ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কূটনীতিকদের কাছে ধর্ণার রাজনীতি বিএনপির!

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

কূটনীতিকদের কাছে ধর্ণার রাজনীতি বিএনপির!

বিভাষ বাড়ৈ ॥ কথিত ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে পুরোপুুরি ব্যর্থ বিএনপি বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়ার রাজনীতি কোনভাবেই ছাড়ছে না। সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দফায় দফায় বিদেশী কূটনীতিকদের ডেকে নালিশ করে চলেছে দলটি। এ নিয়ে সমালোচনা এমনকি আজ পর্যন্ত কোন ফায়দা হাসিল করতে না পারলেও বিদেশই ভরসা বিএনপির। প্রভাবশালী দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর সমর্থন আদায়ে মরিয়া তারা। কোন নির্বাচনে গিয়ে হারলেই বিদেশীদের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে ইচ্ছেমতো তথ্য এমনকি প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েও হাজির করছেন বিএনপি নেতারা। অবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, পৌরসভায় নির্বাচন নিয়ে এক মাসের মধ্যেই দু’বার বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে নালিশ দিয়ে সহযোগিতার জন্য তারাা ধর্ণা দিয়েছেন। বিএনপির এমন রাজনীতি দেশের ভাবমূর্তিকে বিদেশীদের কাছে খাটো করছে বলে রাজনীতিক দলগুলো অভিযোগ করে আসছেন সব সময়েই। আওয়ামী লীগ নেতা এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়ার বিষয়টির সমালোচনা করেছেন বহুবার। এ ধরনের কাজকে লজ্জাজনক অভিহিত করে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচার চালানোর অভিযোগ করেছেন অনেক রাজনীতিবিদ। বিষয়টিকে দেশের রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর হিসেবে উল্লেখ করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও। এ ধরনের কর্মকা- সাধারণ মানুষ পছন্দ করেন না উল্লেখ করে বিএনপিকে মনোভাব পাল্টানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপি সমর্থক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরাও। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল যে নির্বাচনের মাধ্যমে সেই ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে বহুবার একই কাজ করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। ব্যাপক নাশকতা চালিয়েও সেই নির্বাচন বন্ধে ব্যর্থ হয়ে দলটি এক পর্যায়ে নিজেরা তথ্য সংগ্রহ করে নিজেদের মতো প্রামাণ্য চিত্র বানিয়ে তাকে ধারাবিবরণী সংযুক্ত করে বিদেশীদের কাছে হাজির করেছিল। দফায় দফায় এ কাজ করে কোন সুবিধা না আসায় এসব তথ্য বিদেশী প্রভাবশালী দেশ, কথিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছেও পাঠানো হয়। তাতেও কোন ফায়দা আসেনি। একই কাজ তারা করে সরকারের এক বছরের মাথায় গেল বছর টানা তিন মাস দেশজুড়ে পেট্রোল বোমা হামলাসহ নারকীয় তা-ব চালিয়ে জনরোষে পরে। জামায়াত-শিবিরের সহায়তায় হত্যাকা- চালিয়ে ব্যাপক সমালোচনা মুখে এক পর্যায়ে নিজেরা ইচ্ছেমতো তথ্য নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করে দায় চাপায় উল্টো সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর। জামায়াতের বক্তব্য বিবৃতিতে এর দায় চাপানো হয় ভারতের ওপরও। মিথ্য তথ্য হাজির করা হয় বিদেশীদের ডেকে তাদের কাছে। কিছুদিন পর আসলো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এবারও অংশ নিয়ে একই অভিযোগ ভোট জালিয়াতি ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব অভিযোগ জনগণের কাছে দেয়ার চেয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে হাজির করে সরকারবিরোধী মনোভাব তৈরিই যেন একমাত্র লক্ষ্য দলটির। এবার গত মাসের শেষে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে আবার সেই একই কাজ করেছেন বিএনপি নেতারা। এক পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে এ পর্যন্ত দুইবার কূটনীতিকদের ডেকে নালিশ করেছেন তারা। পৌরসভা নির্বাচনের পরপরই বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করা হয়। সেই অভিযোগে কোন ফল না আসায় আবার গত বুধবার একই অভিযোগ সেই একই বিদেশীদের কাছে। পৌরসভা নির্বাচনে কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকদের কাছে । বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন দাবি করেছেন, বিদেশীরা নাকি নির্বাচনের বিষয়ে বিএনপির কাছে মতামত চেয়েছিল। বিএনপি নেতা বলেন, সম্প্রতি দেশব্যাপী যে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সে নির্বাচনকে আমরা কিভাবে দেখছি, তা জানতে চেয়েছিলেন বিদেশী কূটনীতিকরা। তাদের কাছে নির্বাচনে অনিয়ম-কারচুপির বিষয়ে অভিযোগ তুলে ধরেছি আমরা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা তাদের কাছে পৌরসভার নির্বাচনে অনিয়মের দালিলিক তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, আমরা তাদের কাছে আমাদের কথা বলেছি। প্রথাগতভাবে বিদেশী কূটনীতিকরা কোন কমেন্টস করেন না। তবে আমরা কারচুপি-অনিয়মের বিষয়ে আমাদের অভিযোগ আমরা তুলে ধরেছি। সমসাময়িক রাজনৈতিকসহ অন্যান্য বিষয়েও বৈঠকে আলোচনা হয় বলে জানান রিপন। বৈঠকে অংশ নেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান, জার্মান, সুইডেন, নেদারল্যান্ড, স্পেন, ডেনমার্ক, তুরস্ক ও কুয়েতসহ ১৪ দেশের কূটনীতিকরা। এছাড়া বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রবার্ট ডি ওয়াটকিনসও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রিয়াজ রহমান, ইনাম আহমেদ চৌধুরী, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, মধ্যপ্রাচ্যে খালেদা জিয়ার বিশেষ দূত এনামুল হক চৌধুরী, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন, প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমান প্রমুখ। বৈঠক শেষে কূটনীতিকদের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের ব্রিফ করা হয়নি। জানা গেছে, এ বৈঠকে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য, পৌরসভা নির্বাচন, আসন্ন ইউপি নির্বাচন, সরকার ও নির্বাচন কমিশন এবং দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপি নেতাদের আলোচনা হয়েছে। বিদেশীদের ডেকে সরকারের বিরুদ্ধে একটি মনোভাব তৈরির চেষ্টা করেছে বিএনপি। এদিকে এসব কাজ করলেও বিদেশের নজর কাড়তে গিয়ে সমালোচনায়ও কম পরেনি দলটি। তবু সেই একই খেলা। বিদেশই এখন তাদের ভরসা। লন্ডনে বসে কলকাঠি নাড়ছেন দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। খালেদা জিয়াকে বিজেপি সভাপতির ফোনের বানোয়াট তথ্য প্রচার ও যুক্তরাষ্ট্রের ৬ কংগ্রেসম্যানের ভুয়া বিবৃতির নেপথ্যেও ছিল তারেক রহমানই। সাবেক একাধিক কূটনীতিক মনে করেন, বিএনপির আন্দোলনের প্রতি বিদেশীদের সহানুভূতি রয়েছে এমন ভুল বার্তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার কৌশল হিসেবেই মিথ্যাচার করা হয়েছে। এর ফলে বিএনপির আন্দোলনের দেউলিয়াত্ব প্রকটভাবে ধরা পড়েছে, যা হিতে বিপরীত হয়েছে। জানা গেছে, বিএনপির যেসব সিনিয়র নেতা আগে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে কাজ করতেন তাদের অধিকাংশই এখন সক্রিয় নেই। ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বিএনপির রাজনীতি ছেড়েছেন কিছুদিন আগে। বিএনপির কিছু নেতার পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এখন এ দায়িত্ব পালন করছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. আব্দুল মঈন খান, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান, সাবিহউদ্দিন আহমেদ ও ড. ওসমান ফারুক কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমেদ, ফরহাদ মাজহার ও ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরীসহ ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী বিএনপির পক্ষে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর টানা অবরোধ কর্মসূচী চলাকালে এমাজউদ্দীন আহমেদই জাতিসংঘের ঢাকা অফিসে গিয়ে একটি আবেদন দিয়ে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে জাতিসংঘ মহাসচিবের হস্তক্ষেপ কামনা করেছিলেন। এরপর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়ে কিছুটা তৎপরতা শুরু হলেও আন্দোলন চলাকালে পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা-ের কথা বিবেচনায় নিয়ে পরে আর বেশি দূর অগ্রসর হয়নি। কূটনৈতিক তৎপরতায় কোন সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা না থাকলেও একেবারে আশা ছাড়েনি বিএনপি। তাই এ বিষয়ে আবার নতুন করে চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। কিন্তু এভাবে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়াকে নেতিবাচক বলেই মানে করছেন রাজনীতিবিদরা। গত বছর এক অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, যিনি ১৫ দিনে ঘর থেকে বের হন না। তিনি নির্বাচনের আগে ঘন ঘন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেন। আমাদের নামে নালিশ করেন। নালিশ করে কী পেয়েছেন। নালিশ করে বালিশ পেয়েছেন। এবার পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়ার সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল হানিফ বলেন, বিদেশীদের কাছে নালিশ করে বিএনপি তাদের রাজনৈতিক দৌলিয়াত্ব ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করেছেন। মানুষ অনেক সচেতন, বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দিয়ে লাভ নেই। ক্ষমতার মালিক জনগণ, জনগণের আস্থা অর্জন করুন, জনগণ না চাইলে জীবনেও ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। খুব শীঘ্রই সরকার পতন হবে বিরোধী দলের নেতাদের এমন দাবির প্রসঙ্গে হানিফ বলেন, এই সরকারের প্রতি জনগণের গভীর আস্থা রয়েছে, যতদিন আস্থা থাকবে, পৃথিবীর কোন শক্তি সরকারের পতন ঘটাতে পারবে না। এদিকে বিদেশীদের কাছে দিনের পর দিন এভাবে ধর্ণা দেয়াকে যে কোন দলের জন্যই দেউলিয়াত্বের প্রকাশ বলে বলছেন বিএনপিপন্থী বেশ কয়েকজন বুদ্ধীজীবীও। একজন বলছিলেন, বিষয়টি নিয়ে বিএনপি নেতাদেরও বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন শিক্ষক নেতা অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলছিলেন, একটি দল যখন অপকর্ম করতে থাকলে তার দলভিত্তি দুর্বল হয়ে যায়। গণভিত্তি দুর্বল হলে সে বিকল্প কিছুৃ ধরে বাঁচতে চায়। এর একটি হচ্ছে বিদেশীদের কাছে যাওয়া। তাদের কাছে গিয়ে কিছুৃ একটা করা। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করা। বিদেশীদের কাছে এভাবে ধর্ণা দেবেই তারা। গণভিত্তি যে তার দুর্বল হয়ে গেছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সিএম শফি সামি বলেন, নিজেদের জনসমর্থনের প্রতি আস্থা না রেখে বাইরের দেশ থেকে সার্টিফিকেট জোগাড় করার এই চেষ্টা রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া আর কিছুই নয়, এটা হতাশাজনক। সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিদেশীদের কাছে ধর্ণা দেয়ার রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন অনেকে। সেখানে অভিযোগ অস্বীকার করেন বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আসম হান্নান শাহ বলেন, বিদেশীদের তৎপরতা বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে তিনি বলেন, রাজনীতিকরা বিদেশীদের প্রশ্রয় না দিয়ে নিজেরাই সঙ্কট সমাধান করবে। সেটাই হবে সর্বোত্তম পন্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক জিনাত হুদা ওয়াহিদ বলেন, এর আগে কূটনীতিকরা মাইনাস টু ফর্মুলা দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেছে।
×