ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রহমান মতি

মধুসূদনের অন্য বিদ্রোহ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

মধুসূদনের অন্য বিদ্রোহ

সাহিত্য শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত শিল্পপ্রয়াস। সেখানে কারো একক প্রয়াসে পূর্ণাঙ্গ ঐশ্বর্য আসে না। সাহিত্যিকগণ যার যার মতো করে তাঁদের ব্যক্তিক সৃজন তুলে ধরেন একসময় তার আকার হয়ে ওঠে সামষ্টিক। এভাবে সাহিত্যিকগণ সাহিত্যকে ঐশ্বর্য দিয়ে যান, সাহিত্য হয়ে ওঠে শস্যশ্যামল। লেখক মাইকেল মধুসূদন দত্তের শিল্পপ্রয়াস অন্যান্য সাহিত্যিকের সঙ্গে সম্মিলিত প্রয়াসে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে ঔজ্জ্বল্যের দ্যুতি মধুসূদনের নানা মাত্রার সাহিত্যের একটি সুন্দর মালাবিশেষ। লেখক হিসেবেই তিনি সেখানে বর্ণনার জন্য আসেন কারণ তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্র অনুযায়ী সাহিত্যচর্চা করেছেন যা বৈচিত্র্যময়। ২. উনিশ শতকের সময়কে চিন্তা করলে একজন কবি হিসেবে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁর সময়ের থেকে অন্তত এক শতাব্দী অগ্রবর্তী মনে হয়। তাঁর কাব্যদর্শনে উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কৃতি যেভাবে ছিল তাকে ছাপিয়ে বিশ শতকের পরেও এখনকার সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। তাঁর লেখকসত্তায় একজন কবি, মহাকবি, পত্রকাব্য রচয়িতা, সনেট রচয়িতা, নাট্যকার, প্রহসন রচয়িতা ইত্যাদির যোগফল আছে। উনিশ শতকে একসঙ্গে এত লেখার সন্নিবেশন খুব একটা দেখা যায় না। অনেক উপাদানের মধ্যে বর্তমান প্রবন্ধে কিছু উপাদানকে ঘিরে তাঁর সাহিত্যসাধনার মৌলিক দিক খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। মধুসূদন তাঁর শিল্পসৃজনে স্রোতের বিপরীতে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে বিভিন্ন সাহিত্য উপকরণে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সমাজ কাঠামো বা চিন্তার কাঠামোতে হরহামেশা যে ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার থেকে বেরিয়ে তিনি আলাদাভাবে তাকে সাজানোর সাধনা করেছেন। এ সাধনা তাকে দর্শনের দিক থেকে শিল্প-সাহিত্য সৃজনে অন্যরকম বিদ্রোহী করেছে। সে বিদ্রোহের বীজে আছে ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ইত্যাদি। সবকিছু একসঙ্গে করলে মধুসূদন উনিশ শতকের সে বিদ্রোহে তাঁর সব সাহিত্যপ্রয়াসের মাধ্যমে প্রথম আধুনিক লেখক। ৩. ‘মানুষ যখন যুক্তিতে আস্থা আনে, যখন সে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে, যখন সে মানুষকে মানুষ বলে গণ্য করে তখন সে হয়ে ওঠে আধুনিক’ - শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, হুমায়ুন আজাদ খুব নিবিড়ভাবে দেখলে নানারকম তত্ত্বের সঙ্গে মধুসূদনের শিল্পসাধনাকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। কিন্তু তত্ত্বের মধ্যে প্রবেশ করলে তাতে ভারাক্রান্ত হওয়ার একটা বাড়তি ভয় থাকে। বরং বিশ্লেষণে আস্থা রেখে ভাবনার ডালপালা মেললে তার থেকে ভালো কিছু মেলে। আধুনিকতার যে সংজ্ঞা হুমায়ুন আজাদ দিয়েছেন তাঁকে দিয়ে মধুসূদনের সমগ্রতাকে ধরা যায়। মধুসূদন হুমায়ুন আজাদের এ ধারণার সঙ্গে