ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাহিদ রহমান

জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘নারী ফুটবল’

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘নারী ফুটবল’

ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার কলসিন্দুর গ্রামের অদম্য কিশোরী ফুটবলারদের সাফল্যের গল্প এখন সর্বত্র। একই গ্রামের একাধিক কিশোরী ফুটবলার বর্তমানে অনূর্ধ-১৪ জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন। শুধুমাত্র কিশোরী ফুটবলারদের কারণে বদলে গেছে কলসিন্দুর জনপদ। গত ডিসেম্বরে নেপালের মাটিতে নেপালকে হারিয়ে এএফসি অনূর্ধ-১৪ ফুটবলের আঞ্চলিক লড়াই-এর শিরোপা জয়ী বাংলাদেশ টিমে কলসিন্দুরের কিশোরীদেরই প্রাধান্য বেশি। কলসিন্দুরের বেশিরভাগ মেয়েই সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে আসা। যারা লড়তে এবং লড়াই করতে জানে। কলসিন্দুরের ঢেউই যেন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। কলন্দিুরের অনুপ্রেরণায় হাওড়বেষ্টিত কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনার মেয়েরাও ফুটবলে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত জনপদ ইটনা। হাওড়বেষ্টিত এ জনপদে দারিদ্র্যের হার যেমন বেশি তেমনি দুর্যোগেরও প্রভাব অনেক বেশি। স্থলভূমির সঙ্গে সরাসরি এই উপজেলার কোন যোগাযোগ নেই। ফলে গাড়ি যাতায়াতেরও সব সুযোগ বন্ধ। এই উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। শীত ও গ্রীষ্মে ইটনা উপজেলাকে খানিকটা চেনা গেলেও বর্ষায় দূর থেকে মনে হয় সাতসমুদ্রের মাঝে ভেসে থাকা কয়েকটি গাছপালা। এই উপজেলায় অনেক ধরনের সুবিধাদিই নেই। স্বচক্ষে না দেখলে বোঝার উপায় নেই জীবন এখানে কতটা কঠিন, কতটা বিষাদময়। অথচ সেই পিছিয়ে থাকা জনপদের মেয়েরাও এখন ফুটবল খেলে। খানিকটা অবাক হওয়ার মতোই ব্যাপার। দিন দিন মেয়েদের ফুটবলের যে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করেছে তার দেখা মেলে ইটনার মতো হাওড়বেষ্টিত উপজেলাতেও। এর আগে এই উপজেলার কোন মেয়ে কোনকালে ফুটবলে লাথি মেরেছে বলে প্রমাণ নেই। কিন্তু গত ডিসেম্বরে বেগম রোকেয়া দিবসে স্থানীয় জয়সিদ্ধি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ইটনা বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা ফুটবল খেলতে নামে উপজেলা মাঠে। ধর্মীয় ও সামাজিক রক্ষণশীলতা যখন চরম পর্যায়ে তখন ইটনার মতো দুর্গম প্রত্যন্ত এক উপজেলার মেয়েদের ফুটবল খেলা অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জকই বটে। আবার যশোরের ফুটবল কোচ ইমদাদুল হক সাচ্চুও মেয়েদের ফুটবলে রীতিমতো বিপ্লব করেছেন বললে ভুল হবে না। কারও সহযোগিতা ছাড়াই নিজ উদ্যোগে গত সাতবছর ধরে তিনি কিশোরী ফুটবলার তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছেন। সফলও হয়েছেন। এ পর্যন্ত তার হাতে গড়া এক ডজনেরও বেশি মেয়ে জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে। প্রয়াত বড় ভাই, বাফুফের মহিলা ফুটবল দলের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক বাচ্চুর অনুপ্রেরণাতেই বছর সাতেক আগে কিশোরী ফুটবলে মনোযোগী হন ইমদাদুল হক সাচ্চু। প্রথমে নিজ চেষ্টায় বিভিন্ন গ্রাম থেকে কিশোরীদের সংগ্রহ করেন এবং তাদের ফুটবল কেলতে উদ্বুদ্ধ করেন। এরপর কোচিং-এর জন্যে