ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

শরীফা খন্দকার

এলো যে শীতের বেলা ॥ অতলান্তিকের তীরে বসে

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

এলো যে শীতের বেলা ॥ অতলান্তিকের তীরে বসে

নিউইয়র্ক নগর ও তার ট্রাইস্টেট এলাকায় এবার শীতের বছরটির চলন যেন গজেন্দ্রগামিনীর। শুধু তাই নয়, তার পরিচিত রুদ্র কঠিন রূপ জানুয়ারির এই শেষভাগেও যেন বড় বেশি প্রকাশ্য নয়। যদিও সপ্তাহ দুয়েক হলো আবহাওয়ার পারদ কখনও কখনও ছটফটিয়ে নেমে যাচ্ছে হিমাঙ্কের একেবারে নিচে। কিন্তু দু’তিনদিনের বেশি স্থায়ী না হয়ে আবার ফিরে ফিরে আসছে ওম ওম নরম পেলবতায়। গত বছরের নির্দয় শীতকালজুড়ে আমাদের চৌরাস্তার মোড়ের ফুলওয়ালী মেয়েটা পালিয়ে বেঁচেছিল, কোথায় যেন গিয়ে। তবে এবারে দেখা যায়নি এ নগর থেকে ওকে স্থায়ীভাবে পলাতক হতে। শুধু মাঝে-মধ্যে যখন অসম্ভব শীতার্ত কোনদিন ওকে আর ওর পুষ্পগুলোকে প্রগাঢ়ভাবে ছুঁয়ে যেতে চায় সেদিন তাকে দেখা যায় না। আমেরিকায় শীত প্রধান রাজ্যগুলোতে শরত ঋতু ক্যালেন্ডারের শেষ ধাপে পা ফেলার আগেই পাহাড়, সমুদ্র, নদী থেকে বয়ে আসতে থাকে হিম হিম বাতাস। আর সেই বাতাসের স্পর্শেই ঘটে যেতে থাকে একটু একটু করে পত্র-পল্লব দলের অঝোরে ঝরে যাওয়ার পালা। অথচ তখন লাল, হলুদ, গোলাপি, মেরুন কত অপরূপ রঙে রাঙ্গা হয়ে ওঠে যে বন-বনান্তরের সবুজ পাতা। বৃক্ষপল্লব দলের সঙ্গে লতাগুল্ম অবধি প্রকৃতির যত সবুজ সবাই যেন গায় ‘রাঙিয়ে দিয়ে যাও গো আমায় যাবার আগে।’ কিন্তু এর স্থায়িত্ব হয় অতি স্বল্প সময়ের জন্য। সপ্তাহ দুয়ের মধ্যেই ঈর্ষাকাতর মুঠো মুঠো দামাল হাওয়া প্রকৃতির বর্ণিল বসন ছিন্ন-ভিন্ন করে তরণি ভাসাতে থাকে নদী সমুদ্রের কূলে কূলে। ফাগুয়ার এমন নয়ন মনোহরোৎসব হয়ে যায় ক্ষণিকের এক সৌন্দর্য মাত্র। এদেশে শরত ঋতুর নাম ‘ফল সিজন’-ঝরার কাল। রাশি রাশি সেই ঝরে পড়া পাতার ওপর দিয়ে শীত বুড়ি ছোটায় তার রথ। সেই সুবিশাল যাত্রাপথে প্রকৃতি আর ফোটায় না কোন ফুল, ফল ধরে না গাছে গাছে। আকাশের পাখিরাও বসতি বাঁধে কাঠবিড়ালীর মতো ক্ষুদ্র কোটরে। আর বিশাল ডানা মেলে পরিযায়ী হয়ে কেউবা উড়ে যায় সুদূরের উষ্ণ দেশে। শীতের বরফে জমে যেতে যেতে অতলান্তিকের তীরভূমি অভিশপ্ত রাজকন্যার মতো হু হু সুর তুলতে থাকে যেন কান্নার। নবেম্বরের শেষে থ্যাঙ্কস গিভিং পরবের বাঁশি বাজলেই হলিডে সিজন ও সেইসঙ্গে এমনতর শীতার্ত সময় এসে পড়ে যুগপৎ। চোখ ঝলসানো রঙ আর আলোর জৌলুসে যখন অপ্সরি হয়ে যায় শহর নগর তখন ক্রিসমাস