ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৬

শান্তির সপক্ষে দাঁড়াবে দেশবিদেশের কবিতা জয়গান হবে মৈত্রীর

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২১ জানুয়ারি ২০১৬

শান্তির সপক্ষে দাঁড়াবে দেশবিদেশের কবিতা জয়গান হবে মৈত্রীর

মোরসালিন মিজান ॥ কিছুটা হলেও গত হয়েছে সুসময়। বাংলা কবিতার অদ্ভুত সুন্দর কাল আমরা পেছনে ফেলে এসেছি। এক সময় যাপিত জীবনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি অভিজ্ঞতা ফুলের মতো ফুটে ওঠতো কবিতায়। প্রিয় পঙ্ক্তিতে প্রেম ছিল। টগবগ করে ওঠতো প্রতিবাদ। খুব বন্ধ্যা সময়েও এগিয়ে যাওয়ার সাহস যোগাত। হেলাল হাফিজের ভাষায়- কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোন অ-সুখে,/ নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,/ পথিক এ পথে নয়/ ‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’...। পথ দেখিয়ে চলার এ সক্ষমতা এখন কতোটা রাখে কবিতা? এ প্রশ্নে বহুমুখী আলোচনা হতে পারে। তবু কবিতার যে শ্রেষ্ঠত্ব, অস্বীকার করা যাবে না। একই কারণে নানা ঘাটতি সত্ত্বেও কবিতার জাতীয় উৎসবটি বিপুল প্রশংসাধন্য। বছর ঘুরে আবারও এসেছে সময়। ইতিহাস সৃষ্টি করা কবিতা উৎসব শুরু হচ্ছে ভাষার মাসের প্রথম দিন ১ ফেব্রুয়ারি থেকে। দুই দিনব্যাপী উৎসব উপলক্ষে সরগরম আয়োজক কবিতা পরিষদের কার্যালয়। চলছে জোর প্রস্তুতি। প্রেক্ষাপটটা কারও অজানা নয়। ১৯৮৭ সালের কথা। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন স্বৈরাচার এরশাদ। সামরিক শাসকের বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে গণতন্ত্র। বাকস্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। উল্টো যে কবিতা সত্যের সুন্দরের, সেই কবিতাও গিলে খাওয়ার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। পুষ্য কবিরা মাঠে। ঠিক তখন সূচিত হয় জাতীয় কবিতা উৎসবের। সৈয়দ শামসুল হকের ভাষায়- ‘তখন আমাদের কবিদের কাঁধে ইতিহাস দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। আমরা ভাঙ্গনের ওপরে নির্মাণের জন্য এগিয়ে আসি। শুরু হয় জাতীয় কবিতা উৎসব।’ প্রথম আয়োজন হলেও, এ উৎসব স্বৈরচারের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা থেকে শুরু করে দেশের সব বরেণ্য কবিরা এক মঞ্চে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন। কবিতার শক্তি স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলকে নতুন গতি দিয়েছিল। এভাবেই রচিত হয় গৌরবের ইতিহাস। কখনও কখনও ছন্দপতন হয়েছে বটে, থেমে থাকেনি। এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাতীয় কবিতা উৎসব ২০১৬। দুই দিনব্যাপী উৎসবে যোগ দেবেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কবিরা। বিদেশ থেকেও আসছেন নানা ভাষার কবি। কেউ নিজের লেখা কবিতা পড়বেন। কেউ আবৃত্তি করবেন প্রিয় কবি থেকে। বলবেন কবিতার কথা। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হবে। থাকবে সেমিনার। সবই কবিতাকে ঘিরে। এবার অপেক্ষাকৃত সুসময়ে সুন্দর সময়ে আয়োজিত হচ্ছে উৎসব। দেশের রাজনীতি যথেষ্ট স্থিতিশীল। স্বাধীনতাবিরোধী শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ যথানিয়মে এগিয়ে চলেছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে দোষীদের দ- কার্যকর করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে চলেছে সোনার বাংলা। আর যে দুঃখজনক কালো অধ্যায় সেখানে মৌলবাদী আস্ফালন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে লেখকের রক্তে ভেসে গেছে টিএসসি। প্রকাশক প্রাণ দিয়েছেন নিজ অফিসে। বিশ্ববাস্তবতাও ভয়ঙ্কর। ক্ষমতা বিস্তারের যুদ্ধে ল-ভ- মানবতা। পৃথিবীর বহুদেশ জ্বলছে অশান্তির আগুনে। এমন বাস্তবতায় কী বলার আছে কবিতা উৎসব থেকে? বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা। উত্তরে আয়োজকরা জানাচ্ছেন এবার তাঁদের মর্মবাণীÑ কবিতা মৈত্রীর কবিতা শান্তির। হত্যার বিরুদ্ধে ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে শান্তির কথা বলবে কবিতা। বাংলাদেশ ছাড়াও অন্য দেশগুলোর প্রতিনিধিরা তাঁদের দেশের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বিশ্ব প্রেক্ষিতে শান্তিতে কবিতার ভূমিকা বর্ণনা করবেন। কবিতার মধ্য দিয়ে কীভাবে মৈত্রীর পক্ষে বলা যায় তা ব্যাখ্যা করবেন। উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে এবার দেশের সকল কবিদের অংশগ্রহণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আয়োজকরা প্রবীণের সঙ্গে নবীনের মেলবন্ধন ও ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিলন ঘটাতে চান। তাই খ্যাতির শীর্ষে থাকা কবিদের উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তেমনি প্রতিশ্রুতিশীল নবীনদের বরণ করে নেয়ার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। নতুন দিনের নতুন কবিরা নতুন স্বপ্নময় কবিতা নিয়ে মঞ্চে থাকবেন বলে আশা করছে পরিষদ। আয়োজকরা জানান, যথারীতি উৎসব উদ্বোধন করবেন কবি সব্যসাচী সৈয়দ শামসুল হক। উদ্বোধনী দিন সকালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও শিল্পী কামরুল হাসানের সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এরপর উৎসবস্থলে জাতীয়সঙ্গীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন, একুশের গান ও উৎসব সঙ্গীত পরিবেশিত হবে। মঞ্চের আয়োজন শুরু হবে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ ও ঘোষণা পাঠের মধ্য দিয়ে। পরে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা। বর্তমান সময় ও কবিতায় করণীয় বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখবেন সৈয়দ শামসুল হক। বিকেল থেকে শুরু হবে কবিতা পাঠ ও সেমিনার। দ্বিতীয় দিনেও থাকবে অভিন্ন আয়োজন। সারাদেশ থেকে আসা কবিরা নিজেদের কবিতা পড়বেন। উৎসবে ৭ থেকে ৮টি দেশের কবিরা উপস্থিত থাকবেন। নিজেদের রচনা থেকে পাঠ করবেন তারা। চলবে আদান-প্রদান। সব মিলিয়ে বড় আয়োজন। প্রস্তুতিও অনেক। গত কয়েকদিন টিএসসির উৎসব দফতরে গিয়ে দেখা যায়, নিবন্ধনের কাজ চলছে। একাধিক কর্মী নিয়োজিত আছেন এ কাজে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের যারা উৎসবে কবিতা পড়তে আগ্রহী তারা নাম নিবন্ধন করছেন। আয়োজন প্রসঙ্গে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত জনকণ্ঠকে বলেন, উৎসবের সকল প্রস্তুতি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অতীতের ঐতিহ্য ও গৌরবের কথা বিবেচনায় রেখেই আয়োজন করা হবে কবিতা উৎসব ২০১৬। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, কবিতা উৎসব আগের গাম্ভীর্য অনেকখানি হারিয়েছে। যথেষ্টই শ্রীহীন। এ বিষয়ে কী বলবেন? জানতে চাইলে নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক বলেন, ভাবগাম্ভীর্য কমেছে বলা যাবে না। তবে, শ্রী কিছুটা হয়ত কমেছে। এজন্য পৃষ্ঠপোষকতার অভাবকে বিশেষভাবে দায়ী করেন তিনি। সরকারের কাছ থেকে অর্থ সহায়তার পক্ষে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, আমি মনে করি এখন যে সরকার তা কবি ও কবিতার পক্ষের। এ সরকারের যে কোন সহায়তা পরিষদ গ্রহণ করতে পারে। সরকার পৃষ্ঠপোষকতা দিলে উৎসব আরও সফল ও সুন্দর হবে বলে মনে করেন তিনি।
×