড়যন্ত্রে নেমেছে। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? তাদের কেউ দাওয়াত করে নিয়ে যায়নি। তারা নিজ থেকে ধারণা করি দালাল ধরে বা এজেন্সির মাধ্যমে টাকা পয়সা খরচ করে তবেই যেতে পেরেছিল। যে স্বপ্ন আর ইচ্ছে নিয়ে তারা গিয়েছিল তাকে এভাবে দুমড়ে মুচড়ে পায়ে পিষে দেশ ও জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনার পেছনে কি আছে সেটা খুঁজে বের করতে না পারলে এ জাতীয় ঘটনা ঠেকানো যাবে না। বাংলাদেশীদের সুনাম ও গৌরব যখন বিশ্ব অঙ্গনে আস্তে আস্তে মাথা তুলছে তখন এর অর্থ কি? এরা কি আসলে জেহাদী? তাদের এই ধরনের হীন কাজে সিঙ্গাপুরের লোকসান হতে পারত, দেশেরও সর্বনাশ হতে পারত কিন্তু আখেরে কি তাদের খায়েশ পূর্ণ হতো? হতো না জেনেও তারা কেন এই সর্বনাশা পথে পা বাড়িয়েছিল? আমি খুব কাছ থেকে দেখছি আমাদের যুবকদের ধ্বংস করছে এক ধরনের ধর্মব্যবসায়ী আর ভুল রাজনীতি। দেশের অবস্থানে আওয়ামী লীগ সবকিছু ভাল করছে এমন ভাবার কারণ নেই। বরং তারা যা করতে পারত বা করলে অনেক সমস্যা সহজ হয়ে উঠত তা করা হচ্ছে না। কেন তা হচ্ছে না আমরা সবাই তা কমবেশি বুঝি ও জানি। কিন্তু রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির মোকাবেলা না করে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের মাধ্যমে তাকে নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টাই এসবের নেপথ্যে কাজ করেছে। বিএনপি বা জামায়াত সরু সুতোর মতো এর পেছনে আছেই। এরা মগজ ও মাথা ধোলাই করে ছেড়ে দেয়। লন্ডনের যুবরাজ আপাতত নিষ্ক্রিয় বা চুপ থাকলেও পালের গোদা। তাদের নেটওয়ার্ক দুনিয়াময় কাজ করে। এটা মানতে হবে অপপ্রচার বা বিষময় প্রচারণার জৌলুস ও তাকদ বেশি। এগুলো টনিকের মতো। আদর্শ বা সহজ সরলবোধকে যদি দুধ বলি তো এগুলো হচ্ছে নেশার পানীয়। নেশার পানীয় টানে বেশি কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে দেয় না। যারা বেচে তারা মরে না, মরে খেতে খেতে বুঁদ হয়ে যাওয়া নেশাখোররা। এদের তাই হয়েছে। ঘর সংসার দেশ জাতি ভাল মন্দ সব ভুলে এমন এক অবস্থানে চলে গিয়েছিল, যেখান থেকে আর ফেরার রাস্তা থাকে না। এই পয়েন্ট অব নো রিটার্ন আজ আমাদের তারুণ্যকে গ্রাস করতে চলেছে। ধরা না পড়লে তারা যেভাবে শিরোনাম হতো তাতে বাংলাদেশের মুখ দেখানোই কঠিন হয়ে পড়ত। ধরা পড়ার পরও তারা শিরোনাম বটে। আজকে আমাদের তাই মূলে হাত দিতে হবে। আগেও লিখেছি দেশে-বিদেশে এক চক্র একাধিক চক্রের কাজ হলো বিভ্রান্তি জিইয়ে রাখা। তারা আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে ছায়ার সঙ্গে লড়তে চায়। খালেদা জিয়ার মতো নেতা নাকি ধর্মের নেতা? যারা ভাল করে জীবন আচরণ করতে শেখেনি, তারা তারুণ্যকে পথ দেখাবে কিভাবে? আর একটা বিষয় কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। জীবন ও ধর্মের বিষয়গুলো কবে থেকে এমন মুখোমুখি হয়ে উঠল? কেন তারা বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাইছে আজ? মুষ্কিল এই বরেণ্য অবরেণ্য নামী অনামী বুদ্ধিজীবীরাও আজ পথহারা। তারা কোন কারণে জানি না এগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে আমেরিকা ইহুদী বা অন্যদের ঘাড়ে চাপাতে পারলেই যেন বেঁচে যায়। একটা বিষয় মনে হয় সত্য প্রায় শেষ বয়সে পৌঁছে যাওয়া বুদ্ধিজীবীদের বিকল্প তৈরি হয়নি বলেই হয়ত আমরা নতুন কথা শুনতে পাই না। যারা নতুন কথা বলতে পারেন তারা হয় আড়ালে নয়ত অবহেলিত। সিঙ্গাপুরের এই ঘটনাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। বরং আমাদের বোঝা উচিত সমস্যার শিকড় কতটা গভীরে। দেশের বাইরে বসে যারা এগুলো করতে চায় বা করতে পারে তারা একা নয়। তবে কারা এর পেছনে? সে কথা আমরা না জানলেও গোয়েন্দারা জানেন। বাংলাদেশে টাকা খরচ করে পোষা গোয়েন্দারা ঘটনা ঘটার পর তৎপর হয়ে ওঠেন। ধরপাকড় বা সার্চ শুরু হয় ঘটনা ঘটলে। অথচ নিয়ম হচ্ছে আগেই তা করার। সেটা মানলে আমাদের জীবন এতটা ঝুঁকির মুখে থাকত না। এখন আমরা সমাধান চাই। দেশের সঙ্গে বিদেশীদের যোগে তাদের নেটওয়ার্ক ও আমাদের নেটওয়ার্ক একসঙ্গে মিলিয়ে কাজ করলে নিশ্চয়ই আমরা এর সমাধান বের করতে পারব। ঐ যে বলছিলাম রাজনীতি সে এটাও তো দেবে না। তার টাকা খাওয়া সুশীলরা তখন চ্যানেলে চ্যানেলে গেল গেল রবে দেশ মাথায় তুলবে। এগুলোর অবসান আজ জরুরী। নয়ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কি যে ঘটবে আর কখন আমরা বিপদে পড়ব বলা যায় না। সরকারের পাশাপাশি সবাইকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানাই। তারুণ্য বিভ্রান্ত। তাদের পথ দেখাতে হবে। আমরা যেন আমাদের কর্তব্য ভুলে না যাই। [email protected]
×