ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

বাংলাদেশ খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না

গত সপ্তাহে আমি কলামে বলেছিলাম অন্তত আরও দুই টার্ম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা দরকার। শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনা করুন মানুষ তা-ই কামনা করে। জনগণ কতগুলো যৌক্তিক কারণে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। দৈনিক জনকণ্ঠে লেখাটি ছাপা হওয়ার পর অনেকেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক যেমন ছিল তেমনি কিছু নেতিবাচক। যারা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তারাও কোন গ্রহণযোগ্য যুক্তি দেখাতে পারেননি। তাঁরা যে যুক্তিটি সবার আগে দেখাতে চান তা হলো- বর্তমান সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নন। বিগত ২০১৪-এর নির্বাচনে বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোট অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় আছে। পার্লামেন্টের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ জনই নির্বাচিত হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। কাজেই বর্তমান পার্লামেন্ট এবং সরকারের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ (?) তাদের এ যুক্তির সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া এবং মির্জা ফখরুলের একপেশে যুক্তির যথেষ্ট মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। যেহেতু প্রতিক্রিয়াটি আমার লেখার ওপর, তাই জবাব খুঁজতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। আমরা কেন যে একটা ব্যাপার ভুলে যাই, খালেদা জিয়া বা ২০ দলের অংশগ্রহণ না করার জন্য ওই নির্বাচনের পরিচালনাকারী নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করা যাবে কি? এ প্রশ্নের সোজা উত্তর হলো দায়ী করা যাবে না। কারণ খালেদা জিয়া বা তার জোটকে নির্বাচনে অংশ নিতে কেউ বাধা দেয়নি। না নির্বাচন কমিশন না সরকার। তারা নিজেরাই স্বেচ্ছা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল। মইন উ আহমদ এবং ফখরুদ্দীন আহমদকে যত স্বৈরাচার বলি না কেন, তারা অনেক ভাল কাজের মধ্যে একটা কাজ অন্তত করেছেন খালেদার নেতৃত্বে জামায়াত-শিবির নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য যে এক কোটি ২৪ লাখ ভুয়া ভোটার তালিকাভুক্ত করেছিল, তা বাতিল করে দেন। যে কারণে খালেদা জিয়া ২০০৮-এর ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে চরমভাবে ধরা খায়। এমন ধরা খেয়েছিল যে বিএনপি জামায়াত-শিবিরের পর্যায়ে নেমে যেতে হয়েছিল। যে কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনেও অংশ নিয়ে লাভ হবে না ভেবে আগে থেকে, অর্থাৎ ২০১৩ সালব্যাপী জ্বালাও পোড়াও এবং পুলিশসহ সাধারণ মানুষ হত্যা করে নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করে। তাতেও কোন সুফল ঘরে তুলতে পারেনি। বরং শেখ হাসিনার মেধা, দূরদর্শিতা এবং অসম সাহসী ভূমিকার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। যথারীতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট নির্বাচনে অংশ নেয় এবং শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ওই নির্বাচনের বছর পূর্তিতেও ২০১৫-র ৫ জানুয়ারিতে পুনরায় একই পথে খালেদা জিয়া নাশকতার আশ্রয় নেন। এবার নিজে গুলশান কার্যালয়ে স্বেচ্ছা অবরোধ রচনা করেন। এ সময় শিবির এবং শিবিরাশ্রয়ী ছাত্রদল-যুবদলের হাতে পেট্রোলবোমা তুলে দেয়া হয়। একনাগাড়ে ৯২ দিন সন্ত্রাসীরা পেট্রোলবোমা মেরে দেড় শতাধিক নিরীহ মানুষ, ছাত্র, শ্রমজীবী নারী-পুরুষ হত্যা করে। যাত্রীবাহী ট্রেন, বাস, টেম্পো, অটোরিক্সা, রিক্সা কোন যানবাহনই তাদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এমনকি বাকহীন