ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

‘ধর্ষণ গেইম’ যখন বিশ্বজুড়ে

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

‘ধর্ষণ গেইম’ যখন বিশ্বজুড়ে

গেমটির নাম ঞধযধৎৎঁংয লধসধ’র, বাংলায় লিখলে ‘তাহাররুশ জামা’ই’। প্রচ- ভিড়ের মধ্যে একদল পুঙ্গব কোন একটি মেয়েকে টার্গেট করবে, তারপর তাকে ঘিরে ধরে শুরু করবে নানা রকম নির্যাতন। প্রথমে হাতে, পরে জামাকাপড় ছিঁড়ে, এরপর শারীরিকভাবে। ভিড়ের মধ্য থেকে দু’একজন অতি উৎসাহী হয়ত এর মধ্যেই মেয়েটিকে ধর্ষণ করবে। আর এই গ্রুপটিকে পাহারা দেবে আরও একটি গ্রুপ, যারা ঘিরে থাকবে তাদের। তাদেরও ঘিরে থাকা আরও একটি গ্রুপ তখন লক্ষ্য রাখবে, বহিরাগত কেউ যাতে এই ভিড়ে ঢুকে তাদের উদ্দেশ্য ভ-ুল করতে না পারে। ব্যস, বর্ণনার এতটুকু পরেই গা শিরশির করে ওঠার কথা যে কোন মানবিক মানুষের। মিসরের তাহরির স্কয়ারে হোসনি মুবারকবিরোধী আন্দোলনের সময় এরকম ‘গেম’-এর শিকার হয়েছে অনেক নারী। বিদেশী সাংবাদিকরাও বাদ যায়নি। একে বলা হয়, কালেকটিভ হ্যারেসমেন্ট। এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রথম ২০০৬ সালে এ ধরনের ‘গেম’ নজরে আসে। তখন রমজান মাস ছিল। হিজাব পরা এবং হিজাব ছাড়া, কোন নারীই বাদ পড়েনি এই ‘গেম’ থেকে। এতদিন এই নৃশংস গেমটি কেবল আরব দেশগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। সম্প্রতি নববর্ষের প্রাক্কালে জার্মানির কোলন শহরে নারী নির্যাতনের যে ‘মহোৎসব’ হয়ে গেল, এটা ছিল তারই অংশ। সেখানেও অংশগ্রহণকারীরা ছিল এই আরব বর্বরগুলোই, যাদের প্রতি মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। তারা যথাযথ উপায়েই এর প্রতিদান দিল। ধিক, শত ধিক এসব পুরুষকে! বিশেষ করে জীবন বাঁচাতে আশ্রিত হয়ে আশ্রয়দাতাদের ওপরই যারা এ ধরনের হামলা চালাতে পারে, তারা ঘৃণ্য যে কোন কাজই করতে পারে। ইউরোপের জন্য এই ঘটনা ‘ডোর বেল’ মাত্র, আরও অনেক দেখার এবং সহ্য করার আতঙ্কে থাকতে হবে আমাদের। আরবদের এই তাহাররুশ জামা’ই-এর সঙ্গে আমাদের গত পহেলা বৈশাখে টিএসসিতে ঘটে যাওয়ার বেশ সাদৃশ্য আছে। আমরা ধর্মের নামে কেবল উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, হিজাব, জোব্বার আমদানিই করছি না, সেই সঙ্গে সম্মিলিতভাবে কিভাবে ‘গণধর্ষণ’ করা যায়, তারও পদ্ধতি আমদানি করছি। তেল-স্বর্ণ-পেট্রো ডলারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে আমূলভাবে। হাজার বছর ধরে আমাদের এই ভূমিতে গড়ে ওঠা সংস্কৃতি আজ বিপন্ন এসব হিজাব-জোব্বাধারী আর তাহাররুশ জামা’ই-এর আমদানিকারকদের হাতে। নারী অধিকার, মানবাধিকার নিয়ে আমরা যত সোচ্চার হচ্ছি, ততই ধীরে ধীরে আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে ধর্মের