ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মোঃ নুরুজ্জামান

অশালীন আচরণেও গেইলের ছক্কা!

প্রকাশিত: ০৭:১৪, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

অশালীন আচরণেও গেইলের ছক্কা!

ক্রেজী, প্লেবয় শব্দগুলো যাদের সঙ্গে যায় ক্রিস গেইল তাদের অন্যতম। ক্যারিবিয়ান ব্যাটিং-দানবের চলন-বলন লাইফ-স্টাইলের সঙ্গে বিষয়টা হয়ত মানিয়েও যায়। কিন্তু ভদ্রলোকের খেলা ক্রিকেটে সেটি ঠিক কতটা যায়, তা বোধহয় ভুলে গেছেন গেইল। নইলে বার বার কেন এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, অশালীন আচরণ করে কেনই বা এভাবে শিরোনাম হওয়া। আবার অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে জ্যামাইকান উইলোবাজ। ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া টি২০ টুর্নামেন্ট বিগ ব্যাশের। বেলেরিভ ওভালে হোবার্ট হারিকেন্সের বিপক্ষে মেলবোর্ন রেনেগেডসের হয়ে ৪ চার ও ৩ ছক্কায় ১৫ বলে ৪১ রানের ম্যারাথন ইনিংস খেলে ফেরার সময় তার সাক্ষাতকার নিতে যান চ্যানেল টেনের জনপ্রিয় প্রমীলা উপস্থাপক মেল ম্যাকলফলিন। তখনই অত্যন্ত কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে তোলপাড় ফেলে দেন ৩৬ বছর বয়সী গেইল। ম্যাকলফলিন জিজ্ঞেস করেন বিধ্বংসী এই ইনিংসের পর কি আশা করছেন? জবাবে গেইল বলেন, ‘আমি তোমাকে সাক্ষাতকার দিতেই আসতে চেয়েছি। প্রথমবারের মতো তোমার চোখ দুটো দেখতেই তো আমি এখানে। এটা খুবই সুন্দর। আশা করছি আমরা ম্যাচটা জিতব এবং এরপর একসঙ্গে পান করব। লজ্জা পেও না, বেবি।’ শেষ পর্যন্ত ম্যাচটা ৫ উইকেটে জেতে গেইলের রেনেগেডস। আচমকা তার এমন মন্তব্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান ওই প্রমীলা উপস্থাপক। টুর্নামেন্ট প্রধাণ এভেরার্ড বলেন, ‘আমি গেইলের মন্তব্য শুনেছি। এটা অপমানকর এবং একদমই শোভন নয়। বিগ ব্যাশে এমন আচরণের কোন স্থান নেই।’ গেইলের দল রেনেগেডসের প্রধান নির্বাহী স্টুয়ার্ট কভেন্ট্রিও এভেরার্ডের সঙ্গে একমত। ঘটনার সময় সাবেক দুই তারকা ড্যামিয়েন ফ্লেমিং ও মার্ক ওয়াহ ধারাভাষ্যে ছিলেন, তারা গেইলের মন্তব্যের জন্য দর্শকদের কাছে ক্ষমা চান। গেইলকে তার দলের পক্ষ থেকে সাত হাজার মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয়। তবে ভবিষ্যতে এমন হলে আরও বড় শাস্তি পেতে হবে। রেনেগেডস নির্বাহী কভেন্ট্রি আরও বলেন, ‘গত চার-পাঁচ সপ্তাহ ধরে ও আমাদের হয়ে খেলছে। এই সময়ে তার আচরণ ছিল দারুণ। এসব বিবেচনা করেই গেইলকে জরিমানা করা হয়েছে। ও হয়ত ঠাট্টা করে কথাগুলো বলেছে, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতির বিচারে ওগুলো ছিল অনভিপ্রেত।’ চ্যানেল টেনের হেড অব স্পোর্টস ক্ষুব্ধ কণ্ঠে জানান, ‘আমরা গেইলকে আর ম্যাচে কাজে লাগাব না। যদি আগামী কয়েকদিনের মধ্যে কিছু না বদলায়, এমন কি ওকে যেন আর না খেলানো হয় আমরা সেই আবেদন করব। এটা খুবই নোংড়া ব্যবহার।’ গত বছর জুলাইয়ে ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লীগেও (সিপিএল) একবার এমন আচরণ করেছিলেন গেইল। উইকেট নিয়ে প্রশ্ন করায় এক প্রমীলা সংবাদকিকে অশোভন কথা বলেছিলেন তিনি। এখানেই শেষ নয়। গেইলের বিরুদ্ধে সরসারি যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন এক নারী। ঘটনাচক্রে এই নারীও একজন অস্ট্রেলীয়। গত বিশ্বকাপে খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সঙ্গে তিনি তখন অস্ট্রেলিয়ায়। ক্যারিবীয় দলের হয়ে কাজ করছিলেন সেই নারী। একদিন ড্রেসিংরুমে স্যান্ডউইচ নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তখন শুধু একটা তোয়ালে পরে ড্রেসিংরুমে বসেছিলেন গেইল। এরপরের ঘটনা অস্ট্রেলিয়ার ফেয়ারফ্যাক্স মিডিয়াকে নিজেই বর্ণনা করেছেন, ‘গেইলের সঙ্গে তখন আরেকজন খেলোয়াড় ছিলেন। হঠাৎ তিনি (গেইল) তোয়ালে নামিয়ে, তাঁর পুরুষাঙ্গ আংশিক প্রদর্শন করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি এটার খোঁজ করছেন?’ কথাটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।’ গত বিশ্বকাপে মাত্র চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন গেইল। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তাঁর ২১৫ রানই বিশ্বকাপের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। তবে গেইলের এমন কীর্তি নিয়ে মোটেও উচ্ছ্বসিত নন ওই নারী। এই আক্রমণাত্মক ওপেনারের ‘কীর্তিকলাপে’ তিনি বরং বিরক্ত, ‘এ ধরনের ব্যক্তিকে বীরের আসনে বসতে দেখলে আমি রীতিমতো অসুস্থ হয়ে পড়ি! তিনি নারীদের সঙ্গে যেমন আচরণ করেন তাতে বীরত্বের কিছু নেই।’ এর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরোয়া টি২০ সিপিএলের এক ম্যাচে স্থানীয় নারীর সঙ্গে কুরুচিপূর্ণ আচরণ করে সমালোচিত হন গেইল। এই অবস্থায় তাঁকে বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ করার ডাক দিয়েছেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ইয়ান চ্যাপেল। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) কাছে প্রস্তাব রেখে তিনি বলেছেন, সিএ’র উচিত এখনই গেইলকে নিজেদের ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করা এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিতে এটি উত্থাপন করা। যাতে আইসিসি তাদের ক্ষমতা বলে বিশ্বের প্রতিটি দেশের ঘরোয়া টুর্নামেন্ট থেকে তাঁকে নিষিদ্ধ করতে পারে। ‘সিএ যদি বিগ ব্যাশের ক্লাবগুলোকে বলে যে, আগামী বছর থেকে গেইলের সঙ্গে আর চুক্তি নয়, তাহলে ভাল লাগবে। আরও ভাল হবে যদি তারা বলে, বিশ্বব্যাপীই এটা করা উচিত!’ বলেন চ্যাপেল। একের পর এক অশালীন আচরণের জন্য গেইলকে বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ করতে হলে একটা জনমত গড়ে তুলতে হবে বলেও মনে করেন সত্তরের দশকের তুখোড় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ইয়ান চ্যাপেল ‘সিএ-র হাত ধরে সেটা বিশ্বব্যাপী করা উচিত, সেক্ষেত্রে হয়ত সবগুলো দেশের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে হবে। তবে আইসিসির সভায় যদি সিএ- প্রস্তাব দেয় যে, আমরা এটা (গেইলকে নিষিদ্ধ) করছি, এবং সবাইকে একই কাজ করতে পরামর্শ দিচ্ছি। তাহলে আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগবে।’ নারীদের সম্মান নিশ্চিত করতেই গেইলের ব্যাপারে সব ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক ঘরোয়া টুর্নামেন্টের আয়োজকদের কাছ থেকে ‘জিরো টলারেন্স’ আশা করছেন চ্যাপেল। তিনি বলেন, ‘যদি শুধু একবারের জন্য এমন হতো, তাহলে বলতাম ভুল হয়েছে, দশ হাজার ডলার জরিমানা ঠিক আছে, ভবিষ্যতে আর হবে না। কিন্তু গেইলের ব্যাপরে ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট যতজন নারীর সঙ্গে আমি কথা বলেছি, সবাই বলেছেন, তাদের নানা রকম কুপ্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ক্রিকেটের মতো ভদ্রলোকের খেলায় এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। সিএ-এর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী গেইলের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার এখনই সময়।
×