ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৪ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ॥ সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(২৩ জানুয়ারির পর) শফিউল্লাহ লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকে যখনই তিনি বলতেন, “স্যার আপনার নিরাপত্তায় খামতি আছে”, তখনই বঙ্গবন্ধু বলতেন, “শফিউল্লাহ চিন্তা করো না, বাঙালীরা আমাকে বা তোমাকে হত্যা করবে না। তার মানসিক দৃঢ়তা এমনই ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস হলো, তার বিশ্বস্ত বন্ধু তার পাশে বসেই তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন।” তিনি লিখেছেন, “বঙ্গবন্ধু আমাকে সেনাপ্রধান বানালেন কিন্তু আমার পাশে এক ষড়যন্ত্রকারীকে রেখে আমার হাত বেঁধে দিলেন। যদি আমি মুক্ত হতাম এবং জিয়াকে চাকরিতে না রাখা হতো তাহলে যে সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলাম তা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যেত না।” জেনারেল শফিউল্লাহর বইয়ের শেষ অধ্যায়টির নাম ‘অ্যান অ্যানালাইসিস অব স্টেটমেন্টস অন ১৫ আগস্ট ১৯৭৫’। এ অধ্যায়ে ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা যে সব সাক্ষাৎকার/বিবৃতি দিয়েছেন তার বিশ্লেষণ করেছেন। এসব সাক্ষাৎকার/বিবৃতির কেন্দ্রে অবশ্যই জেনারেল শফিউল্লাহ। এরা হলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ, কর্নেল শাফায়াত জামিল ও ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল। এ ছাড়া জেনারেল জিয়া ও জেনারেল খালেদ মোশাররফের আচরণ বিশ্লেষণ করেছেন। বস্তুত তারা তাকে দায়ী করতে চেয়েছেন, কিন্তু তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি যেসব ঘটনা বিধৃত করেছেন তাতে তাদের বক্তব্য খুব একটা যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না। শফিউল্লাহ শেষ পর্যায়ে চারজনের বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। ধরে নেয়া যায় এ চার জনকেই তিনি অভিযুক্ত করছেন বঙ্গবন্ধু হত্যায়। এ চারজন হলেন জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (খালেদকে তিনি তার ডান হাত ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত বলে মনে করতেন। পরে তিনি তার ওপর আস্থা হারান), কর্নেল শাফায়াত জামিল এবং ব্রিগেডিয়ার রউফ। ॥ দশ ॥ সেনা অফিসাররা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের বই লিখেছিলেন। সেসব বইয়ের ওপর ভিত্তি করে ২০১৩ সালে একটি বই লিখেছিলাম বাংলাদেশি জেনারেলদের মন। এদের অধিকাংশই কাকুল প্রশিক্ষিত। তাদের মনমানসিকতা কী ধরনের ছিল তাই বিধৃত হয়েছে বইয়ে। তাদের কারো কারো রচনায় বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আসীন হওয়ার বিষয়টি বিবৃত হয়েছে। ওই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টিও এসেছে। আমি সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিষয়টি বা বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র কিভাবে তারা দেখেছেন তাই উল্লেখ করব। প্রথমে লে. কর্নেল আকবর হোসেন বীরপ্রতীকের বইয়ের কথা উল্লেখ করব। নাম শহীদ জিয়া ও আমি। ২০০৩ সালে ৬৪ পৃষ্ঠার গ্রন্থটি প্রকাশ করে ঢাকার দীপ্তি প্রকাশনী। আকবর হোসেনদের মতো আরো অনেকে যে জিয়ার প্রশ্রয়ে দেশকে ১৯৭৫ সালের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার প্রমাণ বা পরোক্ষ ইঙ্গিত পাওয়া যাবে তার জবানিতে। তিনি লিখেছেন, শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান করা হলে তাদের ‘মনঃপূত’ হলো না। জিয়াউর রহমান তখন কুমিল্লা ব্রিগেডে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। “জিয়াউর রহমানকে না জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আমার সঙ্গী যোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে নিয়ে লিফলেট বানিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভিতর বিতরণ করলাম। বিষয় ছিল, ‘জিয়াউর রহমানকে কেন চিফ অব স্টাফ বানানো হলো না?’ আর ছিল দলীয়করণের কথা। সামরিক বাহিনীতে তখন বেশ একটা দ্বন্দ্ব চলছিল জিয়াউর রহমানকে নিয়ে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অনেকে যারা জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে মেনে নিতে পারছিল না এবং শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে এ রকম কাল্পনিক তথ্য প্রমাণ করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছিল, তারা জিয়াউর রহমানের প্রতি তুষ্ট ছিল না।” (পৃ. ২১-২২] আকবর যখন লিফলেট বিতরণ করছেন তখন জিয়া ব্রিগেড কমান্ডার। গোয়েন্দারা নিশ্চয় তাকে বিষয়টি জানিয়েছিল বা এমনও হতে পারে আকবররাও তাকে লিফলেট পাঠিয়েছিলেন, সেটাই স্বাভাবিক। ডিএফআই-ও এ বিষয়ে নিশ্চয় রিপোর্ট পেয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, এ রকম একটা গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে জিয়া ব্যবস্থা নেননি। এবং ডিএফআই-ও ব্যবস্থা নেয়নি। অর্থাৎ মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্র ও সিভিল শাসন বিনাশ প্রক্রিয়ায় তখনই প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ও ব্যক্তি হিসেবে জেনারেল জিয়া অবস্থান নিয়েছিলেন। আকবর লিখছেন, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে তখন দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। এটি অতিরঞ্জন। কারণ ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে কোনো স্তরে কোনো বিতর্ক হয়নি। এর প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবেন না। বিতর্ক শুরু হয়েছিল যখন জিয়া রাজনৈতিক দল গঠন করে নিজের অবস্থান তৈরি করতে চাইলেন তখন। আকবরের অতিরঞ্জন করার ক্ষমতা দেখলে অবাক হতে হয়। জিয়াউর রহমানকে সুপারসিড করা হয়েছে সে জন্য তিনি সেনাবাহিনী ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন যেটা জিয়া নিজেও চিন্তা করেননি। তখন থেকে তিনি জিয়াকে রাজনীতিতে আনার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। জিয়া সন্দিহান ছিলেন তার অবস্থান নিয়ে। আকবর তখন একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন। “আমি বললাম, যেদিন ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে এসেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে সেদিন আপনিও গিয়েছিলেন, আমিও গিয়েছিলাম। চলবে...
×