ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কতটুকু সম্পর্ক রাখতে হবে? -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৫, ২১ জানুয়ারি ২০১৬

পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কতটুকু সম্পর্ক রাখতে হবে?  -স্বদেশ রায়

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী মিলিটারির লজ্জাকর পরাজয়ের পর অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের রাজনীতি থেকে এবার সামরিক বাহিনীর আধিপত্য কমবে। ওই সব রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতো ওই সময়ের বিশ্বরাজনীতির দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীও একই রকম মনে করেছিলেন। যে কারণে দু’জনেরই সিদ্ধান্ত ছিল পাকিস্তানের সিভিল সরকারকে সাহায্য করা। বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী দু’জনেই তখন বিজয়ী নেতা। তারপরেও তাঁরা পরাজিত নেতা ভুট্টোকে একজন সিভিল সরকারের প্রতিনিধি মনে করে তাঁর দিকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন। এই সহায়তার বিস্তারিত ফল এই কলামে লেখা সম্ভব নয়, তবে নিট রেজাল্ট যা ইতিহাসের চরমতম ট্র্যাজেডি, দু’জনকেই নির্মমভাবে নিহত হতে হয়। আর এই দুটি হত্যাকা-ের যড়যন্ত্রের মূল ভূমিকা পালন করে পাকিস্তান। ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পরে ভারতের কংগ্রেস সরকার ওইভাবে আর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেনি। যদিও এক পর্যায়ে বেনজির ও রাজীব দুই দেশের ক্ষমতায় থাকার কারণে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছিলেন দু’জনেই স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম। তাদের ভেতর দেশভাগের সেই রক্তক্ষরণ নেই, তাই এখানে নতুন কোন সূর্য উঠবে। কিন্তু বাস্তবে পাকিস্তানের যে কোন সিভিল সরকার যে সোনার পাথরবাটি এটা কেন বড় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বুঝতে পারেন না বলব না, ওইভাবে না দেখে সোনার বাটি হিসেবে দেখেন তার সঠিক কোন কারণ খুঁজে পাই না। যাহোক, রাজনীতির অত গভীরে যাবার ক্ষমতা আমার নেই তা আমি বুঝি। কিন্তু তারপরের ইতিহাস কী? বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। দেশের মানুষ সকলে জানেন। ভারতে নরসীমা রাও এর পরে কংগ্রেস সরকার চলে গেলে কেন্দ্রে আঞ্চলিক দলগুলোর একটি মিলিত সরকার হয়, তার কিছুদিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিখ্যাত কূটনীতিক আইকে গুজরাল নতুন কূটনীতি চালুর দিকে মন দিয়েছিলেন। গুজরাল ডকট্রিন হিসেবে যা খ্যাত। সেখানে গুজরালের তাঁর লাহোরের গ্রামের বাড়ি দেখা ছাড়া বাস্তবে ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে কোন লাভ হয়েছিল কিনা তা ভবিষ্যত বলবে। তবে গুজরাল তার ওই বাড়ি দেখার পরে লিখেছিলেন, তিনি যখন বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন তখন ওই গ্রাম, গ্রামের রাস্তা ও বাড়িঘর যেমন ছিল তিনি গিয়েও তেমনই দেখেন। হয়ত ভবিষ্যতের কূটনীতিক বিশ্লেষকরা বলবেন, গুজরালের গ্রাম ও বাড়ি যেমন অপরিবর্তিত আছে তার কোন উন্নয়ন হয়নি। বাস্তবে গুজরাল ডকট্রিনের পরেও ভারত ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ওই ৪৭-এ ছেড়ে আসা বাড়ি ও গ্রামের মতোই থেকে যায়। এর পরে অটল বিহারী বাজপেয়ীর পাকিস্তান সফর নিয়ে অনেক হৈ চৈ হয়েছিল। পশ্চিমা মিডিয়া বিশেষ করে আমেরিকান মিডিয়া উচ্ছ্বসিত ছিল খুবই। কিন্তু ভারত তার নিট রেজাল্ট পায় কারগিল যুদ্ধ। এর পরে আবার নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি এবার ক্ষমতায় এসে গোটা বিশ্বকে চমক দিয়ে নওয়াজ শরীফের মেহমান হন মোদি। বিশ্ব মিডিয়া অনেক বড় ব্রেকিং নিউজ পায়। কিন্তু তার সপ্তাহ না ঘুরতেই ভারত