ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মো. সাখাওয়াত হোসেন

নারীর প্রতি সহিংসতা

প্রকাশিত: ০৪:৩০, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

নারীর প্রতি সহিংসতা

বিশ্বে নারীর প্রতি সহিংসতা সমস্যাটি লক্ষ কোটি নারীর জন্য গভীর উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ সমস্যাটি তীব্র এবং প্রকট আকার ধারণ করেছে। নারীর প্রতি নির্যাতনের বিষয়টি পুরনো বিধায় সমাধানের জন্য অনেক আগে থেকে চেষ্টা করা হলেও সমস্যাটি এখনও জাজ্বল্যমান। কালের বিবর্তন এবং ঘটনার পরিক্রমায় নির্যাতনের মাত্রা ও ধরন ভিন্ন রূপ লাভ করেছে। ব্রিটিশ ক্রাইম সার্ভের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে প্রত্যেক ৪ জন নারীর মধ্যে কমপক্ষে ১ জন নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। ২০১১ সালের বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে জানা যায়, শতকরা ৮৭ ভাগ বিবাহিত নারী তাদের স্বামী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশে সাধারণত ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন, শারীরিক নির্যাতন, পাচার, পতিতাবৃত্তি, যৌতুক, এসিড নিক্ষেপ, মারাত্মক জখমসহ খুনের মতো জঘন্য অপরাধ নারীর বিরুদ্ধে ঘটে থাকে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য সত্যিই লজ্জা এবং অবমাননাকরও বটে। বাংলাদেশে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কারণে নারীরা সমাজে পুরুষের অধীনে থাকে এবং অনেক ক্ষেত্রে এই বিষয়টি সহিংসতার প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে থাকে। নারীরা বিশেষ করে পরিবারে, যেখানে সবচেয়ে নিরাপদে থাকার কথা, পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থার কারণে সেখানে তারা সর্বদাই নানা ধরনের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন এবং বঞ্চনার স্বীকার হয়ে থাকে। সাধারণভাবে নারীরা পরিবারে তাদের কোন মতামত প্রদর্শন করতে পারে না আবার পুরুষের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারে না। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে বিশ্লেষণে করলে একটি কার্যকরণ সম্পর্ক পাওয়া যায়। সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বিষয়টি সমস্যায় পরিণত হয় এবং এর সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলোও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। অধিকাংশ সমাজে লিঙ্গভেদে বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাওয়ায় নারীরা মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে এখনও অধিকাংশ নারী তাদের ভরণ পোষণের জন্য সম্পূর্ণভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় নির্যাতনের মাত্রা কিন্তু এখনও প্রকট, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় যেখানে নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য বিশেষ কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি সারা বিশ্বে আলোচিত বিষয় হলেও উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে এ সমস্যা প্রকট ছিল। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে এর মাত্রা বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, সংসার জীবনে শতকরা ৭২ ভাগ নারী তাদের স্বামী দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রহৃত হয়। ভারতে পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায়, গুজরাট রাজ্যে শতকরা ৬৫ জন নারী তাদের স্বামী কর্তৃক শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়। শ্রীলঙ্কাতে পরিচালিত জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৬০ শতাংশ নারী তাদের স্বামী কর্তৃক সহিংসতার স্বীকার হয়েছে। অন্যদিকে নেপালে একটি গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮৮ ভাগ নারী তাদের নিজ নিজ পরিবারে সহিংস আচরণের স্বীকার হয়। বর্তমানে উল্লিখিত সব দেশেই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে সহিংসতার ধরনে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। পূর্বে সহিংসতা যেখানে শুধু পারিবারিক পরিম-লে ছিল, এখন সেটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিম-লেও ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার জন্য প্রধানত দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, শিক্ষার অভাব, অর্থনৈতিক পরাধীনতা, নারীর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, আইনের অপপ্রয়োগ এবং সম্প্রদায়ের সহিংসতাকে অন্যতম মুখ্য কারণ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। দরিদ্র্যতার কারণে বাবা-মা কর্তৃক স্বীকৃত যৌতুকের টাকা যথাসময়ে পরিশোধ না করতে পারলে প্রকট নির্যাতন শুরু হয় এবং ফলস্বরূপ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে থাকে। তাছাড়া, কর্মক্ষেত্রে থেকে ফেরার পর স্বামীর যথাযথ সেবা শুশ্রƒষা করতে ব্যর্থ হওয়া এবং পরিবারের সামগ্রিক কাজ ঠিকভাবে সম্পাদনে অপারগ হলে নারীকে সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়। পারিবারিক সহিংসতার জন্য নারীর প্রতি অমানষিক নির্যাতনের কারণে নারী দুর্বল ও কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে সহিংসতার প্রকটতার কারণে নারীরা আত্মহত্যা করে থাকে। তাছাড়া, গর্ভকালীন সময়ে নির্যাতনের ফলে নারীর মৃত্যুও ঘটে থাকে। সামাজিকভাবে নির্যাতন ও অসম্মানের মুখোমুখি হতে হয় যা একজন নারীকে চরম বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়। কিন্তু বর্তমানে আশার কথা হচ্ছে, নারীরা বিভিন্ন ধরনের উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলছে। শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে নিজেদের যুক্ত করে সংসারের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে পাশাপাশি স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে দেশের উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। আমাদের বৈদেশিক আয়ের সিংহভাগ আসে পোশাক শিল্প থেকে যার অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। নারীরা এখন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, প্রকৌশলী, সরকারী চাকরিজীবী, শিক্ষক, এনজিওকর্মী প্রভৃতি পেশায় সুনামের সঙ্গে কাজ করে চলেছে। তবে এখনও বাংলাদেশে অধিকাংশ নারী পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহিংসতার স্বীকার। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে নবেম্বর মাস পর্যন্ত আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নারী নির্যাতনের চিত্র আঁতকে ওঠার মতো। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ধর্ষণের সংখ্যা ৮০৩টি এবং যার ফলে ৫৮ জন নারীর মৃত্যু হয়, ২০৪ জন নারী তাদের স্বামী এবং স্বামীর পরিবার দ্বারা প্রহৃত হয়ে মারা যান, যৌন নির্যাতনের ঘটনা ২০৯টি। যার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ জন নারী আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। যৌতুকের কারণে ৯৩ জন শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়, ১৭২ জনকে হত্যা করা হয় এবং ১০ জন আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, ৩৩টি এসিড সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। পাশাপাশি ফতোয়া এবং সালিশের মাধ্যমে ৯টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে নারীদের হেয় প্রতিপন্ন না করে, প্রতিদ্বন্দ্বী না ভেবে, সহযোগী ভাবার মতো উন্নত মানসিকতা বপন করতে পারলেই নারীর প্রতি সহিংসতা বহুলাংশে কমানো সম্ভব। বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ হওয়ায়, গ্রামে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রকট হওয়ার কারণে গ্রামের মানুষকে এ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে সহিংসতার মাত্রা অনেকটা কমে যাবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে নারী নির্যাতনের মতো সামজিক আন্দোলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সামনের কাতারে নিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে যাতে করে সহিংসতাকে নির্মূল করা সম্ভব হয়। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও নীতি নির্ধারকদের এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে যার ফলে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধ, সচেতনতাবোধ এবং নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন করে গড়ে তোলা যায়। যৌতুক প্রথা ও বাল্যবিবাহ বন্ধে প্রচলিত আইনের যথাযথ প্রয়োগের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এ পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন নারীর প্রতি সহিংসতা লাঘবে উৎকৃষ্ট প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে।
×