ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওদের প্রতিরোধ করতেই হবে ॥ বিশিষ্টজনদের পরামর্শ

‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরাই দেশে জঙ্গীবাদের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে’

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

‘মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীরাই দেশে জঙ্গীবাদের প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে’

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সস্তা অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করে নয়, বাংলাদেশকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির ওপর দাঁড় করিয়ে সমসাময়িক সাম্প্রদায়িক-জঙ্গীবাদ-মৌলবাদসহ অভ্যন্তরীণ শক্তিকে মোকাবেলা করার পরামর্শ দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তাঁদের মতে, আজ দেশে যে সাম্প্রদায়িকতা প্রত্যাবর্তন ও জঙ্গীবাদের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তা রোধ করতে না পারলে বাংলাদেশের মৌলিক লক্ষ্য ও যে সমস্ত ভিত্তির ওপর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেগুলো অর্জিত হবে না। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশ উপ-পরিষদ আয়োজিত সেমিনারে তাঁরা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বাংলাদেশে আজকে অনেক গর্ব করার বিষয় আছে দাবি করে বলেন, তবে আমাদের আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগলে চলবে না। ১৯৭১ সালে বিজয় লাভের পরে আমরা আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগেছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম বিজয় পরিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন, আত্মগোপনে থেকেও তারা তাদের কাজ করে গেছেন। যার ফলে আমরা আজকে দেশে সাম্প্রদায়িকতা প্রত্যাবর্তন ও জঙ্গীবাদের প্রাদুর্ভাব দেখতে পাচ্ছি। এটা আমাদের রোধ করতে হবে। নইলে বাংলাদেশের মৌলিক লক্ষ্য ও যে সমস্ত ভিত্তির ওপর মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সেগুলো অর্জিত হবে না। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিকমতো গড়ে তুলে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যে ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যে বর্তমান সরকার এই সমস্ত অগ্রগতি সাধন করেছে, সেই সমস্ত প্রতিকূলতা ভয়ঙ্কর-ভয়ানক ছিল। পাহাড়সম ছিল। মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আমরা সেখান থেকে অগ্রসর হতে পেরেছি। সরকার প্রয়োজনীয় যোগান দিয়েছে যে সমস্ত বিষয় দরকার। কাজেই বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্পর্কে প্রত্যেকে আমরা আশাবাদী হতে পারি। আমাদের চাইতেও বাইরের বিশেষজ্ঞরা আমাদের নিয়ে আরও বড় করে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অঙ্গীকার অনুযায়ী মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে পেরেছে এবং অপরাধীদের শাস্তিদান কার্যকর করেছে। যা অনেকেই ভাবতে পারেনি যে, স্বাধীনতা লাভের এত বছর পর যখন সাক্ষ্যপ্রমাণ অনেক লুপ্ত হয়ে গেছে, প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই মারা গেছেন তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে। তিনি বলেন, গত ২৫ বছরেও আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। এগুলোর দিকে এখন মনোযোগ দেয়ার সময় এসেছে। সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেন, আজকে আমাদের যে জঙ্গীবাদের উত্থান দেখছি; এরা কেউ নয়। এরাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে যে ক্ষুদ্র অংশটি আমাদের বিরোধিতা করেছিল। এরা হলো মুসলিম লীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলামী এবং অতি ডানপন্থী পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, নকশালপন্থীরা। এরা একত্র হয়ে একাত্তরে আমাদের বিরুদ্ধাচরণ করেছে এবং যেভাবে নৃশংসতা করেছেÑ মূলত এরাই একাত্তরে জেনোসাইডের জন্য দায়ী। এই লুকিয়ে থাকা লোকগুলোকে নিয়েই পরবর্তীতে জিয়াউর রহমানের উত্থান ঘটে। তিনি বলেন, আমার জানামতে জিয়াউর রহমান কোন প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। তিনি হয়ত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তার কর্মকা- তাঁকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলা যেতে