ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

নারী॥ প্রচার পণ্য ও গিনিপিগ

প্রকাশিত: ০৭:৩৯, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

নারী॥ প্রচার পণ্য ও গিনিপিগ

রবীন্দ্রনাথ ‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’য় এক জায়গায় লিখেছেন- একটু গান গাওয়া, একটু পিয়ানো বাজানো, ভালো করে নাচা, খানিকটা ফরাসী ভাষা বিকৃত উচ্চারণ, একটু বোনা ও সেলাই করা জানলে একটি মেয়েকে বিয়ের দোকানের জানলায় সাজিয়ে রাখবার উপযুক্ত রঙচঙে পুতুল গড়ে তোলা যায়। এ বিষয়ে একটা দিশি পুতুল ও একটা বিলিতি পুতুলের যতটুকু তফাত, আমাদের দেশের ও এদেশের মেয়েদের মধ্যে ততটুকু তফাত মাত্র।’ একটি দৈনিকে প্রকাশিত নারীবিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদন দেখে রবীন্দ্রনাথের এ লেখার কথা মনে পড়ল। তিনি উঁচু শ্রেণীর নারীদের কথা বলেছেন। বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ নারীর জীবন রঙচঙে পুতুলের নয়। কঠোর পরিশ্রমের। গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, নারীর কাজ মূলত সেবামূলক। সমাজে সেবামূলক কাজের স্বীকৃতি না থাকায় নারীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হচ্ছে না। এ ধরনের নানা গবেষণা বিভিন্ন সময়ই আমরা দেখি। গবেষণার বিষয় নয়, প্রশ্ন হচ্ছেÑ এ ধরনের গবেষণায় লাভ কার? এতে যেসব নারীর ওপর গবেষণা চালানো হয় তাদের জীবনে কি কোন পরিবর্তন আসে? অভিজ্ঞতা তা বলে না, তারা সমাজ নামের গবেষণাগারে যুগ যুগ ধরে গিনিপিগই থাকেন। এতে লাভের পাল্লা কাদের ভারি হয় চোখ-কান খোলা যে কেউ তা জানেন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিলেত গিয়েছিলেন আঠারো শ’ আটাত্তর সালে। ইউরোপ প্রবাসীর পত্রে সে সময়ের অভিজ্ঞতাই বর্ণনা করেছেন। বিকাশের বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে শিক্ষা ও কর্মে নারীরা এগিয়েছেন নিঃসন্দেহে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘বড় মানুষের মেয়ে কিংবা বড় মানুষের স্ত্রীরা’ও। তবে তাদের আয়েশী জীবনে পরিবর্তন এসেছে কমই। প্রযুক্তির বিকাশ তা বরং আরও মসৃণ করেছে। আমাদের দেশের ধনী ঘরের মেয়ে-স্ত্রীরাও দেশী আচার-অনুশাসনের শক্ত বেড়ির পরও কমবেশি আয়েশী জীবনযাপন করেছেন, তার প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের গল্প ও উপন্যাসেই রয়েছে। ‘সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত দিনটা যাদের হাতে আস্ত পড়ে থাকে’। একজন শিক্ষিত নারীর পক্ষে দিনের পর দিন আস্ত দিনটি অলস যাপন করা কষ্টের। তাদের অনেককে তাই বেরোতে হয় ‘সমাজসেবা’মূলক নানা ধরনের কাজে। গত শতকের সত্তর দশকের শুরু পর্যন্ত এ সেবা ছিল পুরোপুরি ননপ্রফিট। কিন্তু আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সে সময় অনুন্নত দেশগুলোতে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব সৃষ্টি রোধ করার জন্য ওই ব্যবস্থার তখনকার নিয়ন্তারা এক ‘নতুন উন্নয়ন কৌশল’-এর ফর্মুলা প্রেসক্রাইব এবং তা বাস্তবায়নের জন্য তহবিল সরবরাহ করে। সত্তর দশকের মঝামাঝি থেকে এর রূপ স্পষ্ট এবং গতি বেগবান হয়। বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নামে পরিচিত এসব সংস্থার কাজ মূলত গ্রামমুখী হওয়ায় শহরের বিত্তবান নারীরা এর মধ্য দিয়ে সমাজসেবায় খুব বেশি অবদান রাখতে পারলেন না। এ সুযোগ এলো মূলত আশির দশকে। ‘নারীমুক্তি’ বিষয়টি যখন শহুরে সমাজে বার্নিং ইস্যু। জার্মান সমাজতন্ত্রী নেত্রী ক্লারা জেটকিন (১৮৫৭-১৯৩৩)-এর আট মার্চ ততদিনে পুরোপুরি পুঁজির পণ্য। নারীমুক্তির পুঁজিবাদী ভার্সন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা পৃথিবী। সে সঙ্গে আসছে অর্থ। নারীর জীবনমান বাড়াতে নানা নামে ও বৈশিষ্ট্যে আত্মপ্রকাশ করছে অসংখ্য এনজিও। সমাজসেবায় নিজেকে নিবেদিত করার সুবর্ণ দরজা খুলে গেল। ননপ্রফিট সমাজসেবা আশ্চর্য এক জাদুমন্ত্রে স্রোতের মতো প্রফিট বয়ে আনতে শুরু করল। অবশ্য প্রফিট শব্দটা এখানে প্রায় নিষিদ্ধের মতো। যা আসছে তার নাম ফান্ড। সুবিধাবঞ্চিত নারীদের সহায়তা দেয়ার জন্য। নারীবিষয়ক এনজিওর পাশাপাশি তথাকথিত উন্নয়নমূলক দারিদ্র্য বিমোচনকারী অনেক এনজিওর লক্ষ্যও শুরু থেকে নারীর ‘সার্বিক না হোক অর্থনৈতিক মুক্তি’ ঘটিয়ে তার জীবনের মান বাড়ানো। তাকে স্বাবলম্বী করা। এজন্য কেউ মনযোগ দিয়েছেন কুটিরশিল্পের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে, কেউ ক্ষুদ্রঋণে। নারীকে স্বাবলম্বী করতে এনজিও ঘরানায় এ দুই ধারাই সবচেয়ে বেশি স্পষ্ট। কিন্তু গত তিরিশ-চল্লিশ বছরে দেশজুড়ে এনজিওওয়ালাদের দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর স্বাবলম্বনের নিট রেজাল্ট কী? দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে এদের ভূমিকা কতখানি? নারীরা কী হারে মুক্ত হয়েছেন? এসব প্রশ্নের পরিষ্কার উত্তর পাওয়া যায় না। অবশ্য সে দায়ও এদের নেই। গত শতকের সত্তর দশকের শুরুতে বিশ্বব্যাংকসহ নিয়ন্তা অন্যান্য বিশ্বসংস্থা দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচীর ওপর জোর দিয়েছিল বলে আমাদের এখানে ‘গ্রামোন্নয়নের’ ঢেউ উঠেছিল। গ্রামোন্নয়নের নানা কর্মসূচী, দারিদ্র্য হ্রাস, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি ইত্যাদি কাজের জন্য তখন দুর্বার বেগে এসব সংস্থা কাজ করেছে। তাতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য দূর না হলেও সংস্থার কর্ণধারদের জীবনে আর্থিক পরিবর্তন শুধু চোখে পড়ার মতো নয়, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়ার স্তরে পৌঁছেছে। সত্তরের শুরুর দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচীর পর মধ্য সত্তরে মনোযোগের কেন্দ্রে আসে নারী উন্নয়ন কর্মসূচী। যথারীতি সেখানেও উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগীরা যা চেয়েছে, উন্নয়নের যেমন ডিজাইন প্রেসক্রাইব করেছে, সেভাবেই কাজ এগিয়েছে। আগেই বলেছি, ক্লারা জেটকিনের নারী আন্দোলন পুঁজিবাদী ধাঁধায় পথ হারিয়েছে অনেক আগেই। মধ্য সত্তরে শুরু হয়ে আশির দশকে এসে সে আদর্শের আলো পুরোপুরি নিভে গেলেও তার জায়গায় পুঁজিবাদী জেল্লা বর্ণবৈচিত্র্যে প্রচ-ভাবে উদ্ভাসিত হয়। কিন্তু নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে বেজিং নারী শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে সে জেল্লাও ফিকে হতে থাকে। নারীদের নিয়ে বেজিং শীর্ষ সম্মেলনের মতো অমন ব্যাপক তোড়জোড় এরপর আর হয়নি। কারণ এ সময় থেকে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ তার গতিমুখে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের বাঁক তৈরি করে। পঁচানব্বই সালেই গ্যাট চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এটাই বিশ্বের সব অর্থনীতিকে এক ধারায় প্রবাহিত করার প্রথম একক দলিল। এরপর বহুজাতিক কোম্পানির বাজার সম্প্রসারণের নগ্ন প্রতিযোগিতায় আদর্শবাদের লোক দেখানো লেবেলও ভেসে যায়। বাজার ও বিজ্ঞাপনের ডামাডোলে কোনকিছুই আর আলাদা করে চেনার উপায় রইল না। জীবন জগতের সবই এখন বিক্রয়যোগ্য পণ্য। বাজার ও পণ্যনির্ভর সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান কোথায় তা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার প্রয়োজন না