ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অর্ধশতাধিক ঘর পুড়ে ছাই ;###;উচ্ছেদ অভিযান, আদালতের নিষেধাজ্ঞা, অতঃপর অগ্নিকাণ্ড

কল্যাণপুর পোড়াবস্তিতে প্রভাবশালীদের ইশারায় আগুন দিল দুর্বৃত্তরা

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

কল্যাণপুর পোড়াবস্তিতে প্রভাবশালীদের ইশারায় আগুন দিল দুর্বৃত্তরা

আজাদ সুলায়মান ॥ আগের দিন কল্যাণপুর পোড়া বস্তি উচ্ছেদ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় পূর্ত বিভাগ। বস্তিবাসী আদালতে গিয়ে ঠেকিয়ে দেয় উচ্ছেদ অভিযান। কিন্তু পরদিন শুক্রবার সকালেই তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। আগুন লাগিয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি দুর্বৃত্তরা আগুন যাতে সহজে না নেভানো যায়- সে জন্য বাধা দেয়া হয় দমকল বাহিনীকে। শেষ পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হলেও ততক্ষণে পুড়ে ছাই অনেকগুলো ঘর। এই ছিল শুক্রবার সকালে রাজধানীর কল্যাণপুর নতুনবাজার এলাকায় পোড়াবস্তির চিত্র। প্রশ্ন উঠেছে কারা লাগিয়েছে এই আগুন? শুক্রবার সকালে কল্যাণপুর নতুন বাজার সংলগ্ন এই বস্তিটি এমনিতেই পরিচিত পোড়া বস্তি হিসেবে। নব্বই দশকের শুরুতে অনেক চাঞ্চল্যকর অপরাধ, ঘটনা, দুর্ঘটনা ও অগ্নিকা-ের নীরব সাক্ষী এ পোড়া বস্তির কপালই যেন পোড়া। বার রাজনীতি হচ্ছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় সেই সরকারের প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে এই পোড়া বস্তির ওপর। যেন এরই ধারাবাহিতকায় শুক্রবার আবারও লাগানো হয় আগুন। নতুন বাজারে বসে কথা হচ্ছিল এখানকার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা ও স্থানীয় সাংবাদিক সোহাগের সঙ্গে। বললেন, পোড়া বস্তির কপালই পোড়া। নইলে বার বার কেন এখানে আগুন লাগানো হয়। একই মন্তব্য করলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় ওয়ার্ড কমিশনার দেওয়ান মান্নান। বললেন, সব সরকারের সময়ে কিছু অতি উৎসাহী নেতাকর্মী থাকে। তারাই এ ধরনের অপকর্ম করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করে। তাতে দেখা যায় সরকারেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়। নইলে শুক্রবার পবিত্র দিন এমন জঘন্য কাজ কোন সভ্য ও বিবেকবান মানুষের পক্ষে করা কি সম্ভব? এখানকার বস্তিবাসীদের কোথাও পুনর্বাসন না করে এভাবে আকস্মিক উচ্ছেদ অভিযান চালানোটাও অমানবিক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান-শুক্রবার সকাল দশটার দিকে ওই বস্তিতে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের দুইটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে বেলা ১২টার দিকে প্রায় দুই ঘণ্টা পর এই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। সরজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়-কল্যাণপুর নতুনবাজার এলাকায় পোড়াবস্তির আট নম্বর অংশে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে। এতে ৬০-৭০ বাড়ি পুড়ে যায়। সকাল ১০টার দিকে স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার ৮-১০ জন কর্মী মাথায় লাল ফিতা বেঁধে এই অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটায়। অগ্নিকা-ের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রত্যক্ষদর্শী পোড়াবস্তির বাসিন্দা আয়েশা বেগম (৪০) জানান, সকালে কয়েকজন ব্যক্তি অতর্কিতভাবে তার ঘুরে ঢুকে। তাদের এভাবে ঘুরে ঢোকার কারণ জানতে চাইলে, তারা আয়েশাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। পরে সেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় বস্তির ৬০ থেকে ৭০টি ঘর পুড়ে গেছে বলেও দাবি করেন বস্তিবাসী নুরুল হক (৩৫)। মনোয়ারা নামের এক গৃহবধূ বলেন, আগুন লাগার পর কয়েক দফা ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়া হলেও তারা আসতে অনেক দেরি করেছে। সরকার দলীয় লোকজন মিরপুর বাংলা কলেজ ও হাউজিং এ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সামনে এবং বস্তিতে ঢোকার মুখে ফায়ারের গাড়িকে বাধা দিয়েছে। সকালে আগুন লাগার পর বস্তিবাসী ডোবা থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, দমকল বাহিনীর সদস্যরা আরও আগে ঘটনাস্থলে এলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হতো। এ সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর থানার পরিদর্শক শফিক বলেন, ‘কারা আগুন লাগিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর আগের দিন বৃহস্পতিবার টানা পাঁচ ঘণ্টা উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর অভিযান কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। উচ্ছেদ কার্যক্রমে আদালত তিন মাসের স্থগিতাদেশ দেয়ার চার ঘণ্টা পর এ অভিযান বন্ধ হলো। আগের দিন উচ্ছেদ শুরুর পর বস্তিবাসীর পক্ষের আইনজীবী এ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, উচ্ছেদ করতে আসা ওই ১৮ কাঠা জমির ওপর আদালতের ‘স্টে অর্ডার’ ছিল। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট এ অর্ডার অমান্য করে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছেন। অন্যদিকে কোন রকম পূর্ব ঘোষণা বা নোটিস ছাড়াই উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয় বলে অভিযোগ করেন বস্তিবাসী। ম্যাজিস্ট্রেট নুর আলম সে সময় বলেছিলেন, বার বার নোটিস করেছিলাম, তারপরও তারা সরে যায়নি। ফলে সমস্ত আইনী পপ্রক্রিয়া শেষ করেই অভিযান চালাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, এখানে ৫০ একর জমির মধ্যে ১৫ একর জমির ওপর ‘স্টে অর্ডার’ ছিল। উল্লেখ্য, কল্যাণপুরে হাউজিং এ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বেদখল জমি উদ্ধারে এই বস্তির একটি অংশে বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ অভিযান চালায় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। সে সময় বস্তিবাসীর সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া পাল্টাধাওয়া হয়। বস্তির এক-চতুর্থাংশ উচ্ছেদের পর হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞায় দুপুরে ওই অভিযান বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই বস্তির অন্য মাথায় বেলতলী মাঠ এলাকার আট নম্বর বস্তিতে এই অগ্নিকা- ঘটে শুক্রবার। হাউজিং এ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মালিকানায় থাকা প্রায় ৫০ একর ওই জমির মধ্যে ১৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বস্তি। বেশ কয়েক বছর আগে একবার আগুন লাগায় এর নাম হয়ে যায় পোড়া বস্তি। সেখানে কয়েক হাজার ঘরে অন্তত ২২ হাজার মানুষ এতদিন বসবাস করে আসছিল। ২০০৩ সালে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ওই জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে আদালতের স্থগিতাদেশ আসে। এরপর আরও দুই দফর সেই উদ্যোগ নেয়া হলেও আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ কয়েকটি বেসরকারী সংগঠনের চেষ্টায় তা আটকে যায়। এরপর সর্বশেষ বৃহস্পতিবার সকালে আবারও বস্তি উচ্ছেদের চেষ্টা চালান হলে দেখা দেয় সংঘর্ষ। এরপর দুপুরে বস্তি উচ্ছেদ কার্যক্রমে তিন মাসের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক আবেদনের শুনানি নিয়ে এ নিষেধাজ্ঞা দেন বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ। পাশাপাশি যথাযথ আইনী প্রক্রিয়া ছাড়া ওই বস্তি উচ্ছেদ ও বস্তির বাসিন্দাদের হয়রানি না করতেও নির্দেশ দেন হাইকোট।
×