পারে। অনুপ্রবেশকারী হলেও ওই সময় আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজন ছিল এবং সেক্টর কমান্ডারদের ধরে রাখার দরকার ছিল বলেই জিয়াকেও ধরে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত যে ‘স্টেট টেররিজম’ সৃষ্টি করেছিল তার বহির্প্রকাশ এখনও আছে। জেএমবির এখন যারা ধরা পড়ছে এরা তাদেরই সাগরেদ। তবে আবার ষড়যন্ত্র করলে জনগণই তাদের ঠেকাবে। জনগণই তাদের পিষে ফেলবে এবং তাদের দিন নিঃশেষ হওয়ার সময় এসেছে। বিচারপতি এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, ২০১৫ সালে ৫ জানুয়ারি ঘিরে বিএনপি-জামায়াত যে তা-ব চালিয়েছিল তার জন্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম (ট্রাইব্যুনালÑ এ্যাক্ট ১৯৭৩-এর ৩ ও ১ ধারা মোতাবেক মামলা করা যেতে পারে। এর জন্য খালেদা জিয়ারও দায় কম নয়, কারণ তিনি সকল কর্মকা- করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমাদের প্রাপ্তির ডালায় একটি বড় সফলতা। যেটা শেখ হাসিনা না থাকলে কোনদিন সম্ভব হতো না। বিচার বিভাগ স্বাধীন উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত দাবি করছে বিচার বিভাগ নাকি স্বাধীন নয়! এটি একটি মিথ্যাচার। আমি একজন প্রাক্তন বিচারপতি হিসেবে বলছি এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার আর হতে পারে না। আজকে বিচার বিভাগ যেভাবে স্বাধীনতা ভোগ করছে, এ স্বাধীনতা বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনদিন ছিল বলে আমি জানি না। এখন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অসীম। অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন সরকারকে মানব সম্পদ উন্নয়নকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, আমাদের দেশে দরিদ্র কমছে এবং দারিদ্র্য অচিরেই ইতিহাসে পরিণত হবে। এটা অর্থনীতির গতিধারাতেই হবে। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক মধ্যবিত্তের আকার বৃদ্ধি পেলে জ্ঞানভিত্তিক মধ্যবিত্তের বিকাশ হচ্ছে না। আমরা যদি আমাদের দেশে আলোকিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সৃষ্টি করতে না পারি তাহলে আগামী দিনে আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এত সফলতার পরেও আমরা জ্ঞান চর্চা বৃদ্ধির সমাজ দাঁড় করাতে পারেনি, তবে এটা করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের সঙ্গে সুশীল সমাজ ও রাজনীতিকদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণেরও পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ। মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী বিভিন্ন পরিসংখ্যান উল্লেখ করে বলেন, শেখ হাসিনা বিগত ৭ বছরে এত বিশাল সফলতা অর্জন করেছেন, যা বিরল ও অভূতপূর্ব। জিডিপির হার ৫.৪ শতাংশ থেকে ৬.৭ শতাংশের ওপরে ছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, আগামীতে শীর্ষ ১১ অর্থনীতিক শক্তিশালী দেশগুলোর অন্যতম হবে বাংলাদেশ। প্রবৃদ্ধি সক্ষমতায় চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, যারা উন্নয়ন দেখতে চায় না, তারা তো উন্নয়ন দেখতে পাবেন না এটাই স্বাভাবিক। আসলে উন্নয়নের শত্রু হচ্ছে দুই রকম। একটি হচ্ছে বাইরের শত্রু আরেকটি ভেতরের শত্রু। বাইরের শত্রুদের আমরা চিনি, তাই আমাদের ভেতরকার শত্রু সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এদের মোকাবেলা করার জন্য সবাইকে আত্মোপলব্ধি করতে হবে। ড. হাছান মাহমুদ বলেন, আজকে অদম্য গতিতে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। তবে এই অগ্রগতির মূল প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান এবং জঙ্গীবাদনির্ভর রাজনীতি। বিশেষ করে বিএনপি যদি জঙ্গীবাদনির্ভর রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারত, তাহলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে আরও ধাবমান গতিতে এগিয়ে যেতে পারতাম। বর্তমান সরকারের ‘দিন বদলের ৭ বছর’ শীর্ষক এই সেমিনারে মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এমিরেটাস অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সভাপতিত্বে সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন অর্থনীতিবিদ শামসুল আলম, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার তানিয়া ইসলাম প্রমুখ। সেমিনার পরিচালনা করেন আওয়ামী লীগের উপ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক অসীম কুমার উকিল।
×