ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. সাবরিনা আনাম

শ্যামদেশের পথে পথে

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

শ্যামদেশের পথে পথে

বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটটি যখন সুবর্ণভূমিতে ল্যান্ড করছে তখন ঘড়িতে বিকেল পাঁচটা। বিমানের জানালা দিয়ে এয়ারপোর্টের রানওয়ে ছুঁয়ে থাকা ঘাস, মাটি, রোদ যেটুকু দেখা যায় তাতে স্বজাতি গোত্রের গন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা ‘সুবর্ণভূমি’ শব্দটির মধ্যে এতটাই বাঙালিয়ানা ভাব মেশানো যে বিদেশের মাটিতে ল্যান্ড করছি এমন মনে হলো না প্রথমে। পাঁচতলা বিশাল এয়ারপোর্টে পা রেখে আমাদের তো থৈ হারানোর দশা! কিন্তু ইমিগ্রেশন, কন্টেইনার থেকে সহজ লাগেজ রিসিভিং সিস্টেম, যানবাহনের সহজলভ্যতা বলে দিল এখানে হারানোর ভয় নেই। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ডড়ৎষফ ঠবঃবৎরহধৎু চড়ঁষঃৎু অংংড়পরধঃরড়হ এর আমন্ত্রণে আমার স্বামী প্রফেসর ড. মোঃ জালাল উদ্দিন যখন ব্যাঙ্কক গেলেন তাঁর সঙ্গী হলাম আমি এবং আমার মেয়ে নুসাইবা। আমাদের দল অবশ্য মোটে তিন জনে সীমিত ছিল না। সিসিমপুরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোঃ খলিলুর রহমান, তাঁর মিসেস মাহবুবা ইয়াসমীন রুমী, তাঁদের দুই সন্তান আজুয়া, মাহির ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ভেটেরিনারী সার্জন ডাঃ হেমায়েতুল ইসলাম আরিফ আমাদের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন। তো আমাদের আট সদস্যের এই ছোট্ট দল সুবর্ণভূমিতে পৌঁছলে বন্ধুবর রণজিৎ কুমার আমাদের রিসিভ করলেন। বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র সায়িন্টিফিক অফিসার জনাব রণজিৎ কুমার ব্যাঙ্ককের এআইটিতে তখন গবেষণা কাজে নিয়োজিত। সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্ট থেকে দুটি মাইক্রোবাসে আমরা রওনা হলাম। ব্রামুনগ্রাড, নানা পেরিয়ে গাড়ি এসে থামল সুকুমভিট ংড়র-৩ এলাকায়। সন্ধ্যায় সুকুমভিটের আশপাশে হাঁটতে বের হলাম। উদ্দেশ্য ছিল বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট খুঁজে দেখা এবং স্থানীয় পর্যটন সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া। প্রথমে আমরা যে গলিতে গেলাম তাকে মধ্যপ্রাচ্যের কোন এলাকা বললে ভুল হবে না। নাসির আল মাসরি, আল-হোসেন রেস্টুরেন্ট, নেফারতিতি রেস্টুরেন্ট থেকে পাওয়া গেল গ্রিল চিকেনের ঝাঁঝালো গন্ধ। অত্যন্ত পরিচ্ছন্নতা এবং শৃঙ্খলা বজায় রেখে স্ট্রিট হকার এবং ফুটপাথ রেস্টুরেন্টগুলো এখানে ব্যবসা করছে। জানা গেল সপ্তাহের বিভিন্ন দিন সময় ও স্থান নির্ধারণ করা থাকে ফুটপাথ ব্যবসায়ীদের জন্য। প্রথম দিন রাতে বাংলাদেশী মালিকানার রাজধানী রেস্টুরেন্টে গরম ভাত, মুরগির ঝোল, মসুর ডাল দিয়ে আমরা ডিনার সারলাম। খোঁজ পেলাম মনিকাস কিচেন, আমরা বাংলাদেশী, রাইজিং সান নামক আরও বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানের। পরবর্তী দিনগুলোতে মনিকা’স কিচেনই ছিল আমাদের আড্ডা মারা এবং ডিনার ও ব্রেকফাস্টের নির্ভরযোগ্য জায়গা। ঠিক হলো পর পর দুদিন আমরা