ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রকৃত চালকদের বাদ দেয়ার চেষ্টা প্রভাবশালীরা জড়িত

ঢাকায় ৫ হাজার অটোরিক্সা নামানোর সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখল না ॥ নানা জটিলতায় কেটে গেল আট বছর

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬

ঢাকায় ৫ হাজার অটোরিক্সা নামানোর সিদ্ধান্ত আলোর মুখ দেখল না ॥ নানা জটিলতায় কেটে গেল আট বছর

রাজন ভট্টাচার্য ॥ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আট বছর ধরে আটকে আছে থ্রি হুইলারের পরিবর্তে সিএনজি অটোরিক্সা নামানোর প্রক্রিয়া। রাজধানীতে প্রকৃত চালকদের মধ্যে পাঁচ হাজার অটোরিক্সা নামানোর সিদ্ধান্ত হয় ২০০৭ সালে। মূলত গণপরিবহন সঙ্কট কমাতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। উচ্চ আদালতে এ সংক্রান্ত একাধিক মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে দু’বছর আগে। পরবর্তিতে অটোরিক্সা চালক সমবায় ফেডারেশন লিমিটেডের নামে ২৭ কোটি টাকা ব্যাংক লোনের কারণ দেখিয়ে পুরো প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু অটোরিক্সার আবেদনকারীদের বেশিরভাগই এই লোনের আওতার বাইরে ছিলেন। পরিবহন মালিক সমিতি, মন্ত্রণালয়-বিআরটিএ কর্মকর্তাদের গাফিলতি থেকে শুরু করে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বিষয়টি আবারও ধামাচাপা পড়ে। প্রকৃত চালকদের বাদ দিয়ে অটোরিক্সা দেয়ায় তৎপর হয় একটি চক্র। সর্বশেষ প্রায় দুই হাজার অটোরিক্সা নামানোর প্রক্রিয়া দ্রুতই শুরু হবে এমন আশার কথা শুনিয়েছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কর্তৃপক্ষ। গাড়ি নামাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ॥ অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় অটোরিক্সা নামানো সম্ভব হচ্ছে না। এর নেপথ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও পরিবহন মালিক সমিতির কারসাজি ও মন্ত্রণালয়ের গাফিলতিকেই দায়ী করা হচ্ছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালের ৬ নবেম্বর ঢাকা মহানগরীর পরিবহন সঙ্কট সমাধানে পাঁচ হাজার সিএনজিচালিত অটোরিক্সা নামানোর সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। নগরীতে বসবাসরত বৈধ থ্রি হুইলার লাইসেন্সধারী অটোরিক্সা চালকদের মধ্যে নতুন গাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিল। সিদ্ধান্তের আলোকে ২০০৮ সালের ১৯ জুলাই জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ। তিন হাজার ১৯৬ জনের আবেদন বৈধ হয়। কিন্তু সরকারী এ সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। উচ্চ আদালত রিট আবেদন খারিজ করে সরকারী সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। মালিক সমিতির পক্ষ থেকে লিভ টু আপীল করা হয়। সুপ্রীমকোর্ট শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। এরপর আরেকটি সংগঠনের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করা হয়। একপর্যায়ে ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে অটোরিক্সা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। শর্ত অনুযায়ী ঢাকা অটোরিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন যথারীতি লিভ টু আপীল প্রত্যাহার করে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বরাবর সার্টিফিকেট কপি দাখিল করে। এরপর পেরিয়ে গেছে দুই বছর। অটোরিক্সা নামানোর উদ্যোগ সফল হয়নি। ২০০২ সালে চারদলীয় জোট সরকারের সময় পরিবেশ দূষণের অজুহাতে ঢাকা মহানগরী থেকে ২৭ হাজার টু স্ট্রোক থ্রি হুইলার অটোরিক্সা উচ্ছেদ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ১২ হাজার ৭১৫টি অটোরিক্সা রেজিস্ট্রেশন দেয়া হয়। