ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নির্ঝর মাহমুদ

‘বিজয় চিরন্তন’ মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক অধ্যায়

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

‘বিজয় চিরন্তন’ মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক অধ্যায়

বিজয় দিবস মানেই ১৯৭১ সালে পাক জান্তাদের পরাজিত করে লাল সবুজের নিশান পৃথিবীর বুকে উড়িয়ে জানান দেয়া আমরা বীরের জাতি বাঙালী। ত্রিশ লাখ শহীদের প্রাণ আর আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর চিরব্যথাকে মনে করিয়েও দেয় মহান বিজয় দিবস। বিশ্বের বুকে বাঙালী জাতি মাথা উচু করেই চলতে শুরু করে। ত্যাগ আর তিতিক্ষাকে পেছনে সারা জীবন হৃদয়ে লালন করে যে জাতি এগিয়ে আগামীর পথে তারই নাম বাঙালী। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বাদ দিয়ে বাঙালীর ইতিহাস কখনোই হতে পারে না। সুতরাং এর ইতিবৃত্ত জানাতে হবে আগামী প্রজন্মকে। যা জানানোর দায়িত্বটাও বর্তমান প্রজন্মের উপরই বর্তায়। ইচ্ছে করলেও এর দায় বর্তমান প্রজন্ম এড়াতে পারে না বা পারবে না। একাত্তরের পরবর্তী বছর থেকেই বাঙালী জাতি বিশ্বব্যাপী পালন করে আসছে মহান বিজয় দিবস। যার শ্রী ও গুরুত্বও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সকল আয়োজনের মধ্যে বাঙালী জাতির গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাসকে নিয়ে নানা প্রকাশনাও বের হয়। ছোট-বড় অনেক প্রকাশনাই প্রকাশিত হয়ে থাকে। সবার লক্ষ্য একটাই বাংলা আর বাঙালীর গুরুত্ব নতুন প্রজন্মকে জানানো। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে যখন একটা শ্রেণী বিকৃত করার চেষ্টায় লিপ্ত তখন প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিকের উচিত সঠিক ইতিহাসটি জাতির সামনে তুলে ধরা। ‘বিজয় চিরন্তন’ একটি বিজয় দিবস প্রকাশনা। সম্পাদক, আকাশ চৌধুরী। প্রচ্ছদ ও গ্রাফিক্স, বিমান তালুকদার, মুদ্রণ, মৈত্রী, ৩৪/বি, বাংলা বাজার, ঢাকা। শুভেচ্ছা মূল্য ৩০ টাকা। মহামান্য রাষ্ট্রপতির একান্ত আলাচারিতায় শুরু দেশের শীর্ষস্থানীয় লেখকদের লেখায় সাজানো ‘বিজয় চিরন্তন’ ১১ ফর্মার প্রতিটি পাতাই চার রঙের। সম্পাদক লেখা সংগ্রহ ও প্রকাশের ক্ষেত্রে যে গুরুত্বটি দিয়েছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা। সে ক্ষেত্রে সম্পাদক দু’একটি লেখা পুনঃমুদ্রণ করতেও কার্পণ্য করেননি। তবে বিচার বিশ্লেষণে তিনি সফল হয়েছেন। গতানুগতিক ধারার বাইরের একটি প্রকাশনা ‘বিজয় চিরন্তন’ তা বলা যায় নিশ্চিন্তে। ‘বিজয় চিরন্তন’ এর সম্পাদকীয়র পরেই রয়েছে আলাপচারিতায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ‘রাজাকাররা বাবাকে নির্যাতন করেছিল’ একান্ত এ সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এর সাজিদুল হক। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান-এর ‘ফিরে দেখা : ১৯৭১’ প্রকাশ হয়েছে ‘বিজয় চিরন্তন’ এ। প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের ‘উনিশ শ’ একাত্তর’ লেখাটিও প্রকাশ হয়েছে। এর জন্য সম্পাদক লেখকের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওনের সদয় সম্মতি গ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক লেখাটি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রয়াত মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানের। লেখকপুত্র এনামুল হাবীবের সম্মতি নেয়া হয়েছে প্রকাশের জন্য। ‘বিজয় চিরন্তন’ সম্পাদক মূল্যবান লেখার ফাঁকে ফাঁকে দেশবরেণ্য কবিদের কবিতার স্থান দিয়েছেন মর্যাদার সঙ্গেই। কবি নির্মলেন্দু গুনের ‘পতাকার গান’ ও কবি আসাদ চৌধুরীর কবিতা ‘শহীদদের প্রতি’ শীর্ষক কবিতা রয়েছে চতুর্দশ পৃষ্ঠায়। জাতীয় দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান মহান স্বাধীনতার বিস্তৃত বিবরণ সম্পৃক্ত চমৎকার যে লেখাটি লিখেছেন তার শিরোনাম ‘এরা বাংলাদেশের নয় এরা পাকিস্তানের’। ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের পোশাকি ভাষায় ঘোষিত হয়েছে ‘গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণ ও মর্যাদাদান এবং গণহত্যার অপরাধ বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস’। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক এ বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করে লিখেছেন ‘পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার : ৯ ডিসেম্বরের ডাক’। নিজের বাবাকে একাত্তরের ৫ মে বিকেলবেলা পাকিস্তানী মিলিটারিরা গুলি করে হত্যার কথা অকপটে বলেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল। ‘বুকের ভেতর ঘৃণার আগুন’ শিরোনামের লেখাটি পড়লেই হৃদস্পটে দেখা যাবে সে আগুনের দাবানল। দেশবরেণ্য ছড়াসাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন ‘তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি’! কিন্তু কেন?’ শিরোনামের লেখাটিতে সঙ্গীতশিল্পী হায়দার হোসেনের গাওয়া গানের প্রতিটি পংক্তির বিস্তর বর্ণনা করে নতুন প্রজন্মকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। মামুন সিদ্দিকী লিখেছেন ‘শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া : শিল্পী ও সংগ্রামী’। লেখাটি পাঠে একজন শহীদকে নতুন প্রজন্ম চিনে নিতে পারবে নতুন করে। ‘পাকিস্তান গণহত্যার দায় অস্বীকার করছে আমরা পাকিস্তানকেই অস্বীকার করছি’ শিরোনামের শীর্ষক লেখাটির স্রষ্টা বেসরকারী টেলিভিশন এটিএন নিউজের এ্যাসোসিয়েট হেড অব নিউজ প্রভাষ আমিন। তিনি পাকিস্তানীদের কাছে আমাদের যে পাওনা রয়েছে সেসব বিষয়সহ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের বিশ্লেষণ করেছেন। সে হিসেবে পাকিস্তানীদের কাছে বাংলাদেশের পাওনা রয়েছে অনেক। সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ আবদুস সবুর মিঞা সংক্ষিপ্তাকারে লিখেছেন ‘বিজয়ের শপথ’। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালী জাতির গৌরবময় বিজয় অর্জনের পর থেকে আর পেছনে থাকাতে হয়নি। শুরু হয় সামনের দিকে এগিয়ে চলা। ‘স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের এগিয়ে চলা’ শিরোনামের লেখাতে এসবের ব্যাখ্যা করেছেন ভিনিউজ বিডি ডট কম এর সম্পাদক জয়ন্ত আচার্য। যে মানুষটির জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। জাতি পেত না লাল সবুজের পৃথক একটি পতাকা তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার অনেক আগেই ৭ মার্চ তিনি দেশ ও জাতিকে চূড়ান্ত দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। মূলত ৭ মার্চ জাতির জনকের ভাষণেই সমগ্র বাঙালী এক হয়ে গিয়েছিল। সিলেট প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আহমেদ নূর লিখেছেন সেই মানুষ ও বাংলাদেশকে নিয়ে। শিরোনাম দিয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ’। গণজাগরণ মঞ্চ বাংলাদেশ এর মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার নানা প্রশ্ন ও প্রশ্নের উত্তরসহ লিখেছেন ‘প্রগতিশীলতা. মুক্তচিন্তা, ধর্মবিদ্বেষ; একটি বিশ্লেষণ’ শীর্ষক অসাধারণ একটি লেখা। ‘বিজয় চিরন্তন’ এ প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একমাত্র গল্পটি লিখেছেন কবি-কথাশিল্পী সালমান ফরিদ। ‘শালম ও একটি ভোর’ শিরোনামের গল্পটি পাঠে যে কেউ কিছু সময়ের জন্য হলেও চলে যাবেন একাত্তরের রণাঙ্গনে। গল্পটির পরেই রয়েছে কবি হালিম আজাদের ‘তোমাদের বাড়ির ধুলোবালি’, ‘হায়েনা’, ও ‘যুদ্ধাপরাধীর রায় শোনে’ শিরোনামের তিনটি কবিতা। এ ছাড়াও কাজী রফিক লিখেছেন ‘আগস্ট ট্র্যাজেডি’ ও দিলোয়ার ইবনে ইউনুস লিখেছেন ‘স্বাধীনতা আমার’ শিরোনামের কবিতা। ‘আলবদর থেকে ধনকুবের মীর কাশেম’ শিরোনামে লিখেছেন জাফর ওয়াজেদ। লেখাটি সাপ্তাহিক এই সময়ে পূর্বেও প্রকাশ হয়েছে। এ লেখাটি পাঠে এক কুখ্যাত ধনকুবের নির্মমতার বিবরণ পাওয়া যাবে অনায়াসে। কবি ওবায়েদ আকাশ লিখেছেন ‘তরুণ ক্যানভাস’ শীর্ষক কবিতাটি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্মারক সংগ্রাহক হারেছ-উজ-জামান লিখেছেন ‘শহীদ শিল্পী সোলায়মান ও তাঁর মা’। সাংবাদিক সঞ্জয় সরকার লিখেছেন ’৭১ এর গণহত্যা : প্রেক্ষাপট নেত্রকোনা, সেসব শহীদদের কথা’। দৈনিক যুগভেরীর নির্বাহী সম্পাদক অপূর্ব শর্মা লিখেছেন, ‘যুদ্ধ জয়ের গান’। তাঁর লেখাটির মধ্যে মহান মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীদের ভূমিকার কথা ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের পাশাপাশি সাধ ও সাধ্যের বিষয়টিও উঠে এসেছে। সুদীর্ঘ ‘স্বাধীনতার মানে এটা নয়’ শিরোনামের কবিতাটি লিখেছেন সালাম মশরুর। আমেরিকা প্রবাসী আলমগীর কুমকুম লিখেছেন ‘স্বাধীনতা দেখেছি, দেখেছি স্বাধীনতার প্রথম সূর্য’। সাংবাদিক সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনার ওপর আমরা নতুন প্রজন্ম আস্থা রাখতে চাই’। বর্তমান সরকারের সাফল্য নিয়ে সাংবাদিক সাব্বির আহমদ লিখেছেন ‘পদ্মা সেতু : স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প!’। ‘যেভাবে মুক্ত হয়েছিল নেত্রকোনা শহর’ লিখেছেন আলপনা বেগম। তিনি দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ও সময় টিভির নেত্রকোনা প্রতিনিধি। ‘বিজয় চিরন্তন’ এর শেষাংশে রয়েছে তিনটি ছড়া-কবিতা। ‘মহান বিজয় দিবস’ লিখেছেন আবু জাফর। ‘খুশির দিন’ শিরোনামের ছড়াটি লিখেছেন আনিস রহমান। শেষ কবিতা ‘বিলিয়ে দাও দেশপ্রেম’ লিখেছেন ‘বিজয় চিরন্তন’ সম্পাদক আকাশ চৌধুরী। ‘বিজয় চিরন্তন’ বিজয় দিবস ২০১৫ উপলক্ষে প্রকাশিত একটি বিশেষ প্রকাশনা। যা বলা যেতে পারে আগামী প্রজন্মের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধকে জানার এক ব্যতিক্রম প্রয়াস। সামগ্রিকভাবে ‘বিজয় চিরন্তন’ মুক্তিযুদ্ধের দালিলিক একটি অধ্যায় বলা যেতে পারে অকপটে।
×