ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী

ছেলের সামনে পাশবিক নির্যাতনে মাকে হত্যা ॥ তিন আসামি গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

ছেলের সামনে পাশবিক নির্যাতনে মাকে হত্যা ॥ তিন আসামি গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে মুখে স্কচটেপ পেঁচিয়ে চার বছরের ছেলের সামনে পাশবিক নির্যাতনের পর মাকে হত্যার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় তিন হত্যাকারী গ্রেফতার হয়েছে। গ্রেফতারের পর হত্যাকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এমন লোমহর্ষক কাহিনী। কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় পৈশাচিক নির্যাতনের পর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পারভেজ ও ফারুক হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছে। মূল পরিকল্পনাকারী মেহেদী হাসানকে দু’দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। কামরাঙ্গীরচর থানার নয়াগাঁও এলাকায় মাজেদা ভিলা নামে একটি সাততলা বাড়ির নিচতলায় ঘটনাটি ঘটে। ফ্ল্যাট থেকে নার্গিস আক্তার (৩০) নামে এক মহিলার হাত-পা বাঁধা মুখে স্কচটেপ পেঁচানো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নিহতের ভাই জাহাঙ্গীর বাদী হয়ে নিহতের স্বামী ইব্রাহিম মোল্লা ও তার দুই ভাই কামাল মোল্লা এবং হেলাল মোল্লাকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় নিহতের স্বামী ও কামালকে গ্রেফতারের পর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকা-ের সঙ্গে তাদের কোন সম্পৃক্ততার প্রমাণ মেলেনি। এরপর শুরু হয় নতুন করে তদন্ত। ইতোমধ্যে নিহতের ছেলে ইফাদ পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয়। তদন্তে নতুন গতি আসে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৭ জানুয়ারি কুমিল্লা থেকে ফারুক, মাদারীপুর থেকে পারভেজ ও ঢাকা থেকে মেহেদী হাসানকে গ্রেফতার করা হয়। এদের সবার বয়স ৩০ থেকে ৩২ বছরের মধ্যে। তাদের কাছ থেকে নিহতের বাড়ি থেকে খোয়া যাওয়া দুটি মোবাইল ফোন, দুটি স্বর্ণের চেন ও একটি স্বর্ণের আংটি উদ্ধার করা হয়। এছাড়া হত্যাকা-ের সময় ব্যবহৃত তিনটি মুখোশও পাওয়া যায়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে নার্গিস হত্যার আসল রহস্য। সোমবার ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে হত্যাকা-ের বিস্তারিত ঘটনা প্রকাশ করেন লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। এ সময় লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সঞ্জিত কুমার রায়, মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার এসএম জাহাঙ্গীর আলম সরকার, সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার আরএম ফয়জুর রহমানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মফিজ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, ঘটনার সূত্রপাত তিন মাস আগে। বাড়িটিতে প্রায় তিন মাস ধরে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ায় স্বামী ইব্রাহিম মোল্লা (৪০) স্ত্রী নার্গিস আক্তার (৩০) ও একমাত্র ছেলে ইফাদকে (৪) নিয়ে বসবাস করছিলেন। স্বামী ঢাকার নীলক্ষেত মার্কেটে ফটোকপির ব্যবসা করেন। সকালে বাসা থেকে বের হয়ে ফেরেন গভীর রাতে। সুন্দরী গৃহবধূ বাসায় ছেলেকে নিয়ে থাকেন। নার্গিসদের ফ্ল্যাটের ঠিক সামনেই বসবাস করে মেহেদী হাসান। মেহেদীর কুনজর পড়ে নার্গিসের ওপর। মেহেদী বাসায়ই এমব্রয়ডারির কাজ করে। এজন্য সারাক্ষণ বাসায়ই থাকত। নানাভাবে নার্গিসকে মেহেদী কুপ্রস্তুাব দিয়ে আসছিল। কোনকিছুতেই নার্গিস তাতে রাজি হচ্ছিল না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মেহেদী নার্গিসকে ব্ল্যাকমেলের পরিকল্পনা করে। মেহেদী তার ব্যবসায়ী বন্ধু কুমিল্লায় বসবাসরত গ্রেফতারকৃত ফারুক ইসলাম এবং মাদারীপুরে বসবাসরত পারভেজকে জরুরী কাজের কথা বলে তার বাসায় ডেকে আনে। এরপর নার্গিসের আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করার পরিকল্পনা করে। সে মোতাবেক ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর মেহেদী মুখোশ পরে নার্গিসদের বাসার দরজায় নক করে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে মেহেদীর মুখোশ পরা সহযোগী ফারুক ও পারভেজ একত্রে নার্গিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দ্রুত মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। হাত-পা বেঁধে ফেলে। এ সময় চিৎকার শুনে পাশের রুমে খেলতে থাকা ইফাদ দৌড়ে মায়ের কাছে আসে। ইফাদের মুখেও স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। পরবর্তীতে অনেকটা ইফাদের সামনেই নার্গিসের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তারা সে দৃশ্য ভিডিও করে। স্কচটেপ দিয়ে নাক-মুখ পেঁচানোর ফলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে নার্গিস মারা যায়। নির্যাতন শেষে হত্যাকারীরা বাসা থেকে স্বর্ণের চেন, আংটি, মোবাইল ফোন নিয়ে দ্রুত দরজা খোলা রেখেই পালিয়ে যায়। এ সময় ইফাদ বেরিয়ে বিষয়টি প্রতিবেশীদের জানায়। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। মূলত আপত্তিকর দৃশ্য ধারণ করে নার্গিসকে ব্ল্যাকমেল করার পরিকল্পনা করেছিল গ্রেফতারকৃতরা। আপত্তিকর দৃশ্য দেখিয়ে নার্গিসকে গ্রেফতারকৃতদের কথামতো নানা আজেবাজে কাজ করতে বাধ্য করানোর পরিকল্পনা ছিল। মূলত নার্গিসের সঙ্গে অনৈতিক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতেই মেহেদীর পরিকল্পনায় ঘটনাটি ঘটে। নার্গিসকে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল না গ্রেফতারকৃতদের। কিন্তু ঘটনাচক্রে নার্গিস শ্বাসরোধে মারা যায়। ডিসি আরও জানান, প্রকৃত ঘটনা আদালতে তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে নিহতের স্বামী ও তার ভাইসহ অন্যদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আদালতের প্রতি অনুরোধ জানানো হবে। বর্তমানে নার্গিসের স্বামী ইব্রাহিম মোল্লা ও ইব্রাহিমের ভাই কামাল কারাগারে রয়েছেন। বিকেলে আসামিদের ঢাকার সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়। আসামিদের মধ্যে পারভেজ ও ফারুক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে হত্যার দায় স্বীকার করেছে। ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মেহেদী হাসানকে দু’দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
×