নিরীহ প্রাণী গরুবাহী ট্রাক পর্যন্ত জ্বালিয়ে অঙ্গার করা হয়। কয়েকদিন আগে দৈনিক জনকণ্ঠে পুনরায় প্রকাশিত পেট্রোলবোমায় সারাশরীর ঝলসে যাওয়া কন্যা শিশুটির কথা আমরা কি করে ভুলব। বাংলার মানুষ কি করে ভুলবে সেই কাভার্ডভ্যান চালকের কিশোর ছেলে মনিরের কথা? ঢাকা শহর দেখতে আসছিল বাবার পাশে বসে। খালেদা জিয়ার পেট্রোলবোমায় পুড়ে অঙ্গার হয়ে বসেছিল স্ট্যাচুর মতো, পাশে মাথায় হাত দিয়ে বাবা নির্বাক। বাংলাদেশ কিভাবে ভুলবে ২০১৩ সালের ৫ মের শাপলা চত্বরের হেফাজতী তা-বের কথা। পুরো মতিঝিল, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ, জিপিও, পুরানা পল্টন, বিজয়নগর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে কি ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল? কিভাবে ভুলবে বাংলাদেশ সেই ধ্বংসযজ্ঞের সহায়তাকারী খালেদা জিয়ার কথা। দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হেফাজতীদের সহায়তাদানের জন্য। এসব কি ভোলা যায়? এই গেল একদিক। আরেকদিক হলো ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে নেয়ার জন্য শেখ হাসিনা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন। খালেদা জিয়া শোনেননি। তিনি যে আপোসহীন নেত্রী (?), তাই শেখ হাসিনার আহ্বান, টেলিফোন, বাড়িতে শাক-ডাল-ভাতের দাওয়াত কোন প্রচেষ্টাতেই সাড়া দেননি। আসলে কোন ইস্যুতে আপোসহীন হতে হবে, কোন ইস্যুতে হতে হবে না, সম্ভবত এই জ্ঞানটি তার মধ্যে কম আছে। নইলে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলের মৃত্যু হলে যেদিন সমবেদনা জানাতে তার স্বেচ্ছা অবরুদ্ধ কার্যালয়ে গেলেন সেদিন শেখ হাসিনাকে অপমান করে ফিরিয়ে না দিয়ে যদি বাড়ির ভেতরে আমন্ত্রণ জানাতেন তাহলে হয়ত পানি অত দূর গড়াত না। এই জায়গাটাতে বলতে হয় এত কিছুর পরও শেখ হাসিনা যেমন ২০১৩-এর সন্ত্রাস দমন করে নির্বাচনের সুফল ঘরে তুলেছিলেন এবং ২০১৫-র ৫ জানুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার পেট্রোলবোমা দৃঢ় চিত্তে মোকাবেলা করেছেন এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দেখিয়ে পেট্রোলবোমার লেবেলটা খালেদা জিয়ার গায়ে লাগিয়ে দিতে পেরেছেন, এখানেই শেখ হাসিনা অদ্বিতীয়া এবং চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ বা ধরিত্রীর আদরের কন্যা। এ কারণেই বাংলাদেশ অন্তত আরও দুই টার্ম শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। অপরদিক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদদের মৃত্যুদ- কার্যকর করার ক্ষেত্রে অনেক বড় রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যথারীতি কার্যকর করা। কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান থেকে শুরু করে অদ্যাবধি এত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করা এবং মতিউর রহমান নিজামীসহ দেড় ডজনের মতো যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন করা, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে কি আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বা সুপ্রীমকোর্ট স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারতেন? পারতেন না। মনে করুন খালেদা জিয়া ক্ষমতায়। তিনি কি তার মন্ত্রী নিজামী, মুজাহিদের বিচার করতে পারতেন? পারতেন না। বিচার শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে খালেদা জিয়া কি বলেননি বিচারাধীনরা যুদ্ধাপরাধী নয়? বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তিনি কি বলেননি, ক্ষমতায় গেলে ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দেবেন। উপরন্তু সাকা চৌধুরীর মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার সময় যখন পাকিস্তান বলল তাদের মিলিটারি একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যা চালায়নি, নারী