হলেও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘নিষিদ্ধ কথা আর নিষিদ্ধ দেশ’ থেকে ক’টি লাইন উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করছি। ‘শ্রেণী সমাজের কাছে নারী জাতির পবিত্রতা রক্ষার প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুতর। কেননা, শ্রেণী সমাজের ভিত্তিই হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি, আর তাই এই ব্যক্তিগত সম্পত্তির নির্ভুল উত্তরাধিকার নির্ণয় করাই শ্রেণী সমাজের একটি বড় মাথাব্যথা। উত্তরাধিকারী যদি নির্ভুল না হয় তাহলে তো ব্যক্তিগত সম্পত্তি প্রায় বেহাত হওয়ারই শামিল। একই কারণে শ্রেণী সমাজে নারীর জীবনের ওপর অতিসতর্ক নিষেধাজ্ঞা। নারী তাই দুর্লভ সামগ্রীÑ দুর্লভ বলেই লোভনীয়, লোভনীয় বলেই তার ছবির লোভ দেখিয়ে যে কোন পণ্যবস্তুকেই বাজারে কাটানো সহজসাধ্য। ফলে অবস্থাটা মোটের ওপর এক উৎকট পরিহাসের মতোই হয়ে দাঁড়িয়েছে; নারী জীবনের শুচিতা রক্ষা করার তাগিদই নারীকে আজ প্রায় পণ্যে পরিণত করেছে। ...এই হলো শ্রেণী সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব; একদিকে নির্ভুলভাবে উত্তরাধিকারীকে শনাক্ত করার আশায় স্বাভাবিক সামাজিক মর্যাদা থেকে নারী জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার আয়োজন এবং এই আয়োজনের খাতিরেই নারী জাতির শুচিতা ও সতীত্ব নিয়ে অফুরন্ত সাধুবাক্য; অপরদিকে এরই বাস্তব পরিণতি হলো নারী জাতিকে একেবারে পরম পণ্য করে তোলা- রংচঙে খাবারের ছবি আর রংচঙে মেয়েদের ছবি, মার্কিন পত্রিকায় এই দুইয়ের মধ্যে সীমারেখা অস্পষ্ট।’ তিনি যে সময়ে লিখেছিলেন, সে সময় মুক্তবাজার এবং মুক্ত মিডিয়ার এত রমরমা ছিল না। রংচঙে খাবারের ছবি আর রংচঙে মেয়েদের ছবি এখন মার্কিন পত্রিকার পাতা থেকে বেরিয়ে ‘মুক্ত’ দুনিয়ার সবখানে অবাধে বিচরণ করছে। ওই অবাধ বাজারি পণ্যের প্রভাব থেকে নারীকে রক্ষার সাম্প্রতিকতম ঢাল হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে বোরকা বা হিজাব। এও ওই বাজারের খেলা বা অন্তর্দ্বন্দ্ব। এ রকম এক প্রকট বাস্তবতায় বাস করে ‘সমতাভিত্তিক সচেতনতা’ বা এ ধরনের শব্দগুচ্ছ দিয়ে নারীর প্রতি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে চাওয়ার তোড়জোড় সম্ভবত এ সময়ের ‘নারীমুক্তি’র নির্মম পরিহাস। অথচ সেই সত্তর দশক থেকে এই দু’হাজার চৌদ্দ পর্যন্ত ‘সচেতনতা’ ও ‘উন্নয়নের’ ধারাবাহিকতা, যা করতে পারেনি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আলোড়ন তুলেছেন তৈরি পোশাকের নারী শ্রমিকরা। পরিবর্তন যদি কিছু এসে থাকে তবে তা এসব নারীই এনেছেন। শুধু নিজেদের জীবনে নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেও তাঁরা পরিবর্তনের সূচনা করেছেন। দেশের অর্থনীতি ভেতর থেকে এঁরাই বদলাচ্ছেন। দেশের রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস তৈরি পোশাকশিল্প। শিল্পায়নই সত্যিকারার্থে পরিবর্তন আনতে পারে বাংলাদেশের মতো দেশে। স্বনির্ভর হতে পারে দেশ। মুক্ত হতে পারেন নারীরা। তা যাতে না হতে পারেন সেজন্য আন্তর্জাতিক পুঁজির নিয়ন্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচেষ্টার শেষ নেই। আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের কাঠামোগত সংস্কারের নামে দেশের শিল্পকারখানা ধ্বংস করা ছিল এর অন্যতম উদ্যোগ। শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী বা নারী উন্নয়নের নামে এনজিও ব্যবসার অবাধ সুযোগ করে দিলে গরিব ও নারীর অবস্থার উন্নতি হাজার বছরেও হবে না। সুতরাং যুগ যুগ ধরে এ দুয়ের নামে ‘আন্দোলন’ চলবে এবং ফান্ড আসবে। নইলে ‘যাদের হাতে আস্ত একটা দিন পড়ে থাকে’ তাদের সময়ইবা কাটবে কী করে?
×