লেবাসধারী এসব ‘পণ্য’। আমি এই ধর্ষণ গেমকেও পণ্যই বলব, কারণ এটা আমদানি করা হয়েছে আমাদের সংস্কৃতিতে। তবে হয়ত কেউ বলবে যে, আমাদের এখানে কি গণধর্ষণ ছিল না? ছিল। অবশ্যই ছিল। শুধু মেলাতে হবে আমাদের যে, কবে থেকে এই গণধর্ষণের কালচার শুরু হলো এখানে! এর কোন প্রতিকার আদৌ হয়েছে কিনা! নারীর ইস্যু বলে সবসময়ই এড়িয়ে যাওয়া এই নৃশংস নির্যাতন আজ ইউরোপে ঘটার পর দেখতে পাই, সেখানে এর প্রতিক্রিয়া কতখানি সবল হয়। আর আমরা? মিসর এক সময় ছিল আরব দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংস্কৃতিমনা, সুরক্ষিত, সমৃদ্ধ সভ্যতার দেশ। ইউরোপের সভ্যতা সেখানে একদা বিস্তৃতি পেয়েছিল। ফলে মিশেল এক সংস্কৃতির দেশ ছিল মিসর। ইসলাম ধর্ম বিকৃত রূপ নিয়ে কিরকম ধ্বংসলীলা ডেকে আনল দেশটিতে, তার প্রমাণ মেলে এই ‘তাহাররুশ জামা’ই’-এর জনপ্রিয়তায়। খুব সতর্কতা, কিন্তু বর্বরতার সঙ্গে মঞ্চস্থ হয় এই ‘ধর্ষণ গেম’। কিন্তু সেখানেও এর প্রতিকার হয় না বলে দিকে দিকে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে গেছে। নারীকে আরও দমিয়ে দেবার এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র তো আর হতে পারে না। প্রথম এই ‘গেম’ এর খবর পশ্চিমাদের নজরে আসে ২০১১ সালে। সিবিএস রিপোর্টার লারা লোগান তখন তাহরির স্কয়ারে ভিড়ের মাঝে নিপীড়নের শিকার হন, তার কাপড় খুলে নেয়া হয়। শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকারই শুধু হননি, তাকে বেধড়ক পেটানো হয় সেখানে। কয়েক শ’ লোক সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার ওপর। এমন দৃশ্য আমরা কেবল জিওগ্রাফিক চ্যানেলেই দেখতে পাই, যখন একদল ক্ষুধার্ত বন্যপ্রাণী তাদের শিকারের ওপর হামলে পড়ে। সভা-সমাবেশ-বিক্ষোভে-আনন্দ উদযাপনে নারীর উপস্থিতি যে কিছু পুরুষকে ‘ক্ষুধার্ত’ করে তুলতে পারে এমন বর্বর উপায়ে, তা আবারও প্রমাণিত হলো কোলনে। ভাগ্য ভাল আমাদের নারীকূলের যে, কোলন শহরটি ইউরোপে, আমাদের দেশ বা উপমহাদেশ বা আরব দেশে নয়, যেখানে প্রতিনিয়ত নারীকে ঘরে ফিরিয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। গত বছর পহেলা বৈশাখে আমাদের আমদানি করা ধর্মীয় সংস্কৃতির এক পশলা মহড়া হয়ে গেছে। তার বিচার আমরা পাইনি। কাজেই সামনের দিনগুলোতে যে এরই বড় ধরনের মহড়া বা মূল নাটকই মঞ্চস্থ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেবল জার্মানিতেই নয়, একই ধরনের হামলার খবর পাওয়া গেছে সুইডেন, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড থেকেও। কাজেই বিশ্বজুড়ে যে ‘কালো অধ্যায়’ নেমে আসছে নারীদের ওপর, তাতে আমরাও বাদ পড়ব কি-না, তা নিয়ে যথেষ্ট শঙ্কিত হওয়ার কারণ থেকেই যাচ্ছে। সূত্র : উইমেন চ্যাপ্টার
×