খাপ খান। কথাটি বর্তমান প্রবন্ধের পুরোটাতেই থাকবে। মধুসূদনের সমগ্র শিল্পসাধনার কয়েকটি থেকেও তাঁর সে বিদ্রোহকে উপলব্ধি করা সম্ভব। একজন ব্যক্তি মধুসূদন যখন ভিনদেশের আকর্ষণে স্বদেশ ছেড়ে প্রথমে ফ্রান্স ও পরে ইংল্যান্ডের মুখাপেক্ষী হলে তাঁর জীবনের একটি পরির্তনের সুর আসে। পরিবর্তনটি তাঁকে স্বদেশী সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকে আকৃষ্ট করায়। ইংরেজী ভাষায় ‘ক্যাপটিভ লেডি’ লিখে তাঁর বিদেশী বাজার ধরার চেষ্টাতে মধুসূদন যখন ব্যস্ত পরিণতিতে তাঁর স্বপ্ন ভেঙে যায়। তিনি তখনই বুঝতে পারেন স্বদেশী সাহিত্য উপকরণের বিকল্প নেই। মূলত মধুসূদন উচ্চবিত্ত হওয়ায় ফ্রান্সের নাগরিক সমাজের মনোজগতকে উপলব্ধি করতে দেরি করেছেন যার কারণে তাঁর উপলব্ধিতে এসেছে বইটির বাজার মন্দা হওয়ায় এবং তাঁর আশা অনুযায়ী পাঠক প্রতিক্রিয়া না পাওয়াতে। তিনি যখন বাংলাদেশের জল-মাটি-হাওয়া নিয়ে কাব্য সাধনায় লেগে যান সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয় মৃত্যু অবধি। একটি ‘কপোতাক্ষ নদ’, ‘বঙ্গভাষা’ বা ‘কবি মাতৃভাষা’ কবিতাই তখন তীক্ষ্ম বাস্তববাদী বিদ্রোহের দিকে যায়। ভাবছেন একে স্বদেশপ্রেম না বলে ‘বিদ্রোহ’ কেন বলছি। মূলত ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বিদ্রোহ বা নিজের সঙ্গে নিজের বিদ্রোহই এ কবিতাগুলোতে প্রধান শক্তি। ভুল বোঝার পরে একজন মানুষ যখন নিজেকে ‘নতুন মানুষ’ হিসেবে আবিষ্কার করে তখনই ব্যক্তিবিদ্রোহ ঘটে। কবিসত্তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মধুসূদন একজন মানুষ আর মানুষ হিসেবে তার উপলব্ধিতে তিনি অনুশোচনায় যেমন দগ্ধ তমনি ব্যক্তিবিদ্রোহে বারবার নিজেকে পোড়ান কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে-‘অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায় মনঃ/মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি’ (বঙ্গভাষা)। যকে বরণ করা যায় না তাকেই প্রথমে বরণ করেছেন তাইতো উপলব্ধিতে আসার পরে নিজেকেই বার বার পোড়ান সেই ব্যক্তিক বিদ্রোহে কেন তা করলেন তিনি। আত্মবিশ্লেষণ তো অবশ্যই। মহাকাব্য বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি নেই। যেগুলো আছে তার মধ্যে মধুসূদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ আদর্শ। মধুসূদন তাঁর বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে চিঠিতে লিখেছেন- আমি রাম ও বানরবাহিনীকে ঘৃণা করি। রাবণের ধারণা আমার ভাবনাকে উস্কে দেয় এবং আমার কল্পনাকে প্রজ্বলিত করে।’ মধুকবি এ জায়গাটিতেই মেঘনাদকে বিসর্জন দেন লক্ষণের হাতে আর অন্যদিকে পুত্রশোকে কাতর প্রতিশোধপরায়ণ রাবণ হন তাঁর ‘উস্কে দেয়া ভাবনার দ্যোতক।’ কৃত্তিবাস তাঁর ‘রাজনীতি-শিক্ষা’ অংশে ‘রামায়ণে’র লঙ্কাকাণ্ডে রাবণকে নায়ক প্রমাণ করেন আর তার পরবর্তীকালের নির্মাণে রাবণকে নায়ক হিসেবে সূক্ষ্ম প্রয়োগ করেন মধুসূদন। পুত্রশোকে প্রতিশোধপরায়ণ রাবণ নিজেও জীবন দেন শেষে। নায়কের মৃত্যুতে যে ট্র্যাজেডির সংজ্ঞা হয় সেখানে নির্মাণে বিদ্রোহ আছে রাবণকে ঘিরে। রাবণের পুত্র মেঘনাদ যজ্ঞঘরে লক্ষণকে প্রবেশ করার সুযোগ দেয়া বিভীষণকে উদ্দেশ করে যে কথাগুলো বলে- ‘হে রক্ষোরথি, ভুলিলে কেমনে কে তুমি? জনম তব কোন মহাকূলে কেবা সে অধম রাম? স্বচ্ছ সরোবরে করে ফেলি রাজহংস পঙ্কজ কাননে যায় কি সে কভু, পঙ্কিল সলিলে শেবালদলের ধাম?’ (ষষ্ঠ সর্গ, মেঘনাদবধ কাব্য) জাতিগত আত্মপরিচয় যেখানে বিভীষণ হারিয়ে ফেলে সেখানেই বাঙালী জাতির অন্তর্গত ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যকে আঘাত করেন মধুসূদন। বাঙালী তাঁর আত্মপরিচয় আজও ভুলে যায় ভিনদেশীর কবলে পড়ে। ভিনদেশী সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার বিষয়ে আজো তার বড় একটি অংশ উদ্বাহু থাকে। নিজের সংস্কৃতিকে ছোট করে হলেও তারা তা করে থাকে। মধুসূদনের ব্যক্তিবিদ্রোহ মেঘনাদকে দিয়ে এভাবেই স্বচ্ছ করে দেখান। বিদ্রোহে প্রতিবাদটি পুরুষের পাশাপাশি নারীও করেছে এ মহাকাব্যে। যেমন-প্রমীল করেছে। তাঁর কণ্ঠ থেকে শোনা গেছে- ‘রাবণ শ্বশুর মম মেঘনাদ স্বামী আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে’ নারীর যে বিদ্রোহকে বিশ শতকে সাহিত্য ও সমাজ সংস্কারে দেখা গেছে তার বীজ এভাবেই ছিল মধুসূদনের কলমে। এর পাশাপাশি যদি তাঁর পত্রকাব্যগুলোর কথা বলা যায় তবে সেখানেও নারীর বিদ্রোহ পুরুষ আধিপত্যের বিপরীতে ভালোভাবেই আছে। সমাজে ব্যক্তির খোলস উন্মোচনে ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনটি মধুসূদনের বিখ্যাত রচনার একটি। কলকাতার নব্যশিক্ষিত নবকুমারের ছদ্মবেশী ব্যক্তিস্বভাবকে তুলে ধরার মাধ্যমে মধুসূদন আধুনিক মানুষের স্বেচ্ছাচারকে ইঙ্গিত করেন। নবকুমারের ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভা’ প্রতিষ্ঠার আড়ালে তার মদ খাওয়া ও বেশ্যার শরীর ভোগের ছদ্মবেশ আজকের সমাজেরই নোংরামিকে দেখায়। মধুসূদন এখানে প্রাতিষ্ঠানিক নোংরামিও দেখান। কারণ প্রতিষ্ঠানের আদর্শকে পুঁজি করে ব্যক্তিরা এভাবেই তাদের নানা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক কাজকর্ম চালায়। ঘুষ, আমলাবাজিতে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করে আর সাইনবোর্ড হয় প্রতিষ্ঠান। উনিশ শতকে যে সমাজকে মধুসূদন দেখাচ্ছেন আজকের একুশ শতকে এসে তার বাস্তবতা এতটুকু কমেনি বরং অনেকগুণ বেড়েছে। অন্যদিকে ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটিতে জমিদারপ্রথার প্রভাব দেখান। জমিদারপ্রথা আজ বিলুপ্ত হলেও এর প্রভাব বিলুপ্ত হয়নি। ভূমিদস্যুর সামাজিক উত্থান জমিদারপ্রথারই একটা সংস্করণ। সেখানে থাকে দুটি শ্রেণি- শোষক ও শোষিত। এ প্রহসনে ধর্মকে ব্যবসা হিসেবে ব্যবহার করে শোষিত মানুষের বিশ্বাসে আঘাত করে তাদের সর্বস্ব লুট করার যে সামাজিক বাস্তবতা সেখানে ভক্তপ্রসাদকে ব্যঙ্গ করা এ লাইনগুলো- ‘বাইরে ছিল সাধুর আকার মনটা কিন্তু ধম্মধোয়া পুণ্যখাতায় জমা শূন্য ভণ্ডামিতে চারটি পোয়া।’ মধুসূদন তাঁর সময় থেকে এভাবেই অগ্রবর্তী। মানুষের মধ্যে ব্যক্তি, কখনো ব্যক্তিলেখক, গোষ্ঠী বা সমাজ, দেশ এ তিন অধ্যায়ে মধূসূদন তাঁর লেখক দর্শনে ক্ষেত্রমতে বিদ্রোহ করেছেন। সে বিদ্রোহ সমাজ কাঠামোর প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে করা। তিনি তাঁর বিদ্রোহে তাঁর কালকে কাটিয়ে একালের স্রোতে মিশেছেন ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রে। এ ব্যাপ্তিতে তিনি সর্বাংশে যুক্তিনিষ্ঠ আধুনিক।
×