ও নিউ ইয়ার আসবে হাড় কাঁপানো শীত ও দিগি¦দিক আচ্ছন্ন করা তুষার নিয়ে। কিন্তু ‘ইহাতে আসে যায় বল কার’- ডিসেম্বর ও জানুয়ারির শীতটাই জমিয়ে তোলে মানুষের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিন। হোয়াইট ক্রিসমাস অর্থাৎ তুষার আবৃত বড়দিনের জন্যই বছরভর ফিঙ্গার ক্রস করে থাকে অজস্র মানুষ। সে রাতে শহরের প্রাচীন গির্জার চুড়োগুলো শুধু নয়, দূরান্তরের প্রকৃতিতে তুষারপাত হবে অবিরাম। কাচের বাতায়নে ঝিরঝির শব্দে নাচবে হাজার তুষারকন্যার দল আলোকসজ্জিত বাড়িগুলো থেকে ভেসে আসবে গানের সুর ‘লেট ইট স্নো... লেট ইট স্নো।’ তবে আমাদের নগরে গত ডিসেম্বরে এমন গান গাইবার জন্য তুষার তো তুষার বলতে গেলে শীতের ঠা-ায় কোন রকম তীব্রতা ছিল না। শুধু তাই নয়, এবারের ২৫ ডিসেম্বরের দিন ভঙ্গ করেছে এযাবতকালের উষ্ণতার রেকর্ডটাও। গরমের দেশ থেকে আগত আমরা যারা তারা ছিলাম খুবই পুলকিত- কামনা করছিলাম শীতটা যদি এমনি নরম থাকত। কিন্তু এদেশের প্রবাদ বাক্যেই তো আছে তিন ডব্লিউ-ওয়ার্ক, ওম্যান (!) ও ওয়েদার নিয়ে কোন আগাম কথা বলা চলে না। তার সত্যটি ধরা পড়ল যখন আচমকাই শীত আছড়ে পড়ল হলিডের শেষপর্ব নিউ ইয়ারের পাদপ্রদীপের তলায়। কিন্তু এ বছর নিউ ইয়ারের অনুষ্ঠানে আগত জনস্রোতকে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে হয়নি। নগরীর লোকে লোকারণ্য টাইমস স্কোয়ারের খোলা আকাশের নিচে উল্লাসমুখর অনেক মানুষ কোন কোন বছর ঠা-ার তীক্ষè শেলে লুটিয়ে জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে যায়। বিপদ-আপদ দূরে রেখে মহাধুমধামে নগর নিউইয়র্ক সেলিব্রেশন করেছে জগত বিখ্যাত নিউ ইয়ার। উৎসবকালটির অবশেষে সমাপন ঘটে গেছে, নতুন বছর শুরুর প্রথম মাসটিও গত হতে চলল প্রায়- শীত প্রায়শই হানা দিয়ে যায় নগর জীবনে। টিভিতে কিছু ছবি আসে স্নো ফলের দূর দূর রাজ্য থেকে। কানাডার অটোয়া থেকে ফোন এলো ক’দিন আগে, সেখানে সেদিন নাকি তুষারে মুখরিত। কিন্তু যখন মার্টিন লুথার কিংয়ের লম্বা উইক এন্ডে লেখাটি শেষ করছি প্রায় তখন পর্যন্ত আমার এ নগরে হাস্যরত কোন খুদে বালিকার জিভের ডগায় ঝরে পড়েনি স্নো ফ্লেক্স। তবে আবহাওয়াবিদগণ এই বলে ফোরকাস্ট করছেন স্নো আসছে নিউইয়র্ক সিটিতে সহসাই। শেষ মুহূর্তে রবিবারের বিকেলটাতে জানালা দিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখি ঝরছে তুষার- ঠিক স্নো নয় ওটাকে বলে ফ্লোরিজ! পেজা তুলোর মতো হাল্কা তুষারের কণা। লেখক : কলামিস্ট, নিউইয়র্ক প্রবাসী। ংযধৎরভধ.শ@মসধরষ.পড়স
×