বিভিন্ন পার্কে ঘুরব। প্রথম দিন আমরা গেলাম বিখ্যাত সাফারি ওয়ার্ল্ডে। এনিমেল শো, রিভার সাফারি, পর্যটকদের লাঞ্চ টাইম, প্রাকৃতিক পরিবেশে বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি নানান আইটেমে বিভক্ত সাফারি ওয়ার্ল্ড। রিভার সাফারিতে বৈঠাবিহীন নৌকায় চেপে গভীর বনে প্রবেশ করছি আমরা হঠাৎ তেড়ে এলো বন্যপ্রাণী। প্রাণ বাঁচিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখা হয়ে গেল উপজাতি মহিলার সঙ্গে। হঠাৎ প্রবেশ করলাম অন্ধকার গুহায়, যার মাথার ওপর অজগর কু-ুলী পাকিয়ে। তারপরেই ভিজে গেলাম ঝরনাধারায়। যখন একটু ধাতস্ত হলাম, বুঝলাম পুরো পরিবেশটাই আসলে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। লাঞ্চ টাইমে যে ডাইনিং হলে খাবার পরিবেশিত হলো সেটিও প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে প্রস্তুত এক অরণ্যই বলা যায়। সত্যি বলতে এখানকার প্রতিটি আইটেমেই ছিল চমক। সাফারি ওয়ার্ল্ডের আরেক আকর্ষণ ছিল ব্যাঙ্ককের বিভিন্ন স্কুলের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা। পরদিন সিয়াম পার্কেও তাদের দেখেছি দল বেঁধে আনন্দ করতে। বর্তমান যুগে ক্রেতার মনোস্তত্ত্ব বুঝতে পারাটা বিজনেস পলিসির একটা অংশ। ব্যাঙ্ককের জেমস গ্যালারি দেখে আমার মনে হয়েছে বিজনেসের এদিকটা তারা চমৎকারভাবে রপ্ত করেছে। ইষঁব ঝধঢ়ঢ়যরৎব, জঁনু, ঞড়ঢ়ধু, ঝধহফ ংঃড়হব, অয়ঁধসধৎরহব, অসবঃযুংঃ ইত্যাদি মূল্যবান পাথরের তৈরি গহনা যেমন আছে সেখানে তেমনি আছে শো পিস, ওয়ালেট, পার্স, ব্যাগ, কসমেটিকস এসব সামগ্রীও। পরদিন আমরা ঘুরলাম একটি থিম পার্কে। থাইল্যান্ডের থিম পার্কে সুইমিং পুলের পাশাপাশি স্মোকিং জোন রাখা হয়েছে। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা আর মানুষের স্বাধীনতায় প্রকৃত বিশ্বাসী হলেই বুঝি এ ধরনের সমন্বয় সম্ভব। ব্যাঙ্কক থেকে ১৭৫ কিমি দূরে পাতায়া। আমরা ঠিক করলাম সারাদিন পাতায়া ঘুরে এসে সুকুমভিটেই রাত্রি যাপন করব। ট্রাভেল এজেন্সির গাড়ি সকাল সাড়ে সাতটায় এসে হাজির হলো আমাদের হোটেলের সামনে। সেদিন মনিকাতে আমাদের নাস্তা করা হলো না। চনবুরি পেরিয়ে বেশকিছু ইন্ডিয়ান ফুড রেস্টুরেন্ট আছে, ঠিক হলো সেখানেই সকালের নাস্তা সেরে নেয়া যাবে। ব্যাঙ্কক থেকে পাতায়ার দিকে ছুটল গাড়ি। ১৭৫ কি.মি. রাস্তার প্রায় পুরোটাই দু’পাশে ফেঞ্চ দেয়া। ফোর লেনের হাইওয়েতে কোথাও কোন বাধা বিপত্তি পেলাম না। ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে মাইক্রোবাস এগিয়ে চলল। এখানে একটি কথা না বললেই নয়, তা হলো এক সপ্তাহের ট্যুরে থাইল্যান্ডে কোথাও কোন গাড়ির হর্ণ শুনতে পাইনি আমরা। শহরের ভেতর অল্প স্বল্প যানজট থাকলেও তা সাউন্ডলেস। আর হাইওয়ে তো সম্পূর্ণ অবসটেকল মুক্ত। মাত্র ঘণ্টা দু’য়েকের ভেতর পাতায়া বিচে আমরা পৌঁছে গেলাম। পাতায়ার নীল জলরাশির ওপর তখন সকালের সূর্যরশ্মির বিচ্ছুরণ হচ্ছে। ছোট্ট সৈকত, ছিমছাম, গোছানো। খলিল ভাই বললেন পাতায়ার সৌন্দর্য দেখতে হলে কোরাল আইল্যান্ডে যেতে হবে। স্পিডবোটে সে জার্নি বেশ রোমাঞ্চকর। পাতায়া থেকে ১৭ কি.মি. দূরে কোরাল আইল্যান্ড। (চলবে)
×