নির্যাতন করেনি, ঠিক তার পরপরই খালেদা জিয়া শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করলেন। একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদ ও পাঁচ লক্ষাধিক মা-বোন নির্যাতিত হয়েছিলেন, এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এটি সেটেল্ড ইস্যু। একে বিতর্কিত করে প্রমাণ করলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা চাননি এখনও পাকিস্তানেই আছেন। এসব কারণেই বাংলার জনগণ খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। জনগণ ক্ষমতায় দেখতে চায় শেখ হাসিনাকে। কেবল বাংলাদেশের জনগণ নয়, বিশ্ববাসীও তাই চান। এরই মধ্যে যে কারণে সাহসী এবং ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাশিয়ার ভøাদিমির পুতিন, জার্মানির এঙ্গেলা মের্কেলের কাতারে তার নাম উঠে এসেছে। এমনি এমনি আসেনি। একটি দুটি নয়, বিশ্বের এক ডজনেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দামী দামী এ্যাওয়ার্ড, এসব কোন তদবিরে হয় না, এর জন্য মেধাভিত্তিক যোগ্যতা লাগে। শেখ হাসিনার সে যোগ্যতা আছে বলেই তাকে সম্মানিত করা হয়েছে। এখানেই প্রশ্ন জাগে, খালেদা জিয়াও তিনবারের ১০ বছর দেড় মাস ক্ষমতায় ছিলেন। কই কোন একটি প্রতিষ্ঠান তো একটি পুরস্কারও তাকে দেয়নি। কেন? তারা পুরস্কার দেবার মতো একটি যোগ্যতাও তার মধ্যে খুঁজে পায়নি বলেই কি? শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকা দরকার কতগুলো কারণে, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রয়োজনে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি বৈরী পরিবেশে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পান- তাও ২১ বছর পর। অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ৫ বছর, ২০০৮ সালে ৫ বছর এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে অদ্যাবধি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছেন। আমেরিকার একজন স্মার্ট কালো মানুষ জেসি জ্যাকসন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে গোটা আমেরিকা কাঁপিয়ে তুলেছিলেন। যদিও তিনি দলীয় নমিনেশনই পাননি। তবু তাঁর একটি বাণী আজও সচেতন মার্কিনীদের মুখে মুখে। বলা যায় বিশ্বব্যাপী। তিনি বলেছিলেন- ‘আমি একটি স্বপ্ন দেখি... (ও যধাব ধ ফৎবধস...)’। যদ্দুর বুঝতে পেরেছি তার সেই স্বপ্ন ছিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মানবতাবাদের জয়। শেখ হাসিনাও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশের মাটিতে পা রেখে বলেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু সারাজীবন গরিব-দুঃখী মানুষের জন্যে সংগ্রাম করেছেন। আমার জীবনের লক্ষ্যও হলো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।’ সেই থেকে শুরু করে আজ অব্দি যত সব বড় অর্জন বাংলার ঘরে ঘরে তুলে দিয়েছেন, যা লিখতে হলে সিরিয়াল করতে হবে। সংক্ষেপে শুধু বলব ৪৪ বছর পর ভারতের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ; খাদ্য উৎপাদন ৪ কোটি টনে উন্নীত করা; শিক্ষার হার ৭১%; গড় আয়ু ৭০ বছর, মাথাপিছু আয় ৭ বছর ধরে ৬+ ধরে রাখা; বিদ্যুত উৎপাদন ১৪০০০ (চৌদ্দ হাজার) মেগাওয়াট; ঢাকায় ফ্লাইওয়ার মেট্রোরেল ও কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল এবং সর্বোপরি বিশ্বব্যাংককে পাত্তা না দিয়ে নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু এবং এরই মধ্যে ৩২% কাজ সম্পন্ন করা; মুদ্রাস্ফীতি আটকে রাখা; এ সবের সুফল এখন বাংলার জনগণ ভোগ করছেন। পক্ষান্তরে খালেদা জিয়ার এমনি একটি উদাহরণও দেখাতে পারবেন না। তার স্বামী মিলিটারি জিয়ারও না, এরশাদেরও না। এসব কারণেই জনগণ শেখ হাসিনাকেই ক্ষমতায় দেখতে চায়। খালেদা জিয়াকে না। ঢাকা ॥ ২২ জানুয়ারি ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব
×