ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সুমাইয়া মিফরা

ঘর থেকে বেরিয়ে

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

ঘর থেকে বেরিয়ে

রাত একটু গভীর হলেই বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়ে। বাসার সব থেকে ছোট্ট শিশুটি ঘুমায় তারও আগে। সবাই জানে সে ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু আসলে সে ঘুমায় না। শিশুটির নাম জাহিন। ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া জাহিনের জন্য আলাদা রুম আছে। রুম আলাদা হলেও বাবা-মা এবং বাসার সবাই ওর খুব যতœ নেয়। ঘুমানোর পর মাথায় চুমু দেয়, বাতি নিভিয়ে দেয় আর বাইরে থেকে দরজা টেনে দেয়। কিন্তু বাসার কেউ জানে না জাহিন আসলে ঘুমায়নি, কেবল ঘুমানোর ভান ধরে আছে। যদি ও সত্যি সত্যি ঘুমাতো, তাহলে কি করে বুঝতো যে ও ঘুমিয়ে গেলে অন্যরা ওর কপালে আদর করে চুমু দেয়, বাতি নিভিয়ে দেয় কিংবা দরজা টেনে দেয়! জাহিনের রুমে এসি লাগানো। গরমের দিনে ওর কখনোই কষ্ট হয় না আবার একই সঙ্গে রুমহিটারও আছে তাই শীতের দিনেও কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু জাহিন শান্তিমত ঘুমাতে পারে না। ওর চোখে ঘুম আসেই না। শীত কিংবা গ্রীষ্ম সব সময় ওর ঘুমাতে গেলেই মন খারাপ হয়ে যায়। বাবা-মা পাশে নেই এ জন্য মন খারাপ হয় না, মন খারাপ হয় অন্য কারণে। আর তাই রোজ সবাই যখন ঘুমিয়ে যায় ও তখন চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। অন্যরা জেগে উঠবে ভেবে ঘরের লাইটও জ্বালায় না। জাহিনের রুমের দক্ষিণ দিকে বড় একটা জানালা আছে। জানালায় সøাইডিং গ্লাস দেয়া। গ্লাসগুলো এমন যে বাইরে থেকে ভিতরের কিছু দেখা যায় না কিন্তু ভিতর থেকে বাইরেটা বেশ ভালই দেখা যায়। জাহিন রোজ রাতে সেই জানালার সøাইডিং গ্লাস আস্তে করে সরিয়ে নেয়। জানালার পর্দাটাও সরিয়ে নেয়। জাহিন জানালার পর্দা আর সøাইডিং গ্লাস সরিয়ে আকাশের চাঁদ তারা দেখে না, গাছের মগডালে বসে থাকা পাখিও দেখে না। ও দেখে ওদের বাসা থেকে বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার ধারে আগুন জ্বলছে। সেই আগুনকে ঘিরে আছে ওর মতো এবং ওর থেকে বড় কিছু ছেলেমেয়েকে। এখন শীতকাল। জাহিনের রুমে রুমহিটার চলছে। কোনভাবেই মনে হচ্ছে না এটা শীতকাল। কেবল বাইরে ওই দূরে আগুনের দিকে তাকালে বুঝা যায় এখন শীতকাল। ওদের দিকে তাকালে জাহিনের মন খারাপ হয়ে যায় আবার না তাকালেও মন খারাপ হয়। গ্রীষ্মকালে জাহিনের রুমে যখন এসি চলে তখনও ও জানালার কাচ সরিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকে। দেখে ওই ছেলেমেয়েরা খালি গায়ে গাছের নিচে পাটি পেতে শুয়ে আছে, কিন্তু গরমে তাদের কোনভাবেই চোখে ঘুম আসছে না। এসব দেখে জাহিনের মন খারাপ হয়। ওর একটাই চিন্তা সবাই কেন ওর মতো ঘরে থাকে না? এখন শীতকাল তাই ওদের জন্য জাহিনের মনটা বেশিই কাঁদে। ছোট্ট জাহিন কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। একরাতে বাবাকে বলে বাবা চলো তো একটু বাইরে ঘুরতে যাই। বাবা বলে এই শীতে বাইরে যাবে কেন? জাহিন নাছোড়বান্দা। বাবা ওকে নিয়ে বাইরে যায়। জাহিনের গায়ে অনেক শীতের কাপড়। বাবা ওর কাছে জানতে চায় কোথায় যাবে? ও কিছু বলে না। বাবাকে পিছনে রেখে নিজে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করে। বাবা ওকে ফলো করে। একসময় বাসা থেকে একটু দূরে রাস্তার ধারে সেই আগুন পোহানো ছেলেমেয়েদের পাশে এসে দাঁড়ায় জাহিন। বাবা একটু দূরে থমকে দাঁড়ায়! বাবার চোখে পানি এসে যায়। ছোট্ট জাহিন নিজের গা থেকে একটা একটা করে শীতের কাপড় খুলে আর আগুন পোহাতে থাকা ওর বয়সী ছেলেমেয়েদের হাতে ধরিয়ে দেয়। ছেলেমেয়েগুলো হতবাক হয়ে যায়। তাদের বলার মতো কিছু থাকে না। যখন কেবল একটি টিশার্ট গায়ে বাকি আছে তখন জাহিন থামে। কিছুক্ষণ ওদের পাশে দাঁড়িয়ে আগুনের ওপর হাত রাখে। ছোট্ট জাহিনের মনটা অনেক ফুরফুরে লাগে। কখন যেন বাবাও কাছে এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে আগুনের ওপর হাত রেখেছে। একসময় শুকনো পাতা শেষ হয়ে যায় এবং আগুন নিভে যায়। জাহিনের বাবা জাহিনকে নিজের চাদরে জড়িয়ে বাসায় নিয়ে আসে। সোফায় বসে জাহিনের আম্মুকে বলে আমাদের অগোচরে কখন যেন ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গেছে! জাহিনের আম্মু কিছু বুঝতে পারে না। জাহিন শুধু মুখে হাসি ফুটিয়ে রুমে ফিরে যায়। সে রাতে জাহিনের রুমের দক্ষিণের জানালাটা খোলাই থাকে। জাহিনের চোখে নেমে আসে স্বপ্নময় ঘুম । দিনাজপুর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়দশম শ্রেণী দিনাজপুর
×