ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ মামুন রশীদ

‘পরিবারের জন্য সব ছাড়তে পারি’

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

‘পরিবারের জন্য সব ছাড়তে পারি’

এক পলকের একটু দেখা ছিল। মুম্বাই বিমানবন্দরে পরস্পরকে প্রথমবার দেখেছিলেন শচীন টেন্ডুলকর ও অঞ্জলী টেন্ডুলকর। আর সেটাই প্রণয়ে রূপান্তরিত হতে সময় লাগেনি। সে সময় সেল ফোনের প্রচলন না থাকায় লুকিয়ে-চুরিয়ে ল্যান্ড ফোনেই তারা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগটা রক্ষা করেছেন। সাক্ষাত করেছেন। তবে উভয় পরিবারের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হতে সময় লাগেনি। তখন সবেমাত্র কৈশোর পেরোনো দু’জন। বিমানবন্দরে শচীনকে প্রথম দেখে বাড়ি আসার পর অঞ্জলী বলেছিলেন, ‘আমি এই ছেলেটিকে বিয়ে বরব!’ সেটা অনেকে শুধুই কৌতুক করে বলা কথা মনে করলেও তা বাস্তব করার পথে অনেকদূর এগিয়ে গেছেন অঞ্জলী-শচীন। উভয়ের মনের মধ্যেই তখন একটা চিন্তা কাজ করেছেÑ ‘এক পলকের একটু দেখা, আরও একটু বেশি হলে ক্ষতি কি?’ ৪ বছর টানা প্রেম করার পর অবশেষে শুভ পরিণয় হয়েছে দুই পরিবারের সম্মতিতেই। ১৯৯৪ সালের ২৪ এপ্রিল নিজের ২১তম জন্মদিনে বাগদান সম্পন্ন হয় দু’জনের। আর ঠিক এক বছর পর ২৫ মে, ১৯৯৫ শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হন শচীন-অঞ্জলী। বিয়ের পরই সংসারধর্মে জড়িয়ে ক্যারিয়ার বাধাগ্রস্ত হতে পারতো শচীনের। কিন্তু পরিবারের ভার নিজের কাঁধে নিয়ে শচীনকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে দিয়েছেন অঞ্জলী। ত্যাগ করেছেন নিজের কাজ। অঞ্জলী বিয়ের পরই শচীনকে বলেছিলেন, ‘আমি পরিবারের জন্য স্বেচ্ছায় সব ত্যাগ করতে পারি।’ আর সেজন্যই বিশ্ব ক্রিকেট পেয়েছে সর্বকালের সেরা ক্রিকেটারদের মধ্যে অন্যতম একজনকে। নিজের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’তে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন ‘লিটল মাস্টার’ শচীন। শচীন তখন উঠতি তারকা। ক্রিকেট ক্লাব অব ইন্ডিয়াতে অনুশীলন করতেন। বিমানবন্দরে শচীনকে দেখার কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে অঞ্জলী দেখতে এসেছিলেন শচীনকে। কিন্তু ক্রিকেট পাগল শচীন তাকে সময়ও দিতে পারেননি। অঞ্জলী নিজে ক্রিকেট খেলা তেমন পছন্দ করতেন না এবং টিভিতেও দেখতে চাইতেন না। এরপর আবার যার জন্য আগ্রহী হলেন সেও তেমন উৎসাহ দেখাল না তার প্রতি ক্রিকেটের ঝোঁকে। সবমিলিয়ে ক্রিকেটকে নিজের শত্রুই ভাবা উচিত ছিল অঞ্জলীর। কিন্তু উল্টোটাই হয়েছে। ক্রিকেট ভাল না বাসলেও ক্রিকেটের জন্য অন্তঃপ্রাণ শচীনকে মন-প্রাণ দিয়ে ফেলেছিলেন। তাই প্রেমটা হয়েছে শুধু অঞ্জলীর তীব্র টানের কারণেই। কারণ শচীন সেভাবে তাকে সময়ই দিতে পারেননি। কিন্তু অঞ্জলী তার পিছু ছাড়েননি। যেখানে শচীন সেখানেই ছুটে গেছেন অঞ্জলী। আর সেজন্যই দুই পরিবারের কাছে দ্রুতই পরিষ্কার হয়ে গেছে এ দুই কিশোর-কিশোরীর প্রেমটা। ৪ বছর এভাবেই কাটিয়ে দিয়েছেন শচীন-অঞ্জলী। অবশেষে শচীনের ২১তম জন্মদিনে একটা পারিবারিক সম্মতি দেয়া হলো এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। অঞ্জলীর পরিবারের বাড়ি ছিল দক্ষিণ মুম্বাইয়ের বিচ ক্যান্ডিতে ওয়ারডেন রোডে। সেখানেই দুই পরিবারের সদস্য ও পারিবারিক বন্ধুদের উপস্থিতিতে বাগদান সম্পন্ন হয় দু’জনের। চূড়ান্তভাবে দু’জন সংসারী হওয়ার স্বীকৃতি পেয়ে যান পরের বছর ১৯৯৫ সালের ২৫ মে শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয়। অঞ্জলী মেহতা এদিন হয়ে যান অঞ্জলী টেন্ডুলকর। বিয়েটা হয়েছে মহারাষ্ট্রের চলমান রীতি ও প্রথা অনুসারে। শচীনের মা বিয়ের সময় অঞ্জলীকে দিয়েছেন একটি মঙ্গলসূত্র, সিঁদুর পরিয়ে দিয়েছেন, সবুজ রঙ্গের বালা, নূপুর এবং পায়ের আঙ্গুলে পরার আংটি। এটিই ছিল ঐতিহ্য। এই জিনিসগুলো পরে থাকতে বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলেন অঞ্জলী। তিনি শচীনকে বলেন, ‘আচ্ছা তোমার মা আমাকে যেসব দিয়েছেন সবগুলোই কি সবসময় পরে থাকতে হবে?’ শচীন তাকে বললেন, ‘না, শুধু মঙ্গলসূত্রটা কখনও খুলো না।’ সত্যিই শচীন আশ্চর্য হয়ে দেখেছেন আর কখনই অঞ্জলী মঙ্গলসূত্র খুলে রাখেননি। পরস্পরের সঙ্গে এক মঙ্গলজনক বন্ধন দৃঢ় আছে আজ অবধি। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর সবারই পারিবারিক দায়িত্ব শুরু হয়ে যায়। শচীন তখন ২২ বছর বয়সী হলেও ২২ গজের ক্রিকেট উইকেটই যেন তার ঘর-বাড়ি। সতীর্থ ক্রিকেটাররাই যেন পরিবার। তবে কি অঞ্জলীকে বিয়ে করে ক্রিকেটকেই নির্বাসন দিতে হবে? সংসার ধর্মে মনোযোগী হতে হবে শচীনকে? পরিস্থিতিটা তাই বলছিল। কিন্তু অঞ্জলী তা হতে দেবেন কেন? শচীন যা সেটার জন্যই তো তাকে ভালবেসেছিলেন, সে জন্যই এসেছেন তার ঘরে। আর এখন সেটা কিভাবে বন্ধ হতে দিতে পারেন? অঞ্জলী খুব ভাল করেই জানতেন শচীনের প্রথম প্রেম তিনি নয়, শচীনের প্রথম প্রেম ক্রিকেট। সেখান থেকে সহজে বিচ্ছিন্ন হতে পারবেন না লিটল মাস্টার। এ কারণে অঞ্জলী নিজেই তার ক্যারিয়ারের চিন্তা মাথা থেকে বিসর্জন দিলেন। নিজেকে শুধু সঁপে দিলেন ক্রিকেটার শচীনের কাছে। তার বুকেই মাথা রেখে সব নির্ভরতা খুঁজে পাওয়া অঞ্জলী ত্যাগ স্বীকার করলেন। তিনি শচীনকে বললেন, ‘আমি চাই তুমি তোমার স্বপ্নের লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যাও। আমি স্বেচ্ছায় নিজের ক্যারিয়ারকে বিসর্জন দিচ্ছি। আমি আমার পরিবারের জন্য সবকিছুই ছাড়তে পারি।’ শচীনকে মন থেকে যেভাবে ভালবেসেছিলেন সে জন্যই এটা সম্ভব হয়েছিল অঞ্জলীর জন্য। পেশাদার ও ব্যক্তিগত জীবনে যত ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন অঞ্জলী কোন কিছুতেই জড়াননি শচীনকে। নীরবে নিজেই সবকিছুর সমাধান করেছেন। আর এটাই অঞ্জলীর প্রতি শচীনের ভালবাসা, টান এবং সম্মানটা বাড়িয়ে দিয়েছিল। শচীন দ্রুতই অনুধাবন করেন তিনি জীবনে এমন একজনকে পেয়েছেন যার ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায় এবং তীব্রভাবে ভালবাসা যায়। তবে শচীন তার আত্মজীবনীতে বলেছেন, ‘নিজের অনুভূতিটা প্রকাশ করার স্বভাব ছিল না আমার। সাধারণত সে কারণেই কারও প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করতে পারিনি। কিন্তু আমি নিঃসন্দেহে তার কাছে ঋণী।’ মজার বিষয় হচ্ছে শচীন কখনও অঞ্জলীকে তার নাম ধরে ডাকেননি। শচীন বুঝতেই পারেননি আসলে অঞ্জলীকে কি নামে ডাকলে যথার্থ হবে। তবে নাম ধরে না ডাকলেও সেটা বাড়তি কোন সমস্যা তৈরি করেনি। তবে বিয়ের পরে একটা অনাহুত ব্যাপার ঘটেছে শচীনের জীবনে। আগের চেয়ে একটু গা-ছাড়া হয়ে পড়েছিলেন এবং নিত্যনৈমিত্তিক কাজে ঢিল দিয়ে ফেলেছিলেন। আর সে কারণে অনেকখানি ওজন বেড়ে গিয়েছিল। হানিমুনে বেশ কিছুদিনের জন্য গোয়ায় ঘুরতে গিয়েছিলেন দু’জন। প্রতিযোগিতামূলক খেলার বাইরে আনন্দময় সময় কাটিয়েছেন তখন। কিন্তু ক্রিকেটটা তবু পিছু ছাড়েনি। গোয়ায় চার বন্ধু ছিল, তাদের নিয়ে ডাবল-উইকেট টুর্নামেন্ট খেলেছেন। অনেক বেশি চকোলেট এবং আইসক্রিম খাওয়ার কারণেও ওজন বেড়ে যায়। মুম্বাইয়ে ফেরার পর শচীন খেয়াল করলেন কোন পোশাকই আর পড়তে পারছেন না, আটসাট হয়ে গেছে সব। ১৯৯৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও ভারতের তেমন ব্যস্ততা ছিল না। সে জন্যই নিজের মতো করে স্বাধীন জীবনযাপন করেছেন ভালবাসার অঞ্জলীকে নিয়ে। তথ্যসূত্র : শচীন টেন্ডুলকরের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ অবলম্বনে
×