ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খোন্দকার নূরুল আলমের মৃত্যুতে সঙ্গীতাঙ্গনে শোক

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

খোন্দকার নূরুল আলমের মৃত্যুতে  সঙ্গীতাঙ্গনে শোক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘চোখ যে মনের কথা বলে’, ‘তুমি এমনি জাল পেতেছো সংসারে’ খ্যাত, একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ও কণ্ঠশিল্পী খোন্দকার নূরুল আলম আর নেই। রাজধানীর ধানম-ির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খোন্দকার নূরুল আলম শুক্রবার দুপুরে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দেশের গুণী এই শিল্পীর মৃত্যুতে দেশীয় সঙ্গীতাঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে শোক জানিয়েছেন অনেকেই। বরেণ্য এই সঙ্গীতজ্ঞের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছসহ সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষরা। এদিকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উদ্যোগে আজ শনিবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রয়াত এই সঙ্গীতজ্ঞের প্রতি সর্বস্তরের মানুষ শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার অসুস্থবোধ করলে খোন্দকার নূরুল আলমকে রাজধানীর ধানম-ির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন তিনি। আক্রান্ত হয়েছিলেন পোলিওতেও। সঙ্গীতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার, চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার, শহীদ আলতাফ মাহমুদ স্মৃতি পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন খোন্দকার নূরুল আলম। ‘ইস্ ধরতি পার’-এর মাধ্যমে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রে যুক্ত হন খোন্দকার নূরুল আলম। ১৯৬৮ সালে ‘অন্তরঙ্গ’ ও ‘যে আগুনে পুড়ি’ নামে বাংলা চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। সে সময় ‘যে আগুনে পুড়ি’র ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এরপর আর থেমে থাকেননি, স্বাধীনতার পর ‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন খোন্দকার নূরুল আলম। অসংখ্য কালজয়ী চলচ্চিত্রে রয়েছে তার সুর করা ও গাওয়া গান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘সংগ্রাম’, ‘জলছবি’, ‘দেবদাস’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘শুভদা’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ প্রভৃতি। ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রে গান তৈরি করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন খোন্দকার নূরুল আলম। এছাড়া এই সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন আরও দু’তিনবার। ‘চোখ যে মনের কথা বলে’ (যে আগুনে পুড়ি), ‘এতো সুখ সইবো কেমন করে’, ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’, ‘এ আঁধার কখনও যাবে না মুছে’, ‘আমি চাঁদকে বলেছি আজ রাতে’, ‘কাঠ পুড়লে কয়লা হয়’, ‘এক বরষার বৃষ্টিতে ভিজে’ (জলছবি) প্রভৃতি গানের কালজয়ী সুর তৈরি করেছেন খোন্দকার নূরুল আলম। চলচ্চিত্র ছাড়াও আধুনিক গান, দেশের গান, বিখ্যাত কিছু কবিতায় সুরারোপ করেছেন খোন্দকার নূরুল আলম। এছাড়া জাতীয় ক্রীড়া সঙ্গীত, আনসার-ভিডিপি দলের সঙ্গীত, স্কাউট মার্চ সঙ্গীত, রোটারি ক্লাবের বাংলা ও ইংরেজী গান সুর করেন তিনি। গান লেখা এবং বিভিন্ন সময় গানের স্বরলিপি ও স্টাফ নোটেশন করার কাজও করেছেন। ১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট ভারতের অসম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়ী মহকুমায় জন্মগ্রহণ করেন খোন্দকার নূরুল আলম। বাবা নেসারউদ্দিন খোন্দকার ও মা ফাতেমা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান তিনি। মাকে হারান ১৯৪৮ সালে, ১২ বছর বয়সে। একই বছর পুরো পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশে চলে আসে। খোন্দকার নূরুল আলম ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে, ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন জগন্নাথ কলেজ থেকে। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছিলেন। ছেলেবেলায় সাঁওতালি সুর আর বীণের আওয়াজ তাকে নাড়া দিত ভীষণভাবে। আর ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর সঙ্গীতই হয়ে উঠেছিল তার ধ্যানজ্ঞান। এরই মধ্যে ১৯৫৭ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে ১৯৫৯ সালে বেতারের সঙ্গে যুক্ত হন খোন্দকার নূরুল আলম। ১৯৬০ সালে তিনি ‘হিজ মাস্টারস ভয়েস’ গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে সুরকার হিসেবে যোগদান করেন। বিটিভির জন্মলগ্ন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। কয়েক বছর ধরে নিভৃতবাস করছিলেন খোন্দকার নূরুল আলম। সচরাচর গণমাধ্যমের খবরে আসতেন না তিনি। ধানম-ির ১৫ নম্বরে পৈতৃক বাড়িতে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ছিল তার নিবাস। ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রামের মেয়ে কিশওয়ার সুলতানার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাদের এক কন্যা ও এক পুত্রসন্তান। স্ত্রী-ছেলেমেয়ের সঙ্গে বাড়িতেই বেশি সময় কাটত তার। খ্যাতিমান এই শিল্পীর চিরবিদায়ে শোকে মুহ্যমান দেশীয় সংস্কৃতি অঙ্গন। তার সুরে গান গেয়ে অনেকে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে অন্যতম কণ্ঠশিল্পী সুবীর নন্দী। প্রয়াত শিল্পীকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, রূচিশীল সঙ্গীতের রূপকার, সংগীতগুরু ছিলেনখোন্দকার নূরুল আলম। ছিলেন শুদ্ধ মানুষ। দর্শনের ডিগ্রিধারী ছাত্র হয়েও তিনি ভালোবেসেছিলেন সঙ্গীতকে। রেডিও, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, আধুনিক ও দেশাত্মবোধক গান-কোনখানে সফল নন তিনি? সবচেয়ে বড় কথা মৌলিক গানের অন্যতম স্রষ্টা তিনি। সঙ্গীতের শুদ্ধ এই কারিগরকে নিয়ে ভবিষ্যতে গবেষণা হতে পারে। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সঙ্গে লোকসঙ্গীতের সুন্দর সম্মিলন ঘটিয়ে তিনি একটা নতুনধারা তৈরি করেছিলেন। তার সুরে গান গেয়ে আমি দু’বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছি। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘শুভদা’ চলচ্চিত্রের গানগুলোর জন্য ১৯৮৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন খোন্দকার নূরুল আলম, আমি, নীলুফার ইয়াসমিন ও গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান। ১৯৭৬ সালে প্রথম তার গান গেয়েছিলাম আমি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’! সুরে, গানে, স্বকীয়তায় তিনি দেশীয় সংগীতাঙ্গনে এমনই জাল পেতেছেন, যে জালে মন্ত্রমুগ্ধ থাকেন শ্রোতারা। খোন্দকার নূরুল আলমের জীবনাচার থেকে এ প্রজন্মের অনেক কিছু শেখার আছে। জনপ্রিয় সুরকার-গায়ক হয়েও তিনি নিভৃতচারী ছিলেন। কখনও প্রচারের আলোয় আসতে চাইতেন না মহৎ এই সঙ্গীতজ্ঞ। তার আত্মা শান্তি পাক এই কামনা করি।
×