নিট রেজাল্ট পায়- পাঠানকোট। যাহোক, তারপরেও ভারতের চানক্যপুরীতে অনেক বাঘা ব্যক্তি আছেন, তারা তাদের দেশের সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু সেই ’৭১ থেকে এ অবধি ভারত ও বাংলাদেশের পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টার একটি লেজার বই যদি তৈরি করা হয় তাহলে মনে হয় এটাই সত্য হবে যে, ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে লাভের থেকে লোকসানটা হয়েছে বেশি। বাংলাদেশ শুধু যে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছে তা নয় আরও অনেক ক্ষতি হয়েছে। আমরা যারা সাংবাদিক হিসেবে একটু নানান কিছু দেখা ও জানার সুযোগ পাই তারা তো জানতে পারি, দেখতে পাই বাংলাদেশে পাকিস্তান দূতাবাস থাকার কারণে কত সহজে পাকিস্তান নামক দেশটি বাংলাদেশের কত ক্ষতি করতে পারছে। যেমন ২০০১-এ শেখ হাসিনা যাতে নির্বাচনে না জিততে পারেন সেজন্য পাকিস্তান বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে। সেদিন ওই অর্থ দিয়েই কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান লতিফুর রহমানসহ ওই সরকারের বড় একটি অংশকে, প্রশাসনের বড় অংশ কিনে নেয়া হয়েছিল। সেদিন ওই টাকা কিভাবে পাকিস্তান দূতাবাস একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের একটি বিশেষ অফিসসহ বিভিন্নস্থানে পাঠিয়েছিল তা কিন্তু এ দেশের বহু সাংবাদিকসহ অনেকেই জানেন। এমনকি পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআই সেদিন বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতের বিছিন্নতাবাদী গ্রুপ আলফা, ত্রিপুরা টাইগার প্রভৃতির মাধ্যমেও সেদিন ওই টাকা দেশের নানান স্থানে পাঠায়। সে টাকায় সেদিন কিভাবে শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে পরাজিত করা হয়েছিল তার বিস্তারিত লেখার সময় এখনও এ দেশে আসেনি। জানিনা সে পরিবেশ কোনদিন পাব কিনা? ঠিক একইভাবে বাংলাদেশে আইএসআইয়ের অন্যতম স্তম্ভ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রক্ষা করার জন্যই কিন্তু পাকিস্তান দূতাবাস সীমাহীন অর্থ ব্যয় করে। যে অর্থের কিছু কথা ফাঁস করতে গিয়ে আমাকে আদালতে সাজা ভোগ করতে হয়েছে। জানি না বাংলাদেশে পাকিস্তানের এই শক্তি কবে কমবে? কিন্তু ওই অর্থ কী বিশাল পরিমাণের ছিল এবং কত জায়গায় গিয়েছিল, কারা কারা জড়িত ছিল নিশ্চয়ই একদিন বিস্তারিত তা প্রকাশ হবেই। তাই যদি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের এই সম্পর্ক রক্ষার লাভ ক্ষতির একটি সহজ হিসাব তৈরি করা হয়, তাহলে কিন্তু সেখানে বাংলাদেশের লোকসানের পাল্লাটিই বেশি ভারি। যেমন ভুট্টোকে পাকিস্তানের সিভিল সরকার মনে করাতে বাংলাদেশকে হারাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার জন্য সেদিন পাকিস্তান বিভিন্ন মাধ্যমে আবদুল হক, সিরাজ সিকদার থেকে শুরু করে কত রাজনৈতিক নেতা, দলকে সেদিন অর্থ ও অস্ত্র দিয়েছিল তাও একদিন আরও বিস্তারিত প্রকাশ পাবে। মিডিয়ার কাকে কাকে সেদিন অর্থ সহযোগিতা দিয়েছিল তা এদেশের অনেক মানুষই জানেন। শেষ অবধি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্রের মূল ভূমিকা পাকিস্তান তাদের এ দেশীয় বিভিন্ন ধরনের এজেন্টদের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। এর পরে বাংলাদেশে পাকিস্তানী দূতাবাস স্থাপিত হয়। ওই দূতাবাসকে কাশিমবাজার কুঠি না বলে বিকল্প বঙ্গভবনই বলা যায়। বাস্তবে ১৯৯৬ সালের আগ অবধি পাকিস্তান দূতাবাস এদেশে বিকল্প বঙ্গভবন হিসেবেই কাজ করেছে। মূলত এদেশের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শেষ অবধি পাকিস্তান দূতাবাস থেকেই আসত। ১৯৯০-এ এবং ১৯৯৬-এ জনতার অভ্যুত্থানে যখন দুটি সরকারের পতন হয়, এই দুই সরকারের পতনের আগে ওই দুই সরকারপ্রধান