ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জীবনের উৎসব

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২১ জানুয়ারি ২০১৬

জীবনের উৎসব

মানুষ যেমন শিল্প সৃজন করে, তেমনি শিল্পের মাঝেও সে দেখতে পায় জীবনের সারসত্য। নতুন বছরের শুরুতে রাজধানীতে রীতিমতো উৎসবের ধুম লেগেছে। প্রতিটি চিত্রশালায় প্রদর্শিত হচ্ছে শিল্পের সুষমা, নাট্যমঞ্চে অভিনীত হচ্ছে আকর্ষণীয় নাটক, পিঠা উৎসবের আয়োজন চলছে, পৌষ সংক্রান্তি উৎসবও আয়োজন করেছে বিভিন্ন সংগঠন। নয় দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব নগরবাসীর জন্য এক বিরাট প্রাপ্তি। একসঙ্গে চারটি ভেন্যুতে চলছে উৎসব। আটটি বিভাগে দেখানো হচ্ছে বাংলাদেশসহ ৬০টি দেশের ১৮০টি চলচ্চিত্র। জীবনই যেন মেতেছে উৎসবে। অথচ গত বছরের ঠিক এই সময়টিতে জীবন নয়, মৃত্যুর উৎসবে মেতেছিল একটি রাজনৈতিক দল। নিরীহ মানুষ লক্ষ্য করে তারা একের পর এক পেট্রোলবোমা ছুড়ে দিয়েছিল। থাক সে কথা, সে অসহায় দিনের স্মৃতি। বরং সংস্কৃতি, উৎসব আর জীবনের গান গাওয়া যাক। জীবন থেকে উৎসব উপড়ে নিলে সপ্রাণ দেহ আর শবের মধ্যে বিশেষ ব্যবধান অবশিষ্ট থাকে না। জীবনকে বর্ণিল করার জন্য যেমন রচিত হয়েছে নানাবিধ উৎসব, তেমনি জীবনের বাঁকে বাঁকে সঙ্কট উজিয়ে সংগ্রাম করেই অর্জন করে নিতে হয়েছে বিবিধ উৎসব। উৎসবের উপলক্ষ সৃজন করতে পারাটাও তাই এক অর্থে অগ্রসরতা, জীবনমুখিতা এবং উজ্জ্বল আনন্দের প্রসারিত প্রাঙ্গণ উদ্ভাবন। সর্বজনীন উৎসবের স্ফূর্তি ও মাত্রার সঙ্গে এই দেশে আর কোন উৎসবেরই তুলনা যেন চলে না। হ্যাঁ, পহেলা বৈশাখে নববর্ষ বরণ উৎসবের কথাই বলা যায়। বাঙালী হিসেবে তো বর্ষবরণ উৎসবে মাতি। তাই বাঙালী আত্মপরিচয়টিকে যদি মর্যাদাপূর্ণ করে তুলতে না পারা যায় তাহলে সেই উৎসব নিছক আনন্দ উপভোগ। উৎসবের উপলক্ষ পেলে তারুণ্য গৃহবন্দী থাকে না, সে বেরিয়ে পড়ে খোলা আকাশের নিচে। বিবিধ উৎসবে তারুণ্যের অংশগ্রহণ তখনই অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে যখন সে আত্মপরিচয় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হবে। যখন সে অনুধাবন করতে পারবে উৎসব সব নয়, তার নিজেরও কিছু দায় আছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালী সংস্কৃতির পরিচর্যা না করে, বরং তাকে কিছুটা অশুদ্ধ ও শ্রীহীন করে বাঙালীর সর্বজনীন উৎসবে মেতে ওঠা এক ধরনের আত্মপ্রবঞ্চনা। সততার সড়ক থেকে বিচ্যুত না হয়ে বাংলা নামের দেশকে ভালবেসে, বাঙালী আত্মীয়ের প্রতি শ্রদ্ধা বজায় রেখে, আপন ভাষা-সংস্কৃতিকে সত্যিকারভাবে হৃদয়ে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারলেই উৎসবের প্রাণের সঙ্গে নিজের প্রাণের মেলবন্ধন ঘটবে। প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে তবেই অর্জন করা যায় উৎসবের উপলক্ষ। বাংলা ভাষা, বাঙালী সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ যারা তাদের পরাস্ত করার যুদ্ধে শামিল থাকতে হবে। এজন্য তরুণদের দিকেই তো সবাই তাকিয়ে থাকে। এই তরুণরাই তো আমাদের স্বপ্ন রচনা করবে, স্বপ্ন সার্থকও করবে। তাদের ওপর কবিও বড় ভরসা করেছেন। বলেছেন, ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা, ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ আজ আনন্দের পাশাপাশি তাই জরুরী হলো দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যবোধ। প্রতিটি উৎসবে আমাদের সংস্কৃতি প্রাণ পায়। জীবন আরও অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। সঙ্গীত, কবিতা, ছবি আঁকা, ভাস্কর্য, সাহিত্য, দার্শনিক চিন্তা প্রভৃতি এক-একটা জাতির সংস্কৃতির প্রকাশ-মাধ্যম এবং দর্পণ। এসব সৃজনধর্মী কাজেই অর্জিত হয় মন ও হৃদয়ের সুখানুভূতি-আনন্দ ও উৎফুল্লতা। মানুষ উৎসবে তখনই যুক্ত হয়, যখন তার কাছে জীবন স্বস্তিকর এবং উপভোগের। উৎসবের সময় ও পরিবেশ সৃষ্টিও তাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
×