ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঝুঁকির মাত্রা বেড়েই চলেছে

৮১ ভাগ সংগৃহীত রক্তের অনুমোদন নেই পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

৮১ ভাগ সংগৃহীত রক্তের অনুমোদন নেই পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের

নিখিল মানখিন ॥ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোতে সংগৃহীত রক্তে ঝুঁকিপূর্ণ রক্তের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ পরিসংখ্যানে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোতে সংগৃহীত প্রায় আটচল্লিশ হাজার ইউনিট রক্তে নানা জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে। রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি, সিফিলিস ও ম্যালেরিয়া। এর আগে এমন রক্তের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৪৫ হাজার ইউনিট। এবার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় তিন হাজার ইউনিট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের কারণে একজনের জটিল রোগ আরেকজনের শরীরে সংক্রমণের ঘটনা ঘটছে। রক্তদান একটি মহৎ সেবা। কিন্তু অনিরাপদ রক্তই আবার মানুষের অকাল মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। দেশের শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র অনুমোদনহীন। রক্ত সংগ্রহের সময় বাধ্যতামূলক পাঁচটি পরিসঞ্চালন সংক্রমণ পরীক্ষা করা হয় না শতকরা ৫০ ভাগ কেন্দ্রে। গত তিন বছরে সারাদেশে ইতোমধ্যে আড়াই শতাধিক অনিরাপদ ও ভুয়া ব্লাড ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। জব্দ করা হয়েছে কয়েক হাজার ইউনিট অনিরাপদ রক্ত। হেলথ বুলেটিন-২০১৫ এ বলা হয়েছে, গত ২০১৩ সালে ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৪ ইউনিট রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৪০ ইউনিটে এইচআইভি পজিটিভ, ৩৬ হাজার ২৯১ ইউনিটে হেপাটাইটিস বি পজিটিভ, ৪ হাজার ৭০৬ ইউনিটে হেপাটাইটিস সি পজিটিভ, ৩ হাজার ৯৫০ ইউনিটে সিফিলিস ও ১ হাজার ৩৪৪ ইউনিট রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু ধরা পড়ে। তবে বেসরকারী হিসাবে দূষিত রক্তের পরিমাণ আরও কয়েকগুণ বেশি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বুলেটিনে বলা হয়, গত ২০১১ সালে ৬ হাজার ৫৪১ ইউনিট এবং ২০১২ সালে ৬ হাজার ৪৮৪ ইউনিট রক্তে নানা জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়। গত ২০১৩ সালে হঠাৎ করে ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত রক্তের পরিমাণ বেড়ে ৪৬ হাজার ৫৯১ ইউনিটে দাঁড়ায়, যা ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি। আর ২০১৪ সালে এমন রক্তের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫ হাজার ইউনিট। এভাবে গত ২০১৪ সালেও প্রায় ৪৮ হাজার ইউনিট রক্তে বিভিন্ন জটিল রোগের জীবাণু শনাক্ত হয়েছে জানা গেছে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান সরকার চিকিৎসার মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রক্ত দান একটি মহৎ সেবা। রক্তের প্রয়োজনে জীবাণু মুক্ত নিরাপদ রক্তই রোগীকে নতুন জীবন দিতে পারে। নিরাপদ রক্ত মুমূর্ষু রোগীকে দেবে নবজীবন। তবে রক্ত যেমন একদিকে জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ছড়ায়। এসব জটিল রোগ থেকে নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হচ্ছে পেশাদার রক্তদাতা থেকে রক্ত গ্রহণে বিরত থাকা এবং স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের থেকে রক্ত গ্রহণ করা। সারা বিশ্বে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন গড়ে তোলা দরকার । বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডীন অধ্যাপক ডাঃ এবিএম আব্দুল্লাহ জানান, প্রতি চার মাস অন্তর একজন সুস্থ ব্যক্তি রক্ত দান করতে পারে। স্বেচ্ছায় রক্তদান সর্বোত্তম সেবা। স্বেচ্ছায় রক্তদান করলে বারডেমের পক্ষ থেকে একটি কোটপিন দেয়া হয়। আর ভলান্টারি ডোনার কার্ড দেয়া হয়, যা রক্তদানের ছয় মাস পর থেকে যে কোন রক্তের প্রয়োজনে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডোনারকে রক্ত দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, রক্তদানের আগে ডোনারদের এ্যালকোহল পান বা ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। রক্তদানের আধ ঘণ্টা আগে চা কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন। খাবার গ্রহণ করে আসতে হবে। সুস্থ ব্যক্তি আদর্শ রক্তদাতা। ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, হাঁপানি, জ্বর, ইত্যাদি থাকলে রক্ত দান থেকে বিরত থাকতে হবে। তিনি আরও জানান, রক্তদানের পর তরল জাতীয় খাবার (যেমন জুস) গ্রহণ করা দরকার। প্রচুর (প্রায় তিন লিটার) পানি/পানীয় পান করা উচিত। নিতে হবে বিশ্রাম। ভারি কাজ, গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে হবে। আর দুধজাতীয় খাদ্য রক্তদানের এক ঘণ্টা পর খেতে পারেন। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডক্টরস এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডাঃ রাকিবুল ইসলাম লিটু বলেন, প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। সংগৃহীত রক্তের পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। প্রতিনিয়ত অনাকাক্সিক্ষত সড়ক দুর্ঘটনা, মায়ের প্রসবজনিত জটিলতা, ক্যান্সার, লিওকেমিয়া এবং থ্যালাসিমিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর জীবন রক্ষার্থে রক্তের প্রয়োজন হয়। তবে রক্ত যেমন একদিকে জীবন রক্ষা করে, অন্যদিকে অনিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনে এইডস, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-বি সিফিলিস, ম্যালেরিয়া ছড়ায়। স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, দেশে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ৪১টি বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের (ব্লাড ব্যাংক) সর্বশেষ তালিকা প্রকাশ করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। জনসাধারণের নিরাপদ জীবনের বিষয়টি বিবেচনায় এনে এ তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এ তালিকায় বাইরে থাকা ব্লাড ব্যাংকগুলো অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে। সাধারণ মানুষের উচিত হবে ওই সব অবৈধ ব্লাড ব্যাংক এড়িয়ে চলা। লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্লাড ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয় কিনা তাও মনিটর করা হবে। দেশের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোর ওপর দু’বছর ধরে গবেষণা চালিয়েছে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ। গবেষণা প্রতিবেদনে বেরিয়েছে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রগুলোর করুণ অবস্থা। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদন ছাড়াই চলছে শতকরা ৮১ ভাগ রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র। এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। বাকিগুলো অবাণিজ্যিক বেসরকারী উদ্যোগ। গবেষণায় তালিকাভুক্ত ২৫টি কেন্দ্রের মধ্যে মাত্র ৭টির কাছে রক্তের বিভিন্ন উপাদান পৃথকীকরণের জন্য যথাযোগ্য ব্যবস্থা রয়েছে। আর স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কর্মসূচীতে (এসবিটিপি) তালিকাভুক্ত নয় এমন সব ক’টি প্রতিষ্ঠানে রক্ত পরিসঞ্চালনের সুবিধা নেই। বাণিজ্যিক ও অবাণিজ্যিক ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষিত কর্মীর সংখ্যা সরকারী প্রতিষ্ঠানের তুলনায় শতকরা ৬২ ভাগ কম রয়েছে। রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে রক্তদাতা নির্বাচন ও উপযোগিতা নিশ্চিতকরণ, রক্ত সংগ্রহ, পরীক্ষা, দাতা-গ্রহীতা মেলানো, পরিসঞ্চালন ও রক্ত মজুদ করা, কর্মী প্রশিক্ষণ, শরীর ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত করণীয়, উপকরণ ব্যবহার ও তার পরিচর্যাÑ এসব বিষয়ের ওপর লক্ষ্য রাখার কথা রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন কেন্দ্রগুলোতে এবং কয়েকটি সরকারী কেন্দ্রে এই নির্দেশনার কপি পাওয়া যায়নি। শুধু কর্মীরা নন, কেন্দ্রগুলোর প্রধানরাও রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ক বিভিন্ন নীতিমালা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন না। ব্যক্তিমালিকানাধীন রক্তদান কেন্দ্রগুলোতে পেশাদার রক্তদাতা এবং পরিবার ও আত্মীয়দের কাছ থেকে রক্ত নেয়া হয়। শতকরা ৪৭ ভাগ কেন্দ্রে কোন পরীক্ষা ছাড়াই রক্ত পরিসঞ্চালনের কাজ চলে। একটি সরকারী কেন্দ্রেরও নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন (বিটিএস) বিষয়ে কোন লাইসেন্স নেই। এ ধরনের লাইসেন্সের প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছে সরকারী এবং অবাণিজ্যিক রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রের শতকরা ৬৫ ভাগ।
×