ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কাশ্মীরে চাঁদনী রাতে ডাল লেকে...

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

কাশ্মীরে চাঁদনী রাতে ডাল লেকে...

লিয়াকত হোসেন খোকন শ্রীনগরের রিসেপশন সেন্টার থেকে আধা কিলোমিটার পূর্বে কাশ্মীর সুন্দরী ডাল। গাগরিবাল, লাকুতি ডাল, বড়া ডাল- এই তিনের সমন্বয়ে ডাল লেক। নাগি লেক ডালের অংশবিশেষ। ভাসমান উদ্যান পৃথক করেছে এদের। এই ডালকে ঘিরে গড়ে উঠেছে পর্যটক বিনোদনের কাশ্মীর ব্যবস্থা। দৈর্ঘ্যে ৬ আর প্রস্থে ৩ কিলোমিটারের মতো। তবে পুরাতন শহর ডালের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে আর নতুন করে শহর বাড়ছে ঝিলামের দক্ষিণে। ডালের পাড় ধরে ইধঁষবাধৎফ জফ ঘাটের পর ঘাট, শিকারা যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে হাউসবোটে। আর ডানে সারি দিয়ে মিছিল করে দাঁড়িয়ে নানান হোটেল শ্রীনগরের। ডালের দক্ষিণে শঙ্করাচার্য আর পূর্বে হরি পর্বত প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে। মোগল গার্ডেনগুলোও গড়ে উঠেছে এই ডালেরই পাড়ের উত্তরজুড়ে। আর পশ্চিমে হজরতবাল মসজিদ। এই ডালের জন্যই নাম হয়েছে কাশ্মীরের প্রাচ্যের ভেনিস। পর্যটকদের জন্য রয়েছে জলজ হোটেল- হাউসবোট এই ডাল লেকেরই জলে পশ্চিমজুড়ে। জলও এর স্বচ্ছ। তবে হাউসবোট এবং শহরের জঞ্জালও পড়ছে ডালের জলে। এর আর এক আকর্ষণ ভাসমান উদ্যান। দ্বীপাকার এই উদ্যানে চাষবাস হচ্ছে। বসতিও গড়ে উঠেছে দ্বীপ থেকে দ্বীপে। স্থানান্তরও ঘটে থাকে এই ভাসন্ত দ্বীপের। জুন-জুলাই মাসে ডালের জলে পদ্মের সঙ্গে ওয়াটার লিলির শোভা মনোহর করে পর্যটকদের। সংযোগ ঘটেছে ঘুরেফিরে ১ কিলোমিটার দীর্ঘ খালপথে ঝিলামের সঙ্গে ডালের। আকার যেন দ্বীপের মতো। পসরা সাজিয়ে তর তর করে ছুটে চলেছে শিকারা বেয়ে দোকানি। এ দৃশ্যও ভুলবার নয়। শিকারা চেপে ডালে ভাসমান পর্যটকদের অনাবিল আনন্দ দেয়। এমনকি চাঁদের আলোও আগুন ধরায় ডালের জলে- সেও আর এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। নেহরু পার্ক ॥ শঙ্করাচার্য পাহাড়ের পাদদেশে বুলেভার্ড শেষ হতে ডালেরই অংশ গাগরিবাল দ্বীপে জওহরলাল নেহরুর স্মারক রূপে গড় তোলা হয়েছে নেহরু পার্ক। সান্ধ্য ভ্রমণের রমণীয় পরিবেশ রাতের আলোকসজ্জা দূর-দূরান্ত থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তবে পরিবেশের মাঝে কিছুটা বৈসাদৃশ যেন আলোর এই রোশনাই। চার চীনার ॥ ডালের বুকে আরও এক দ্বীপ। চারপাশে জল, মাঝে চারটি রাজকীয় বৃক্ষ চীনার অর্থাৎ দরখতে ফজল গাছ। নাম তাই চার চীনার। রেস্টুরেন্টও হয়েছে দ্বীপে। কবুতরখানা ॥ পাশেই আরেক দ্বীপে মহারাজাদের গ্রীষ্মাবাসে কবুতর বা পায়রাদের খানা খেতে দেয়া হতো। তাই এই নাম। দূর থেকে দেখতে হয়, পাড়ে ওঠার অনুমতি নেই। হরি পর্বত ॥ শহর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে ডালের পশ্চিমে সরিকা পাহাড়ের হরি পর্বতের শিরে ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাদশা আকবর দুর্গ গড়েন। দ্বিমতে দুর্গটি ১৮১২-এ কাশ্মীরের পাঠান শাসক আট্টাখানের তৈরি। শহর থেকেও ১২২ মিটার উঁচুতে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ ১০ মিটার উঁচু প্রাচীরে ঘেরা সঙ্কীর্ণ প্রবেশদ্বার। দেয়ালচিত্র, বিচিত্র ফার্সি ভাষায় উদ্ধৃতি উৎকীর্ণ, তবে আজ বিধ্বস্ত। বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দিরও ছিল সেকালে। আজ হয়েছে ফলের খেতি বসন্তে ফুল ফোটে, চারপাশের পরিবেশ মধুময় হয়ে ওঠে। পুরাণ বলে জলোদ্ভব অসুরকে বধ করতে পার্বতীর ছোড়া পাথরখ ই রূপ পেয়েছে পাহাড়ে। তবে আজ সামরিকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকায় অনুমতি লাগে রাজ্য পর্যটন থেকে দুর্গ দেখতে। চাঁদনী রাতে বসে আছি ডাল লেকের তীরে। দু’নয়ন ভরে দেখছি কাশ্মীরের রূপ। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন একজন দু’হাত দিয়ে চেপে ধরল আমারই দুটি চোখ। দেখার কি উপায় আছে? ভয়ে তো অস্থির। এদিক-ওদিক তাকাতেও পারছি না। মনে হয় হাত দুটি বড় মায়াময়। ভাবলাম, কাশ্মীরের এত রূপ, এখানেও কী এত কাঁটা! সেই কাঁটায় তো জড়িয়ে পড়লাম না আবার। কেন- গত ৬০ বছর ধরে কত না লোক বলিদান দিল, আমার ভাগ্যে আবার এমনটি ঘটতে যাচ্ছে না তো? তবুও তৃপ্ত এ জন্য যে, কাশ্মীর দেখেছি বারতিনেক। দূরদেশী একজন বাঙালীর জীবনে এমনি ঘটনা হয় তো কদাচিৎ ঘটে। হাত দুটি ছেড়ে দিয়ে মানুষটি বাংলা ভাষায় বলে উঠল- কি আমাকে চিনতে পেরেছেন তো? আমি যে সাকিব চৌধুরী...। চিনতে কি আর ভুল হয়? ও আরও বলল, সিলেটে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল... ভাদেশ্বরে যে বাড়ি। বলব, হঠাৎ এ দেখা আশ্চর্যজনক ঘটনা ছাড়া কিছুই যে নয়। সাকিব চৌধুরী আমাকে বুকে জড়িয়ে বলল, অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে যেন এক রূপকথার রাজ্য এই কাশ্মীর। এখানে দর্শনীয় স্থানের কি আর অভাব আছে! হাউসবোটে বসে দেখা মেলে মেঘ পাহাড়ের খেলা...। নিশাদবাগ, চশমাশাহী, পরীমহল, শালিমারবাগ, নাগিন লেক সবই মন ভোলায়। জানেন, এই চাঁদনী রাতে দু’চোখ কী যেন মোহমায়ায় জড়িয়ে পড়ছে। বিকেলবেলায় একনজর আপনাকে দেখেছিলাম। সেই থেকে ফলো করছি...। কথাগুলো শুনে মুগ্ধ না হয়ে যে পারিনি! সাকিব চৌধুরী বলল, চলুন ওই যে হাউসবোট- সারারাত ধরে ওখানেই থাকব। ওই যে দেখছেন, তুষারের মুকুট পরা সবুজ উপত্যকার পাহাড়- আমাকে যে হাতছানি দেয়। চলুন ওখানে দু’জনে মিশে যাই...। বড্ড ভাল লাগছে যে! সাকিব চৌধুরীর ইচ্ছাটা যে পূরণ করতেই হলো। হাউসবোটওয়ালাকে বললাম, সারারাত ডাললেকের রূপ দেখব- তা কত নেবেন? হাউসবোটওয়ালা একটু হেসে- যা খুুশি দেন সেটাই যে নেব। না দিলেও যে চলবে। কারণ, আপনারা দু’জন যে কাশ্মীরের প্রেমিক। যতদূর কল্পনা করেছেন তার চেয়েও বেশি এখানে- কাশ্মীর মাটির ওপর এক স্বর্গ। আপনাদের স্বপ্ন সত্যিই পূরণ হবে যে...। দু’জন হাউজবোটে গিয়ে বসলাম। দেখেই যাচ্ছি ডাল লেকের রূপ-সৌন্দর্য। সাকিব চৌধুরী বলল, ওই পাহাড়ের কাছে যেতে মন চায়। হাউসবোটওয়ালা জানাল, বাবু, সে কি সম্ভব! কখন যে কী হয় বলা তো যায় না। আপনি যে কাশ্মীর প্রেমিক সেটা কি সন্ত্রাসীরা বোঝে...? বোঝে না বলেই তো ওরা সন্ত্রাসী। কেন, ওরা পর্যটকদের ওপর আক্রমণ করে। দেশে দেশে কতিপয় মানুষের জন্যই আজ পৃথিবীটা অশান্ত হয়ে আছে। এক সময় মনে পড়ল বাঙালী মেয়ে গীতা দত্তের গাওয়া- ‘নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে চুপি চুপি বাঁশি বাজে বাতাসে...’ গানের কথাগুলো। যতই রাত বাড়ছে দু’চোখে কী যেন নেশা লাগল- সে নেশা শুধু কাশ্মীরের রূপেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আরও তো কিছু ছিল। মনের কথা না হয় মনেই থাক। হাউসবোটওয়ালা সাকিবের দিকে তাকিয়ে- তুমি কি আমাদের কাশ্মীরী? সাকিব চৌধুরী হাসল। ক্ষণিক পরে সাকিব চৌধুরী আমার হাত দুটি ধরে চুপি চুপি বলল, আমাকে দেখে কি কাশ্মীরী মনে হয়? কখন যে সকাল হয়ে গেল, তা বুঝতেই পারিনি। কাশ্মীরের রূপে দু’জন যে ছিলাম মাতোয়ারা। এক রাত হাউসবোটে ডাল লেকে বেড়ানোর সেই স্মৃতি তো ভোলার নয়! কী করেই বা ভুলব অপরূপ কাশ্মীরকে। এখনও যে দু’চোখের পাতায় ভাসে কাশ্মীরের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।
×