তাদের শেষ ফোনটিও করেন পাকিস্তান দূতাবাসে। এমনকি ১৯৯৬ থেকে ২০০১ অবধি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ২০০১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে সাজানো নির্বাচনে পরাজিত করার সব কাজই কিন্তু হয় পাকিস্তান দূতাবাসে বসে। তাছাড়া ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ অবধি এদেশের মৌলবাদীরা যে শক্ত অবস্থানের ভিত গাড়তে পেরেছে তার মূল কাজটিও কিন্তু করা সহজ হয়েছে এখানে ওই দেশটির দূতাবাস থাকার কারণে। শেষ অবধি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে রক্ষার চেষ্টা ও তার ফাঁসির পরে এখানে জঙ্গী তৎপরতা ঘটানোর চেষ্টা সবই সহজ হয়েছে ওই দূতাবাস থাকার কারণে। নতুন প্রজন্ম আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তারা শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও ভবিষ্যতমুখী রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তারা একটি উন্নত দেশ চায়। তারা উন্নত দেশের অধিবাসী হিসেবে উন্নত শিক্ষা ও উন্নত জীবন যাপন করতে চায়। সেই অতীতের দারিদ্র্যের ফেরিওয়ালা বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে তারা আর বাঁচতে চায় না। তাই যখনই এই নতুন প্রজন্ম দেখছে তাদের দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে- দেশ ও শেখ হাসিনার শত্রুরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছেÑ তখনই কিন্তু তারা রাজপথে আসছে। তারা শত্রুকে চিহ্নিত করছে। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। যখন পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য ও ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দেয়া ট্রেনিং নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশের রাজপথে পুলিশের ওপর আরবান গেরিলা যুদ্ধের স্টাইলে হামলা হচ্ছিল। অর্থাৎ পাকিস্তানী এজেন্টরা আরবান গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেছিল তখন কিন্তু এই তরুণ প্রজন্ম রাজপথে নেমে এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান ও চেতনাকে বুকে নিয়ে। তাদের হুঙ্কারে ওই পাকিস্তানী চররা ভীত হয়, পরে শেখ হাসিনা কঠোর হাতে ওই পাকিস্তানী চরদেরকে দমন করেন। তারপরেও কিন্তু পাকিস্তানী দূতাবাসটি এখানে বসে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। জঙ্গীকে মদদ দেয়ার দায়ে দু’জন কূটনীতিককে ইতোমধ্যে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বিপরীতে পাকিস্তান ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের দূতকে অপমান করেছে। তাই অতীতের এই ইতিহাস, বর্তমানের এ অবস্থা বিবেচনা করে, তরুণ প্রজন্মের তীক্ষè ও স্বার্থশূন্য চিন্তাকে মূল্য দিয়ে এখন মনে হয়, ভাবার সময় এসেছে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ কতটুকু কূটনীতিক সম্পর্ক রক্ষা করবে? আমাদের দেশে বহু দেশের দূতাবাস নেই। আমাদেরও বহু দেশে দূতাবাস নেই। স্যাটেলাইট দূতাবাস দিয়ে কাজ চলে। তাই পাকিস্তানী দূতাবাস বাংলাদেশে রাখা ও বাংলাদেশের দূতাবাস পাকিস্তানে রাখা কতটা যৌক্তিক তা এখন মনে হয় সিদ্ধান্ত নেয়ার সময়। কেউ হয়ত বলতে পারেন এতে সার্কের ক্ষতি হবে। বাস্তবে পাকিস্তান যে ভূখ-ের অধিকারী ওই ভূখ-সহ একটি কার্যকরী সার্ক তখনই হবে যখন পাকিস্তান নতুন আকৃতি নেবে। নতুন নামে কয়েকটি দেশে চিহ্নিত হবে তখনই। তার আগে নয়। এর আগে ভারত, বাংলাদেশ, ভুটান ও নেপাল মিলে নতুন বলয় নিয়ে এগোতে হবে। শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের সঙ্গে এই বলয়কে ভিন্নভাবে সম্পর্ক রাখতে হবে। আর মিয়ানমারের সঙ্গে কতটা যোগ হবে এ বলয় সেদিকটা দেখতে হবে। এখন মনে হয় এভাবেই ভাবার সময় এসেছে। [email protected]
×