ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে

দাউদ মার্চেন্টকে হস্তান্তর করা হচ্ছে ॥ কে আসবে স্পষ্ট নয়

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

দাউদ মার্চেন্টকে হস্তান্তর করা হচ্ছে ॥ কে আসবে স্পষ্ট নয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অবশেষে ভারতীয় সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব গুলশান কুমার হত্যা মামলার পলাতক আসামি মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীম ও ছোটা শাকিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ভারতীয় নাগরিক বহুল আলোচিত আব্দুর রউফ দাউদ মার্চেন্টকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এ বিষয়ে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলাপ আলোচনা চলছে। তবে কবে নাগাদ দাউদ মার্চেন্টকে তুলে দেয়া হবে, সে সর্ম্পকে কোন দেশের তরফ থেকেই সুস্পষ্ট করে কিছু জানানো হয়নি। এমনকি দাউদ মার্চেন্টের পরিবর্তে কাদের ফেরত আনা হচ্ছে সে বিষয় সর্ম্পকেও দুই দেশের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানানো হয়নি। নিরাপত্তাজনিত কারণে এমন গোপনীয়তা বজায় রাখা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে। ইতোপূর্বে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে বঙ্গবন্ধুর খুনী রিসালদার মুসলেহ উদ্দিনসহ দুইজন রয়েছে বলে দাবি করে আসছে। তাদের ফেরত পেতে বাংলাদেশ সরকার বারবার তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ভারত সরকারের তরফ থেকে বরাবরই এমন দাবি নাকচ করা হচ্ছে। দুই সহযোগীসহ অনুপ চেটিয়া এবং সর্বশেষ দাউদ মার্চেন্টকে ভারতে হস্তান্তরের পর বিনিময় হিসেবে ভারতে থাকা বিএনপি নেতা পলাতক সালাহউদ্দিন আহমেদ, ভারতের তিহার জেলে বন্দী ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী দুই সহোদর মুরসালিন ও মুত্তাকিন, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, সাজ্জাদ হোসেনসহ অনেককেই ফেরত আনার আলোচনার কথা শোনা যাচ্ছে। যদিও দুই দেশের তরফ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোন কিছুই জানানো হয়নি। সোমবার নিজের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, কারাবন্দী ভারতীয় নাগরিক আবদুর রউফ ওরফে দাউদ মার্চেন্টকে ভারতে ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। মার্চেন্টের পরিবর্তে কাউকে আনতে হবে বিষয়টি তেমন নয়। যেসব বিদেশীর সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে, তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস এবং স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ চলছে। ভারতেরও কয়েকজনের সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাদেরও ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই দাউদ মার্চেন্টকে ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মন্ত্রী বলেন, দাউদ মার্চেন্টের সাজা শেষ হওয়ার কথা বললেও বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইনে করা মামলার রায় এখনও হয়নি। জানা গেছে, ভারতের কারাগারে বন্দী বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদের বদলে দাউদকে ফেরত দেয়া হচ্ছে। এমন গুঞ্জনের মধ্যেই মন্ত্রী এমন বক্তব্য দিলেন। অবশ্য দাউদ মার্চেন্টের বদলে বাংলাদেশ কাউকে ফেরত পাচ্ছে কি-না সে বিষয়ে মন্ত্রী কোন বক্তব্য দেননি। জানা গেছে, নিরাপত্তাজনিত কারণে দুই দেশই এ ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে। উলফা নেতা অনুপ চেটিয়ার বিনিময়ে সাত খুনের আসামি নূর হোসেনকে ফেরানোর মতো দাউদ মার্চেন্টসহ কয়েকজনকে ভারতের হাতে তুলে দিয়ে সালাহ উদ্দিনকে ফেরানো হতে পারে। গত নবেম্বরে ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত স্বরাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে আসামি প্রত্যর্পণ নিয়ে আলোচনার পরই দাউদ মার্চেন্টের মামলা তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভারত তাদের জঙ্গী সংগঠন আসিফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের নেতা মোস্টওয়ান্টেড মাওলানা মনসুর আলী ওরফে হাবিবুল্লাহ, মুফতি