ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

বেতন বৃদ্ধির আওতাবহির্ভূত লোকজনদের কী হবে?

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২২ জানুয়ারি ২০১৬

বেতন বৃদ্ধির আওতাবহির্ভূত লোকজনদের কী হবে?

বিদেশী খবরের মধ্যে বড় খবর হচ্ছে চীনা অর্থনীতির। আর দেশী খবরের মধ্যে অর্থনীতির খবর অনেক। দেখা যাচ্ছে বিগত ২৫ বছরের মধ্যে চীনের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনকি তাদের প্রবৃদ্ধির হার ২০১১ সাল থেকে ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে। ২০১১ সালে চীনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে তা হ্রাস পেয়ে হয়েছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর সামান্য কমলেই তা আমাদের সমান হবে। বিপরীতে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার আর সামান্য একটু বাড়লেই আমরা চীনাদের ধরে ফেলি। চীন সরকার তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। কিন্তু খুব বেশি ফল দেখাতে পারছে না পদক্ষেপগুলো। বিদেশী ‘ফিন্যান্সিয়েল ইনস্টিটিউশনগুলো’ চীনে কোন ‘ক্যাশ রিজার্ভ’ রক্ষা করত না যা দেশীয় ব্যাংকগুলো করে। চীন নিয়ম করেছে এখন থেকে বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ‘ক্যাশ রিজার্ভ’ রাখতে হবে। এর অর্থ বিদেশী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সমগ্র আয় বিদেশে পাঠাতে পারবে না। কিছু চীনা মুদ্রা রিজার্ভ রাখতে হবে। এতে চীন থেকে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে যাওয়ার পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এদিকে চীন ইস্পাতের দাম এমনভাবে হ্রাস করেছে যে, ভারতীয় ইস্পাত কোম্পানিগুলো ইউরোপের তাদের কার্যক্রম হ্রাস করতে বাধ্য হচ্ছে। বহু শ্রমিকের চাকরিচ্যুতি ঘটছে এতে। এটা চীন করেছে তাদের বাজার, মানে রফতানি বাজার ঠিক রাখার জন্য। কিছুদিন আগে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে গভীর সম্পর্কের দেশ মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশের খারাপ অবস্থার কথা লিখেছিলাম। মোট কথা চীনের দুর্দিনে আমাদের সুখে থাকার কোন সম্ভাবনা নেই। রফতানি ও আমদানির মাধ্যমে বাজার অর্থনীতির পৃথিবী এমন এক জায়গায় গিয়েছে যে একের অধঃপতনে অন্যের আনন্দের কোন সুযোগ নেই। অতএব বাইরের পৃথিবীতে কী ঘটছে সে সম্বন্ধে নিত্য খবর নিতে হবে বাংলাদেশকে। এখনও বিশ্বের বাজারে তেলের দাম হ্রাস পাচ্ছে। তেলের দাম বিশ্ববাজারে হ্রাস পাওয়ার সুফল আমরা পাচ্ছি। কিন্তু এই সুফল একচেটিয়া সুফল নয়। এর ভাল-মন্দ দুটো দিকই আছে। তেলের দাম হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও সরকার অভ্যন্তরীণ বাজারে তেলের দাম কমায়নি। বহু দাবি উঠেছে, চারদিকে কথা, কিন্তু সরকার একটা সুবিধার জন্য দাম কমায়নি। দুর্দিনে সরকার তেলের ওপর প্রচুর ভর্তুকি দিয়েছে। সেই ভর্তুকি মানেই লোকসান। এর চাপ সরকার কতটুকু বোধ করেছে তার চেয়ে বেশি বোধ করেছে সরকারী ব্যাংকগুলো। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে ‘বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন’ (বিপিসি) সমানে ঋণ নিয়েছে। সেই টাকা তারা শোধ করতে পারেনি। সরকার কী করেছে? সরকার তাদেরকে সস্তা সুদের বন্ড ধরিয়ে দিয়েছে। ফলে সরকারী ব্যাংকের লাভের পরিমাণ কমেছে। এর জন্য সরকারী ব্যাংকগুলোকে মিডিয়ার কাছ থেকে গাল খেতে হয়েছে। দেশবাসী তাদেরকে ভুল বুঝেছে কিন্তু ব্যাংকের কোন লাভ হয়নি। এখন হয়েছে উল্টো। তেলের দাম কমা সত্ত্বেও সরকার অভ্যন্তরীণভাবে গ্রাহকদের কোন স্বস্তি দেয়নি। উদ্দেশ্য অতীতের লোকসান পুষিয়ে নেয়া। হাজার হাজার কোটি টাকার ভর্তুকিজাত লোকজন পুষিয়ে নেয়া। কত বড় ঘটনা জনসাধারণকে কোন স্বস্তি না দিয়ে সরকার অতীতের লোকসান পুষিয়ে নিচ্ছে। সুখবর সরকারের জন্য, দুঃসংবাদ গ্রাহকদের জন্য, ভোক্তাদের জন্য। দুঃসংবাদ আরও একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য। আবার সেই সরকারী ব্যাংক। সরকারী ব্যাংক বিপিসির লোকসান ফিন্যান্সিংয়ে অভ্যস্ত। তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা ঋণ দিতে অভ্যস্ত। এর কোন হিসাব দিতে হয় না বাংলাদেশ ব্যাংককে। কিন্তু হঠাৎ যখন তারা ঋণ নেয়া বন্ধ করে দেয় তখন সরকারী ব্যাংকগুলো পড়ে আরও বিপদে। তাদের এমনিতেই প্রচুর টাকা হাতে, মানে অতিরিক্ত নগদ টাকা হাতে (অতিরিক্ত লিক্যুইডিটি)। তার ওপর একটা বড় পার্টি ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা পড়েছে মহাবিপদে। কারণ সরকারী ব্যাংক আবার বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত সিলিংয়ের বাইরে ঋণ দিতে পারে না। এটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ। শোনা যাচ্ছে তেলের দাম অভ্যন্তরীণ বাজারে সরকার কমাতে পারে। একথা বহুদিন যাবতই শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এতে কী ব্যাংকগুলো লাভবান হবে। সরকারী ব্যাংকের এতে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণ তেলের দাম এমনভাবে সরকার কমাবে না যাতে তার লোকসান হয়। অতএব লোকসান ফিন্যান্সিংয়ের কোন সম্ভাবনা নেই। সরকারী ব্যাংকের জন্য আরেকটা দুঃসংবাদ দেখলাম কাগজে। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া কমাবে। সরকারের এ ধরনের ঋণ নাকি অর্ধেকে নামবে। এতে এই ব্যাংকগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হবে। সরকারকে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলো কিছু সুদ আয় করতে পারে। সরকার যদি সেই ঋণ না নেয় তাহলে বিদ্যমান নিয়মে ঐ ব্যাংকগুলোর করণীয় আর কিছু থাকবে না। কারণ তারা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত উর্ধসীমার বাইরে কোন ঋণ দিতে পারবে না। এ সব খবর পাঠ করে কী বোঝা যায়? বোঝা যায় সব ভাল খবরের অন্তরেই খারাপ খবর নিহিত। আবার সব খারাপ খবরই খারাপ নয়। আসলে অর্থনীতির একটা সমস্যার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। এই যেমন বেতন বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি। বেতন বৃদ্ধি আনন্দের খবর। তাও কী? দ্বিগুণেরও বেশি বেতন বৃদ্ধি। তার ওপর আবার পহেলা বৈশাখের বোনাস। আনন্দের সীমা নেই। যদিও এই আনন্দ মাত্র ৮-১০ লাখ লোকের জন্য। কারণ এরাই সরকারী কর্মকর্তা বা কর্মচারী। সীমিত সংখ্যক কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আনন্দের সঙ্গে নিরানন্দ কিভাবে মিশ্রিত আছে তা দেখা যাক। প্রথম নিরানন্দের খবর তারাই। এত বেতন বৃদ্ধির পরও কেউ খুশি নয়। চারদিকে আন্দোলনের খবর। সবাই খুশি নয়। বেতনের প্রশ্ন বড় নয়, প্রশ্ন ‘ইজ্জতের’। আসলে দুটোই প্রশ্ন যদিও বৃহত্তর প্রশ্ন আলোচিত নয়। বেতন বাড়ল সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। কিন্তু বাড়ি ভাড়া, বিদ্যুতের বিল, গ্যাসের বিল, যানবাহনের খরচ বাড়ল সবার। স্কুলের শিক্ষার খরচ বাড়ল সবার। এক ড্রাইভার আমাকে বলল তার দেড় ঘরের ভাড়া দুইমাস আগেই বেড়েছে এক হাজার টাকা। বিদ্যুতের বিলের জন্য এবং গ্যাসের জন্য আরও বেড়েছে ছয় শত টাকা। অথচ মজার ঘটনা হচ্ছে তার বেতন-ভাতা তো বাড়েনি। আনন্দের খবর কাদের আর নিরানন্দের খবর কাদের? আসল কথা হচ্ছে বেতন-ভাতা বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়বে মূল্যস্ফীতি। এর থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। বেতন বৃদ্ধিতে সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তাদের মধ্যে যাদের নিজের বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে তাদের লাভ, যাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেষ তাদের লাভ। নিচের শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কোন লাভ নেই। বৃদ্ধির টাকা বাড়িওয়ালা এবং বাজার ছিনতাই করে নিয়ে যাবে। এখন শীতকাল। শাক-সবজির দাম কমার কথা। কিন্তু কোনটারই দাম কমেনি। স্ট্যান্ডার্ড দাম এখন ৬০ টাকা কেজি। মজা হচ্ছে এটা জানা সত্ত্বেও কেউ বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবি ছাড়বে না। সবাই জানি বেতন বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবু বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন চলবে। আসলে দরকার ছিল স্থিতিশীলতার কিন্তু সেটি হওয়ার নয়। সরকার যেটা করে টাকার ক্রয়ক্ষমতা যেহেতু হ্রাস পায় তাই বেতন বৃদ্ধি করে তা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এটা বেতন বৃদ্ধি নয় বরং এটা বেতনকে অর্থাৎ বিদ্যমান বেতনকে ‘প্রোটেকশন’ দেয়া বোঝায়। অতএব বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে যাদের বেতন বাড়ার কোন কারণ নেই। তাদের কী হবে সে বিষয়ে চিন্তা করার। ‘ইজ্জত’ নিয়ে যারা ভাবছেন, আন্দোলন করছেন তাদের কী উচিত নয় বেসরকারী লোকজনের কথা চিন্তা করার? দেশে তো লোক ১৬ কোটি ১০ লাখ, ২০ লাখ খেয়ে পরে বাঁচবে, ভাল থাকবে, সরকার এদেরকে দেখবে, ডেকে ডেকে কথা বলবে, বাকিদের কী হবে? গতকাল গিয়েছিলাম মেডিক্যাল টেস্ট করতে। সেখানকার পিয়নের বেতন ছয় হাজার টাকা। তার অবস্থার কথা কে ভাববে? তার সঙ্গে কথা বলার কে আছে? লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×