ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পূর্ব প্রকাশের পর

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

প্রকাশিত: ০৪:৪৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

আধুনিক শিল্প-সাহিত্য কতিপয় প্রবণতা

চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহ উইলিয়াম জেমস তাঁর ‘প্রিন্সিপলস অব সাইকোলজি’ গ্রন্থে ‘স্ট্রীম অব কনশাসনেস’ কথাটি ব্যবহার করেছিলেন, একটি জাগ্রত মনের নিরবচ্ছিন্ন ভাবনা প্রবাহ এবং সচেতনতাকে বোঝাতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই আঙ্গিক যথার্থভাবে বিকশিত হয়। লেখকরা এর মাধ্যমে চরিত্রের চেতন ও অর্ধচেতন মনে যেসব স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট ভাবনা, অনুভূতি, স্মৃতি ও নানা আপাতবিচ্ছিন্ন অনুষঙ্গ ভেসে ওঠে তার সবকিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেন। এখানে ঘটনা ও কালের বাস্তব ধারাবাহিকতা ও পরম্পার্য রক্ষিত হয় না, যৌক্তিকতা কিংবা অযৌক্তিকতার বিষয়টি এখানে গুরুত্ব পায় না, চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহে ঠিক যেমনটি ধরা পড়ে তেমনটি প্রতিফলিত হয়। জেমস জয়েস ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসে স্ট্রীম অব কনশাসনেস-এর একাধিক টেকনিক নিপুণভাবে প্রয়োগ করেন। ভার্জিনিয়া উলফ তাঁর ‘মিসেস ড্যালোওয়ে’ এবং ‘টু দি লাইট হাউস’ উপন্যাসে এই আঙ্গিকের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন। এই আঙ্গিকের দারুনণ প্রয়োগ লক্ষণীয় উইলিয়াম ফকনারের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি সাউন্ড অ্যান্ড দি ফিউরি’তে। কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় চেতনার অন্তঃশীল প্রবাহের অসামান্য প্রকাশ ঘটেছে, সামান্য পাঠ নেয়া যাক্- ‘ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ-মর্ত্য-করতলে তাজি-বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মৎ হ্রেষা হেঁকে চলে।’ পরাবাস্তববাদ আঁদ্রে ব্রেতোঁ পরাবাস্তববাদী ইশতেহারে ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিস্ময় সবসময়ই সুন্দর, যা কিছু বিস্ময়কর তাই সুন্দর এবং শুধুমাত্র বিস্ময়ই সুন্দর।’ গতানুগতিক নৈতিকতাবোধ, প্রচলিত সামাজিক ও শৈল্পিক কনভেনশন, একান্ত বস্তুনির্ভর যুক্তি শৃঙ্খল এসব ভেঙে পরাবাস্তববাদ গুরুত্ব দিল জীবনের বিস্ময়ের উপর, যা লুকিয়ে থাকে স্বপ্নে, অচেতনে, বিশৃঙ্খলায়, অতিপ্রাকৃতে, অস্বাভাবিকতায়, ভয়ে, অযুক্তিতে, কুসংস্কার জ্ঞান করে সকল গতানুগতিক নৈতিক ও নান্দনিক আইনকানুনকে উড়িয়ে দেয়ার মধ্যে। সুরিয়ালিজম চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সাহিত্যসহ সকল শিল্পকর্মকেই বৈপ্লবিকভাবে প্রভাবিত করেছে। আঁদ্রে ব্রেতোঁ, লুই আরাগঁ, সালভাদর দালি প্রমুখের সৃষ্টিকর্মে-এর প্রভাব সুস্পষ্ট। বর্তমানে এর প্রভাব কিছুটা স্তিমিত হলেও অন্তর্হিত নয়। বাংলাদেশের কবি আবদুল মান্নান সৈয়দের পরাবাস্তববাদী ধারার কয়েকটি পঙক্তির পাঠ নেয়া যায়Ñ ‘ছুড়েছি গোপন জাল ইচ্ছার তদন্তে রহস্যের সঙ্গে ওর রোজ দেখা হয় ছুড়েছি স্বরূপ জাল সত্তার তদন্তে জয় ! জয় ! অস্তিত্বের মাছদের জয় ! (মাছ সিরিজ) প্রতীকী আন্দোলন ইংরেজি সাহিত্যের অনেক কবি তাঁদের কবিতায় ব্যক্তিগত প্রতীক ব্যবহার করেছেন। প্রতীকী ধারণায় মনে করা হয় প্রত্যেক কবি ও শিল্পীর থাকতে হবে ব্যক্তিক প্রতীক যা হবে ব্যঞ্জনাময় এবং নান্দনিক, যেখানে অনুকরণ কিংবা সমরূপতার কোনো স্থান নেই। সিম্বলিস্ট মুভমেন্ট যথার্থভাবে গড়ে ওঠে ফ্রান্সে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যপাদে। বোদলেয়ারের ‘ঋষবঁৎং ফঁ সধষ’ প্রকাশের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে, র্যাঁবো, মালার্মে, ভার্ল্যে এবং পল ভ্যালোরির সাহিত্যকর্মকে আশ্রয় করে এই আন্দোলন শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ইউরোপ ও আমেরিকার অনেক কবিকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ দাশ প্রতীকের নান্দনিক প্রয়োগের জন্য বিখ্যাত। বাস্তববাদ ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিকাশ লাভ করে এই সাহিত্যিক আন্দোলন বা মতবাদ; সাহিত্যিক যখন তাঁর সৃষ্টিকর্মে জীবন ও প্রকৃতিকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তার যথাযথরূপে রূপায়িত করতে প্রয়াস পান তখনই তা বাস্তববাদী তথা রিয়ালিস্টিক ওয়ে ওঠে। ফ্রান্সে বালজাক, বিলেতে জর্জ এলিয়ট এবং যুক্তরাষ্টে উইলিয়াম ডিন হাওয়েলস প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যে বাস্তববাদের যাত্রা শুরু হয়। বাংলা কবিতায় বাস্তববাদকে প্রতিষ্ঠায় কাজী নজরুল ইসলামের ভূমিকা অনন্য। বাংলা কথাসাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ, সমরেশ বসুর রচনায় বাস্তব মানুষের জীবনচিত্র অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে ওঠে এসেছে। উদারবাদ উদারবাদ মার্কসীয় কট্টর বামপন্থী এবং প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থীদের ধারণার চাইতে ভিন্ন এবং গভীরতর কিছু বক্তব্য উপস্থাপন করেছে। উদারবাদে মানুষের অন্তরের ঝোঁক বা মনের চাহিদাকে গুরুত্ব প্রদান করেছে সেটা যেমনই হোক না কেন। ধর্মীয় এবং সামাজিক বিষয়ের চেয়ে তারা ইচ্ছার স্বাধীনতায় অধিক আগ্রহী। মেক্সিকান কবি ও প্রাবন্ধিক অক্টাভিও পাজের আন্তরিক চেষ্টা ও তাঁর প্রকাশিত ম্যাগাজিন প্লুরাল ও ভুয়েলটার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ধারণাটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ইচ্ছার স্বাধীনতা ও মানবতার মুক্তিচিন্তাকে অধিক গুরুত্বদানের ফলে বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের একটি অন্যতম সাহিত্যে প্রবণতা হিসেবে পরিণত হয়েছে উদারবাদ ধারণাটি। (চলবে) সৌম্য সালেক
×