ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ;###;২৬ জনকে ফেরত, এদের মধ্যে ১৪ জন রিমান্ডে;###;এরা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য

সিঙ্গাপুরে ২৭ বাংলাদেশী আটক

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২১ জানুয়ারি ২০১৬

সিঙ্গাপুরে ২৭ বাংলাদেশী আটক

শংকর কুমার দে ॥ সিঙ্গাপুরে বসে বাংলাদেশে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করার অভিযোগে সেদেশে আটক হয়েছে ২৭ বাংলাদেশী নাগরিক। বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জেহাদী কর্মকা-ে অংশ নেয়ার ইচ্ছা ছিল তাদের। জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য তারা। জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুগত হয়ে সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ পাঠানোর অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। সিঙ্গাপুর পুলিশের হাতে জঙ্গী সন্দেহে আটক ২৭ বাংলাদেশী নাগরিকের মধ্যে গত এক সপ্তাহে ২৬ বাংলাদেশী নাগরিককে ফেরত পাঠানো হয়েছে দেশে। এর মধ্যে মঙ্গলবার ১৪ জনকে ৪ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ডিবি সূত্রে এ খবর জানা গেছে। ডিবি সূত্র জানান, সিঙ্গাপুরে আটক ২৭ জনের মধ্যে অপর একজনকে সিঙ্গাপুর পুলিশ গ্রেফতার দেখালেও অপর এক মামলায় সাজা হওয়ার কারণে সিঙ্গাপুর কারাগারে আটক রাখা হয়েছে তাকে। যে ১৪ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের সম্পর্কে অভিযোগ আছে, তারা আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) এর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন তারা। জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা ছাড়াও আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) জন্য জঙ্গী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরে গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশের নাগরিক জঙ্গী সন্দেহে আটককৃতরা। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) পরিদর্শক মোস্তফা আনোয়ার তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) হিসেবে মঙ্গলবার ১৪ জনকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। তাদের প্রত্যেকের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুরের আদেশ দেন ঢাকার মহানগর হাকিম আমিনুল হক। সিঙ্গাপুর পুলিশ গোপন সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে গত ১৬ নবেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুগত ২৭ বাংলাদেশীকে আটক করে। আটককৃতরা নির্মাণ শিল্পে কাজ করত। এর মধ্যে ২৬ জন চরমপন্থা ভিত্তিক গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন তারা। গত এক সপ্তাহ ধরে সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষ জঙ্গীবাদের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ২৬ জনকে ফেরত পাঠায় বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পর বিমানবন্দরেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ১৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে মামলা করা হয় উত্তরা পূর্ব থানায়। মঙ্গলবার ১৪ জনকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে ৪ দিনের রিমান্ডে আনার পর গোয়েন্দারা জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয় যে, গত সোমবার রাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪ জনকে। মঙ্গলবার আদালত থেকে যেই ১৪ জনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তারা হলেন- টাঙ্গাইলের আমিনুর (৩১), আবদুল আলিম (৩৩) ও শাহ আলম (২৮), কুমিল্লার গোলাম জিলানী (২৬), নুরুল আমিন (২৬) ও মাহমুদুল হাসান (৩০), ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জাফর ইকবাল (২৭), ঝিনাইদহের আকরাম হোসেন (২৭), চুয়াডাঙ্গার আবদুল আলী (৪০), পাবনার আশরাফ আলী (২৭), ঢাকার সাইফুল ইসলাম (৩৬), কুড়িগ্রামের আলম মাহবুব (৩৪), চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডলার পারভেজ (৩৫) ও মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ জসিম (৩৩)। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) এর তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে যে রিমান্ডের আবেদন করেছেন তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই ১৪ জন বাংলাদেশী সিঙ্গাপুরে কাজ করতেন। সিঙ্গাপুরের কর্মরত অবস্থায় তাদের নিজেদের মধ্যে পরিচয় হয়। তারা সিঙ্গাপুরে জঙ্গী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়েন সন্দেহে আটক করে সিঙ্গাপুর পুলিশ। তাদের আটক করার পর দেশে ফেরত পাঠায়। দেশে এসেও তারা আবার সংগঠিত হয়ে জঙ্গী কার্যক্রম শুরু করেন। সোমবার উত্তরা পূর্ব থানাধীন আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে খন্দকার ফিলিং স্টেশনের কাছ থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয় বলে ডিবির রিমান্ডের আবেদনে উল্লেখ করা হয়। এর আগের দিন সোমবার রাতে ওই ১৪ জনকে গ্রেফতার দেখিয়ে ডিবির পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা করেন। উত্তরা পূর্ব থানায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, এই ১৪ জন সিঙ্গাপুরের মোস্তফা মার্টের কাছে অ্যাঙ্গোলিয়া মসজিদে জড়ো হতেন। সেখানে বাংলাদেশে জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সদস্য ও অর্থ সংগ্রহসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন তারা। প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় তারা একত্র হয়ে ওই মসজিদে জিহাদী বক্তব্য, বয়ান ও জিহাদী ভিডিও দেখতেন। সিঙ্গাপুর পুলিশের কাছে এই জঙ্গী কার্যক্রমের বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর আটক করে তাদের। তারপর তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ডিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, সিঙ্গাপুর পুলিশ জঙ্গী সন্দেহে আটক করে ২৭ বাংলাদেশী নাগরিককে, যারা জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। বাংলাদেশে তারা জঙ্গী হামলার পরিকল্পনা করেছিল বলে সংবাদ প্রকাশিত হয় সিঙ্গাপুরের সংবাদ মাধ্যমে। সিঙ্গাপুরের সংবাদ মাধ্যম স্ট্রেইট টাইমস এর খবরে বলা হয়, জঙ্গী সংগঠন আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) অনুগত ২৭ বাংলাদেশীকে আটক করেছে সিঙ্গাপুর পুলিশ। গত ১৬ নবেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের আটক করা। সিঙ্গাপুর সংবাদ মাধ্যমের দাবি, এদের মধ্যে ২৬ জন একটি চরমপন্থাভিত্তিক গোপন বৈঠকে মিলিত হতেন। নির্মাণ শিল্পে তারা কাজ করতেন। তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ২৬ বাংলাদেশী নিয়মিত সাপ্তাহিক ভিত্তিতে পাঠচক্র চালাত। সেখানে তারা চরমপন্থী ধারণা ও মতামত নিয়ে আলাপ-আলোচনা করত। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন বইপত্রও বিনিময় করত তারা। সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর জন্য তারা সিঙ্গাপুরে থাকা বাংলাদেশী জাতীয়তার লোকজনকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করছিল। আটককৃতদের মধ্যে একজন গোপন বৈঠকের সাথী না হলেও তার কাছে চরমপন্থায় জড়িত থাকার আলামত পাওয়া গেছে। তিনি অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে সিঙ্গাপুরের কারাগারে রয়েছেন। সাজার মেয়াদ শেষ হলে তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। সিঙ্গাপুর পুলিশের উদ্ধৃতি দিয়ে ঢাকার একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, সিঙ্গাপুরে আটক ২৬ জনের অনেকেই মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে জেহাদী কর্মকা-ে অংশ নেয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সিঙ্গাপুরের তদন্ত সূত্রের বরাতে সেখানকার সংবাদ মাধ্যমে যে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে তার খবর নেয়া হচ্ছে। তাদের সম্পর্কে সিঙ্গাপুরের সংবাদ মাধ্যমে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে ফিরে এসে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জেহাদী কর্মকা-ে অংশ নেয়ার ইচ্ছা ছিল তাদের। ইসলামিক দল ও নেতাদের ওপর বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বাংলাদেশ সরকারের ওপর ক্ষোভও প্রকাশ করেন আটকৃতরা। ইসলামিক গ্রুপটির সদস্যরা লুকিয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তারা সক্ষম হয়নি। ২৭ বাংলাদেশীর অনেকে ধর্মের কারণে একটি বিশ্বাসের অনুসারী হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তাদের কাছে বিভিন্ন জেহাদী সরঞ্জাম পাওয়া গেছে বলে সিঙ্গাপুর পুলিশের দাবি। সিঙ্গাপুরে আটককৃতরা দীর্ঘদিন থেকে নজরদারিতে ছিলেন। গোপন তথ্যের ভিত্তিতেই গ্রেফতার করা হয় তাদের। সিঙ্গাপুরে আটককৃতদের মধ্যে একজনকে গ্রেফতার দেখানো হলেও সেখানকার একটি মামলায় সাজা হওয়ায় ফেরত পাঠানো হয়নি তাকে। সাজা শেষ হলে তাকেও বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
×