ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

হারিয়ে যাচ্ছে শকুন

পরিবেশের বন্ধু- আগের মতো দেখা মেলে না

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২০ জানুয়ারি ২০১৬

পরিবেশের বন্ধু- আগের মতো দেখা মেলে না

বশিরুল ইসলাম এক সময় লোকালয়ে শকুন দেখা যেত। বিশেষত বেশি দেখা যেত মৃত প্রাণীর চারপাশে। শকুনদের দলনেতা (প্রধান শকুন) ডানা মেলে অনুমতি দিত মৃত প্রাণী ভক্ষণের। মুহূর্তে ‘নাই’ হয়ে যেত মৃত প্রাণীর পচাদেহ। অনেকে আবার মৃত্যুর প্রতীক হিসেবেও কল্পনা করেন এ পাখিকে। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, শকুন যেহেতু মরা পশুর মাংস খায়, তাই প্রাণীটি সব সময় অন্য পশুর মৃত্যু কামনা করে থাকে। মনে করা হয়, পাখিটা অশুভ। কারও বাড়ির ওপর দিয়ে যদি শকুন উড়ে যায়, তাহলে তা অমঙ্গলের আভাস বলেই ধরে নেয়া হয়। কিন্তু সত্য কথা হলোÑ শকুন অশুভ তো নয়ই, হিংস্রও নয়। চিল, ঈগল বা বাজপাখির মতো শিকারিও নয়। এটা আমাদের পরিবেশের পরম বন্ধু। মৃত পশু খেয়ে শকুন আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু জীবিত মানুষকে আক্রমণ করত না কখনই। ফলে মানুষ যেমন নিরাপদ ছিল তেমনি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রধান নিয়ামক পরিবেশও থাকত পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ। কিন্তু ধীরে ধীরে পাখিটি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। আগের মতো গ্রামগঞ্জেও এখন আর দেখা মেলে না শকুনের। গ্রামগঞ্জে, বিশেষ করে জঙ্গলে, রাস্তা বা খালের পাশের উঁচু গাছে এক সময় প্রাণীটা এক বা একাধিক বাসা বানিয়ে থাকত। এখন তেমন গাছই নেই। তাই হারিয়ে যাচ্ছে। শকুন হারিয়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন এ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কেবিএম সাইফুল ইসলাম বলেন, শকুন একটি মৃতজীবী পাখি, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। এরা সাধারণত মৃত প্রাণী ভক্ষণ করে পরিবেশকে পরিষ্কার রাখে। কিন্তু ইদানীং বিভিন্ন দেশে গবাদিপশুর চিকিৎসায় ব্যবহৃত ‘ডাইক্লোফেনাক’ নামের ব্যথানাশক ওষুধের প্রভাবে শকুন মারা যাচ্ছে। এ কারণে ডাইক্লোফেনাক বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান ও নেপালে পশু চিকিৎসায় নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। তারপরও বাংলাদেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ ডাইক্লোফেনাক পশু চিকিৎসায় যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে শকুন বিলুপ্তির মুখে। কেননা এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শকুনের কিডনিতে পানি জমে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলেজ অব ভেটেরিনারি মেডিসিনের গবেষক ড. লিন্ডসে ওক তার এক গবেষণায় প্রমাণ করেন, পশু চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনাকের ব্যবহারই শকুন বিলুপ্তির অন্যতম কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মৃত পশুর মাংস শকুনের কোন ক্ষতি করে না; কিন্তু ডাইক্লোফেনাক দেয়া হয়েছে এমন মৃত পশুর মাংস খেলে কিডনি নষ্ট হয়ে ২-৩ দিনের মধ্যে শকুনের মৃত্যু ঘটে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে আবিষ্কার করেন যে, ডাইক্লোফেনাকের পরিবর্তে মেলক্সিক্যাম গ্রুপের ওষুধ যদি গবাদিপশুতে ব্যবহার করা হয় তাহলে শকুনের কোন ক্ষতি হয় না। এ কারণে গবাদিপশুতে ডাইক্লোফেনাকের