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, হাইকোর্টের দায়েরকৃত রিট পিটিশন প্রত্যাহার হওয়ায় ঢাকায় সিএনজি প্রতিস্থাপনে আর কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। তাই নতুন করে ঢাকা মহানগরীতে ৫ হাজার এবং চট্টগ্রাম মহানগরীতে ৪ হাজার অতিরিক্ত ফোর স্ট্রোক থ্রি হুইলার সিএনজি সংযুক্ত করা হবে। অটোরিক্সা নামানোর জটিলতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর অটোরিক্সা ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন জনকণ্ঠকে বলেন, পাঁচ হাজার অটোরিক্সা নামানোর ক্ষেত্রে আইনগত কোন জটিলতা নেই। আমতান্ত্রিক জটিলতার মূল বাধা বলে মনে করেন তিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনী জটিলতা শেষে অটোরিক্সা নামানোর জন্য আবেদন আহ্বান করে বিআরটিএ। এতে তিন হাজার ১৯৩টি আবেদনপত্র জমা পড়ে। কিন্তু ‘অটোরিক্সা চালক সমবায় ফেডারেশন লিমিটেড’-এর কাছে ১৯৯১-৯৪ সালের মেয়াদে ৩২ কোটি টাকা ব্যাংক লোন নেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৯ কোটি ৭৬ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়। বাকি টাকা না দেয়ায় পুরো প্রক্রিয়াটি স্থগিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সঙ্কট সমাধানে অটোরিক্সা মালিক শ্রমিকদের পক্ষ থেকে লোন খেলাপীদের বাদ দিয়ে বাকি অটোরিক্সা রেজিস্ট্রেশনের জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে ইতিবাচক সম্মতি দিয়ে চিঠি দিয়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল আলম খসরু জনকণ্ঠকে বলেন, চালকদের অটোরিক্সা দেয়ার বিষয়টি সরকারের সদিচ্ছার অভাবে আটকে আছে। মন্ত্রণালয় বিআরটিএকে নির্দেশ দিলেই নতুন অটোরিক্সা রাস্তায় নামতে পারে বলে জানান তিনি। বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০১ সালের পর অটোটেম্পোর বিপরীতে অটোরিক্সা নামানোর সময় প্রকৃত চালক ও মালিকরা বঞ্চিত হয়েছেন। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পরিবহন সেক্টরের সিন্ডিকেট চক্রের কারণে এবারও প্রকৃত চালকরা হয়ত মিশুকের পরিবর্তে অটোরিক্সা পাবেন না। এজন্য বিআরটিএ কর্মপরিকল্পনার অভাবকেই দায়ী করছেন তিনি। বিশিষ্ট এই শ্রমিক নেতা বলেন, পরিবহন সেক্টরে বেকার সমস্যা বাড়ায় সমাজিক অপরাধ বাড়ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন দীর্ঘদিন আইনী জটিলতার মধ্যে ছিল। মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে স্বস্তি ফিরবে। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন আরও বেগবান হবে বলে মনে করেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য ॥ উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকারী অর্থ আদায় ও সিএনজি অটোরিক্সা বিলিবণ্টন বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের পক্ষ থেকে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে লিখিত মতামত পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোঃ ইয়াসীন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়Ñ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী পাঁচ হাজার সিএনজি থ্রি হুইলার অটোরিক্সা বিলিবণ্টন বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে সিএনজি থ্রি হুইলার অটোরিক্সা বণ্টনের জন্য প্রস্তাবিত কমিটিতে অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্তকরণের কোন অবকাশ নেই। এ সংক্রান্ত যাবতীয় পাওনা আদায়ের জন্য প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। আশার কথা শুনাল বিআরটিএ ॥ পরিবহন সঙ্কট সমাধানে রাজধানীতে অটোরিক্সা নামানো প্রসঙ্গে বিআরটিএ সচিব শওকত আলী জনকণ্ঠকে বলেন, থ্রি হুইলারের পরিবর্তে অটোরিক্সার জন্য চালকদের কাছ থেকে তিন হাজার ৫৯৬টি আবেদন জমা পড়েছিল। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৯৬টি আবেদনের মধ্যে মালিকরাও থাকায় জটিলতা দেখা দেয়। তাছাড়া আদালতে মামলার বিষয়টিতো ছিলই। সর্বশেষ যাচাই বাছাইয়ের পর চালকদের মধ্যে অটোরিক্সা দিতে গিয়ে দেখা গেল বহুমুখী সমবায় সমিতির নামে ২৭ কোটি টাকা ব্যাংক লোনের বিষয়টি। এ নিয়ে নতুন করে জটিলতা বাধে। লোন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিষয়টি আটকে যায়। যে কারণে এ বিষয়ে আর অগ্রগতি হয়নি। তখন শ্রমিক ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, লোনের বাইরের প্রায় দুই হাজার আবেদন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করার। গত সপ্তাহে মন্ত্রণালয় থেকে বিআরটিএ’র কাছে একটি চিঠি আসে। চিঠিতে বলা হয়Ñ এ সংক্রান্ত বিষয়ে আর কোন মামলা না থাকলে প্রকৃত চালকদের মধ্যে এক হাজার ৮০০ অটোরিক্সা দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। আমরা খোঁজখবর নিয়ে বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে জানাব। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যে শ্রমিক ফেডারেশনের দাবির প্রেক্ষিতে এক হাজার ৮০০ অটোরিক্সা প্রকৃত চালকদের দেয়া হবে।
×