ওবায়দুল্লাহ ওরফে আবু জাফর, মাওলানা এমাদুল্লাহ এবং কলকাতার সন্ত্রাসী ও মাফিয়া ডন ছোটা শাকিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাহিদ শেখ এবং আরিফ হুসাইনকে ভারতের তরফ থেকে ফেরত চাইলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি দিপু, চট্টগ্রামের শিবির নেতা সাজ্জাদ হোসেন, চরমপন্থী নেতা মুক্তার হোসেন, ভারতের তিহার জেলে বন্দী একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলায় সরাসরি অংশ নেয়া সহোদর মুরসালিন ও মুত্তাকিনসহ বেশ কয়েকজনকে ফেরত চাওয়া হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। যদিও এসব বিষয়ে কোন দেশের তরফ থেকেই সুস্পষ্ট কোন বক্তব্য আসেনি। প্রসঙ্গত, মুম্বাইয়ের সঙ্গীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টি-সিরিজের মালিক গুলশান কুমারকে ১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট আন্ধেরী প্রদেশের একটি মন্দির থেকে প্রার্থনা শেষে বের হওয়ার পর গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। এ মামলায় দাউদ মার্চেন্ট গ্রেফতার হয়। ২০০২ সালে ভারতীয় আদালত তাকে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন দাউদ মার্চেন্ট। ২০০৯ সালে ১৪ দিনের প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান। ২০০৯ সালের ২৭ মে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলা সদর থানা এলাকা থেকে ভারতের মোস্টওয়ান্টেড আব্দুর রউফ দাউদ মার্চেন্টকে গ্রেফতার করে। দাউদের তথ্য মতে, ভারতের আরেক মোস্টওয়ান্টেড মাফিয়া ডন ছোটা শাকিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ভারতীয় নাগরিক জাহিদ শেখকে গ্রেফতার করা হয়। জাহিদ শেখ ও দাউদ মার্চেন্টের বিরুদ্ধে ভারতের বহু শিবসেনা হত্যার অভিযোগ রয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা হয়। কয়েক দফায় রিমান্ড শেষে তাদের কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০৯ সালের ২৬ আগস্ট পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশের ভারতীয় হাইকমিশনের দুইজন কর্মকর্তা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে দাউদ মার্চেন্ট ও জাহিদ শেখের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে দাউদ মার্চেন্ট গাজীপুর জেলার কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তির পর আবার ডিবির হাতে আটক হন। ডিবি পুলিশ তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখায়। গত ১৪ জানুয়ারি দাউদ মার্চেন্টকে ৫৪ ধারায় করা ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। প্রতিবেদনে দাউদ মার্চেন্টের অন্যান্য মামলা সংক্রান্ত তথ্যও উল্লেখ করা হয়। মার্চেন্টের বিরুদ্ধে নতুন কোন মামলা নেই বলেও জানানো হয় ওই প্রতিবেদনে। ডিবি সূত্র বলছে, যে অভিযোগের কারণে সন্দেহভাজন হিসেবে ৫৪ ধারায় দাউদ মার্চেন্টকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সে বিষয়ে তদন্তে কোন তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায়নি। এজন্য মামলাটি থেকে দাউদ মার্চেন্টকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় দাউদ মার্চেন্টকে ভারতের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে প্রাথমিক আলাপ আলোচনা চলছে। ইতোপূর্বে গত বছরের ১১ নবেম্বর বহুল আলোচিত ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব অসম (উলফা)-এর সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়ুয়াকে তার দুই সহযোগী লক্ষ্মী প্রদীপ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকে ভারত সরকারের প্রতিনিধিদের কাছে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে উলফা চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, সামরিক শাখার উপ-প্রধান রাজু বড়ুয়া, পররাষ্ট্র সচিব শশধর চৌধুরী, অর্থসচিব চিত্রবন হাজারিকা, সংস্কৃতি সচিব প্রণতি ডেকা ও পরেশ বড়ুয়ার পরিবারের সদস্যসহ অন্তত ২৮ জনকে ভারত সীমান্ত দিয়ে পুশব্যাক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের তরফ থেকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন কিছুই জানানো হয়নি।
×