পরিবর্তে মেলক্সিক্যাম গ্রুপের ওষুধ ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেয়া হয়। শকুনের বিলুপ্তির কারণ হিসেবে এর পাশাপাশি আরও কিছু বিষয়ের উল্লেখ করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) সহযোগী সংগঠন বার্ডসলিস্ট অর্গানাইজেশন। তারা কীটনাশক ও সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে পানির দূষণ, খাদ্য সঙ্কট, কবিরাজি ওষুধ তৈরিতে শকুনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার, বিমান-ট্রেনের সঙ্গে সংঘর্ষ, ঘুড়ির সূতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়া, ইউরিক এ্যাসিডের প্রভাবে বিভিন্ন রোগ, বাসস্থানের অভাব প্রভৃতি। শকুনের বাসা বাঁধার স্থানের অভাবের জন্য তাদের বংশবৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে কমছে। ড. কেবিএম সাইফুল ইসলাম আরও বলেন, পাশাপাশি আরও বড় একটি কারণ হলো বাসস্থানের অভাব। শিমুল, ছাতিম, দেবদারুর মতো বড় গাছগুলো এখন আর চোখে পড়ে না সেভাবে। এ গাছগুলো নির্বিচারে ব্যবহার হয়েছে চায়ের পেটি আর দিয়াশলাইয়ের কারখানায়। ইটের ভাঁটি, তামাক শুকানো আর পিচ গলিয়ে রাস্তা বানানোর জন্য গায়েব হয়ে গেছে রাস্তার পাশের বট, শেওড়া আর গাবের গাছ। সংরক্ষিত বনের ভেতরেও চলে নির্বিচারে বড় গাছগুলোর নিধন। শকুনগুলো বাসা বাঁধবে কোথায়?’ শকুন সংরক্ষণের বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্রফেসর মোঃ শাদাত উল্লা বলেন, শকুন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম সদস্য। শকুনকে বলা হয় প্রকৃতির ঝাড়ুদার। শকুন মরা গবাদিপশু খেয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি রোগজীবাণুর বিস্তৃতি রোধেও সহায়তা করে। তাছাড়া গবাদিপশুর যক্ষ্মা ও হগ কলেরার জীবাণু খুব সহজেই হজম করতে পারে শকুন, যেটা কুকুর, শেয়াল বা বিড়াল গোত্রের প্রাণীরা হজম করতে পারে না বরং ছড়িয়ে বেড়ায়। প্রকৃতিকে বিনষ্টকারী কোন কীটনাশক ব্যবহার থেকে সকলকে বিরত থাকার আহ্বান জানান প্রফেসর মোঃ শাদাত উল্লা। জানা যায়, জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগ, বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাব। যে সমস্ত স্থানে এখনও শকুন টিকে রয়েছে, সে স্থানের মানুষজনকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া মৃত প্রাণীকে সঙ্গে সঙ্গে সৎকার না করে শকুনের জন্য ফেলে রাখার জন্যও উৎসাহিত করা হবে। যেমনটি করা হয়েছে স্পেনে। এ বিষয়ে সাইফুল ইসলাম জানান, গাজীপুরে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে তৈরি করা হচ্ছে ভালচার ব্রিডিং সেন্টার। এখানে বাংলা শকুনসহ অন্যান্য বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির শকুনের বংশবৃদ্ধির জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হবে। অসুস্থ শকুনকে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা ও শকুনের দেহ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন জীবাণুর নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থাও থাকছে। একই সঙ্গে দেশের শকুন অধ্যুষিত এলাকার বড় গাছগুলোকেও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ‘আইইউসিএন বাংলাদেশ’ প্রথমবারের মতো চুনারুঘাটের রেমাকালেঙ্গা বনে স্থাপন করেছে শকুনের খাবার স্টেশন। কোন গৃহপালিত প্রাণী মারা গেলে ডাইক্লোফেনাক, কিটোপ্রোফেন টেস্ট করে যদি ভাল প্রমাণিত হয় তবে দেয়া হবে খাবার স্টেশনে।
×