ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেট্রোরেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে প্রভাব ফেলবে না

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

মেট্রোরেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে প্রভাব ফেলবে না

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় অন্যতম মাইলফলক হিসেবে স্থাপিত হতে যাচ্ছে মেট্রোরেল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ও শব্দদূষণের আশঙ্কায় এরই মধ্যে এই প্রকল্পের রুট পরিবর্তনের দাবি করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশে যথাসম্ভব কম প্রভাবিত করেই এটি নির্মাণ করা হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যাওয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে সমাবেশ করছে শিক্ষার্থীদের দুটি পক্ষ। শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা, মেট্রোরেলের শব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হবে। নষ্ট হবে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সৌন্দর্য। এ কারণে মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রুটের পরিবহনে যাতায়াত করেন, তারা ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের যুক্তি মেট্রোরেলের রুট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে গেলে ঢাবি শিক্ষার্থীদের পরিবহন সঙ্কট ঘুচবে। এ রুট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে পক্ষে-বিপক্ষে প্রচার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশগত সমস্যা হওয়ার কথা না। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (ইআইএ) প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনাকালে পরিবেশগত বিভিন্ন বিষয় সামনে আসবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই থাকছে শব্দ, কম্পন ও বায়ুর গুণগত মান। এর মধ্যে মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনার সময় শব্দ তৈরি হতে পারে। তবে তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নেয়া সম্ভব। নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ এ জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছে। চীনের চোংগিং শহরে ভবনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে মেট্রোরেল, জাপানের সোহু শহরে একই চিত্র দেখা গেছে। যেখানে বহুতল ভবনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে মেট্রোরেল। চীনের ওই এলাকা ছিল ঘনবসতিপূর্ণ ও পাহাড়ী। ফলে মেট্রোরেল করার জন্য পর্যাপ্ত স্থান ছিল না। বিভিন্ন বহুতল ভবন ও পাহাড় কেটে মেট্রোরেলের রুট তৈরি করা হয়। এতে ট্রেন চলাচলে স্থানীয়দের শব্দদূষণ ও কম্পনের কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। ঢাকা শহরেও মেট্রোরেল নির্মাণকালে প্রকল্প এলাকায় শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে চার ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে থাকছে ২০০৬ সালের শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন মেনে চলা, শব্দের মাত্রা জাপানী আদর্শ মান তথা ৮৫ ডেসিবলের মধ্যে রাখা ও কম শব্দ উৎপন্ন হয় এমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা। পাশাপাশি নির্মাণ এলাকার চারপাশে শব্দ প্রতিবন্ধক (ব্যারিয়ার) ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। তবে মেট্রোরেলের শব্দদূষণ নিয়ে চিন্তিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের মতে, মেট্রোরেলের রুট যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভেতর দিয়ে যায়, তাহলে ক্যাম্পাসের শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হবে। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে চারুকলা, টিএসসি ও দোয়েল চত্বর এলাকা। মেট্রোরেলের শব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও দোয়েল চত্বরের পাশে বিজ্ঞান লাইব্রেরীতে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া ব্যাহত হতে পারে এবং ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যহানি হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে মেট্রোরেলের রুট পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলনে নামা এই শিক্ষার্থীরা মিছিল করে রাজু স্মারক ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করেছে। অন্যদিকে, অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রুটের পরিবহনে যাতায়াত করেন, তারা ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে মেট্রোরেলের রুট যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের যুক্তি মেট্রোরেলের রুট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে গেলে ঢাবি শিক্ষার্থীদের পরিবহন সঙ্কট ঘুচবে। এই শিক্ষার্থীরাও অপরাজেয় বাংলার সামনে মানববন্ধন করে সমাবেশ করেছে। তবে এ ধারণা সঠিক নয় বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মেট্রোরেল নির্মাণ ও পরিচালনাকালে সম্ভাব্য সব ধরনের দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনীয় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ জন্য ইআইএতে বেশকিছু সুপারিশও রয়েছে। যেমনÑ সোজা পথে মেট্রোরেলের গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার হলেও বাঁক নেয়ার জায়গায় তা ২০০ মিটার পর্যন্ত নামিয়ে আনা হবে। উন্নত প্রযুক্তির শব্দহীন ট্র্যাক ব্যবহার করা হবে। এ ছাড়া ট্র্যাকের দুই পাশে শব্দ প্রতিবন্ধক ব্যবহার করা হবে। এ প্রসঙ্গে মেট্রোরেল প্রকল্পের পরিচালক মোফাজ্জেল হোসেন জানান, মেট্রোরেলের পরিবেশগত প্রভাবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দদূষণ। খামারবাড়ি ও শাহবাগে তিনটি হাসপাতাল আছে মেট্রোরেলের পাশে। তাই ইআইএতে এ বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মেট্রোরেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়ে যাবে। তাই শিক্ষার পরিবেশকেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে যথাসম্ভব কম প্রভাবিত করেই এটি নির্মাণ করা হবে। শিক্ষার্থীদের এ জন্য চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই বলেও তিনি জানান। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এসব নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সে সময় তারা জানিয়েছে, ট্রেনের লাইনটি চল্লিশ ফুট ওপর দিয়ে যাবে এবং শব্দ ও কম্পনহীনভাবে চলাচলের বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক জানিয়েছেন, সরকার তার সুবিধা অনুযায়ী কাজ করছে। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) হস্তক্ষেপ করার প্রশ্নই ওঠে না। মেট্রোরেল হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই হবে উল্লেখ করে তিনি এই প্রকল্পকে স্বাগত জানান। এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও মেট্রোরেল প্রকল্প নিয়ে ঢাবি শিক্ষার্থীদের বিরোধিতার কড়া সমালোচনা করেছেন। ৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের নির্বাহী সংসদের বৈঠকে এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের কল্যাণ ও সুবিধার কথা চিন্তা করে আমরা মেট্রোরেল নির্মাণ করছি। অনেক জায়গার মাটি পরীক্ষা করা হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই সেখানে একটি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। আর আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে রেললাইন ছিল। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর দিয়েই ট্রেন চলেছে, তখন তো কেউ বাধা দেয়নি। এখন মেট্রোরেল যাবে ওপর দিয়ে, এখানে বাধা কেন? তিনি বলেন, হঠাৎ করেই কিছু জায়গা থেকে বিরোধিতা করে বলা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ হলে নাকি শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার ক্ষতি হবে! পড়ালেখা করতে চাইলে বাস-ট্রেনে চলতে চলতেও করা যায়। উন্নয়নে বাধা দেয়া হলে উন্নয়ন হবে কিভাবে? দেশের মানুষের স্থায়ী সমস্যার সমাধান করতেই এই মেট্রোরেল নির্মাণ করা হচ্ছে। আমি সবার প্রতি অনুরোধ করব সরকারের উন্নয়নকাজে দয়া করে বাধা দেবেন না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়াবেন না।
×