যশোর স্টেডিয়ামকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটারদের অনুশীলনের জন্যে এক সময় স্টেডিয়াম ছেড়ে দিতে হয়। পরে তিনি খানিকটা দূরে চলে যান। উপশহর ডিগ্রী কলেজের মাঠেই তিনি এখন অনুশীলনের কাজ করেন। যশোরের দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে মেয়েরা তার কাছে ফুটবল কোচিং নিতে আসে। দরিদ্র অনেক পরিবারের মেয়েই গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত দিতে পারেন না। কোচ ইমদাদুল হক সাচ্চু নিজে গাড়ি ভাড়া দিয়ে দেন। কোচিং করে এক টাকা উপার্জন করতে না পারলেও এই ফুটবল কারিগরের আত্মতৃপ্তির শেষ নেই। তার বড় তৃপ্তি তারই কোচিং প্রাপ্ত মেয়েরা জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন। গোলরক্ষক সাবিনাসহ বেলি, মলি, খাদিজা, খালেদা, সবুরা, সাজেদা, আসমা, মিতা, শারমীন, লিমা আরও অনেকেই জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন। বর্তমানে জাতীয় দলের হয়ে খেলছেন সাচ্চুর হাতে গড়া সাবিনা, খালেদা এবং খাদিজা। উল্লেখ্য যে, ইমদাদুল হক সাচ্চুর কারণেই যশোর কিশোরী ফুটবল দল জাতীয় চ্যাম্পিয়নশীপেও রীতিমতো আলোড়ন তোলে। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও রানার্স আপ হওয়ার কৃতিত্ব তাদের রয়েছে। তবে যশোরের মেয়েদের ফুটবলে যে উত্থান তার সব কৃতিত্বতই এই মানুষটির। অথচ মানুষটি সেই অর্থে কারও সহযোগিতাই পাননি। নিজের আগ্রহ, ভালবাসা আর চেষ্টা দিয়েই তিনি যশোরের মেয়েদের জাতীয় দলে ঠাঁই করে দেয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ইমদাদুল হক সাচ্চু মনে করেন মেয়ে ফুটবলারদের যে জাগরণ তৈরি হয়েছে সেটা ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন আরও কোচিং-এর ব্যবস্থা করা এবং প্রতিভাবান ফুটবলারদের বের করে আনা। কিশোরী ফুটবলার তৈরি করে ইমদাদুল হক সাচ্চু যার পর নেই খুশি। আর্থিকভাবে তিনি একটাকা লাভবান না হলেও যশোরে কিশোরী খেলোয়াড় তৈরি করে তিনি নিজেকে উচ্চমাত্রায় নিতে সক্ষম হয়েছেন বলে মনে করেন। তার মতে, যশোরবাসী তাকে এ কারণেই ভালবাসে। সবার কাছ থেকে তিনি মর্যাদাও পাচ্ছেন। এটিকেই তিনি তার বড় প্রাপ্তি বলে মনে করেন। শুধু ইটনা আর যশোর বলে কথা নয়, মেয়েদের ফুটবল এভাবেই গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন জায়গাতেই এখন কিশোরীরা ফুটবলে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। এই মুহূর্তে দেশের বিভিন্ন জায়গাতে মেয়েরা যেভাবে ফুটবলে আগ্রহী হয়ে উঠছে সেটা অবশ্যই আশাবাদী হওয়ার মতো বিষয়। হাওড়, পাহাড় জনপদে অজত্র মেয়ে আছে যারা ফুটবলে আগ্রহী ফুটবল খেলতে চায়। ইমদাদুল হক সাচ্চুর মতো কোচও আছে যারা নিজের খেয়ে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে নারী ফুটবলার তৈরিতে কোন কার্পণ্য দেখাবে না। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মেয়েদের ফুটবলের যে জাগরণ লক্ষ্যণীয় সেটাকে এগিয়ে নিতে বাফুফেকে আরও সুদৃঢ় পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। বিশেষ করে মেয়েদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়া হলে আমাদের মেয়ে ফুটবলাররা আগামীতে আরও যে উজ্জ¦ল আলোময় ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম হবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
×