ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সরষে ক্ষেতে মৌমাছি চাষ

ওই ফুল ফোটে বনে যাই মধু আহরণে...

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

ওই ফুল ফোটে বনে যাই মধু আহরণে...

এমএ রকিব ॥ মৌমাছি মৌমাছি কোথা যাও নাচি নাচি, দাঁড়াও না একবার ভাই। ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই- ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি দেখে ছোটবেলার ওই ছড়াটির কথা মনে পড়ে যায়। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন শোভা পাচ্ছে হলুদের সমারোহ। ফুটেছে সরিষার ফুল। তাই মৌমাছিদের যেন কোন ফুরসত নেই। মহাব্যস্ত এখন তারা মধু আহরণে। ভোঁ ভোঁ শব্দ তুলে দলে দলে তারা ছুটে যাচ্ছে দূর বহু দূর। উড়ে উড়ে ফুল থেকে মধু চুষে নিয়ে আবার আসছে ফিরে। সংগৃহীত ওই মধু তারা সঞ্চয় করছে মৌচাকে। তবে এটা কোন প্রাকৃতিক মৌচাক নয়। তারা মধু ঢালছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বাক্সবন্দী মৌচাকে। ৮-১০ দিন পর পর সেখান থেকে আহরণ করা হচ্ছে ১৮-২০ মণ মানসম্মত মধু। সেই সঙ্গে ফুলে ফুলে মৌমাছির বিচরণের মধ্য দিয়ে পরাগায়ণ হয়ে ২০-৩০ ভাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে সরিষার ফলন। অপরদিকে এ দৃশ্য স্থানীয় চাষীদের মৌ চাষের প্রতি করছে উদ্বুদ্ধ। কুষ্টিয়া শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের দুই পাশজুড়ে এখন বিস্তীর্ণ সরিষা ক্ষেত। এর মাঝেই এক মাস আগে উজানগ্রাম ইউনিয়নের বিত্তিপাড়া এলাকায় কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্যোগে বসানো হয়েছে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌমাছি চাষের ছোট বড় দুই শতাধিক বাক্স। উদ্দেশ্য মানসম্মত মধু সংগ্রহ, পরাগায়ণের মাধ্যমে সরিষার ফলন বৃদ্ধি করা ও স্থানীয় চাষীদের মৌ চাষের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে তোলা। আধুনিক পদ্ধতির মধু চাষী ‘আদর্শ মৌ খামার’র মালিক শাজাহান আলী ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ থেকে কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়ায় মধু সংগ্রহের কাজ করছেন। তিনি এসেছেন পাবনার ঈশ্বরদী থানার চরকদিমপাড়া থেকে। এর আগে একই পদ্ধতিতে তিনি কাজ করেছেন একই জেলার ভাঙ্গুরা থানার চলনবিল এলাকায়। দেড় মাসে বিত্তিপাড়া থেকে তার মধু উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে ৪ টন। খামারে বসে কথা হয় শাজাহান আলীর সঙ্গে। তিনি জানান, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বাক্সের ভেতর ‘রানী মৌমাছি’ রেখে মৌ চাষ করা হয়। সরিষা ক্ষেতের পাশে বসানো হয়েছে দুই শতাধিক বাক্স। প্রতিটি বক্সের ভেতর একটি করে ‘রানী মৌমাছি’ আর থাকে ৫ থেকে ১০টি ফ্রেম। এই ফ্রেমগুলোই হচ্ছে ‘মৌচাক’। ঘরে বসে থাকা রানী মৌমাছির খাবার (মধু) যোগাতে ঝাঁকে ঝাঁকে কর্মী মৌমাছি ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে এনে জমা করে ওই মৌচাকে। তিনি জানান, এখানে ‘এফিস মেলিফেরা’ জাতের মৌমাছির চাষ করা হচ্ছে। এরা সাধারণত ২ থেকে ৩ কিলোমিটার দূর থেকেও মধু সংগ্রহ করতে পারে। ৮-১০ দিন পর পর এসব চাক থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে বের করা হচ্ছে ১৮ থেকে ২০ মণ পর্যন্ত সরিষার সুস্বাদু মধু। মাঠে বসেই এ মধু বিক্রি হচ্ছে ৩শ’ টাকা কেজি দরে। তবে উৎপাদিত বেশির ভাগ মধুই রফতানি হয়ে যায় বিদেশে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কুষ্টিয়া সদর বিত্তিপাড়া ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার আসারুল হক জানান, এর আগে বিত্তিপাড়া ও মহিষাডাঙ্গা এলাকায় রোপা আমন ধান চাষের পর হেক্টর-হেক্টর জমি পড়ে থাকত অনাবাদি। প্রায় তিন বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উদ্যোগে সেখানে রিলে চাষের (চাষ ছাড়া) মাধ্যমে সরিষা আবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে তোলা হয়। এ পদ্ধতিতে পাকা আমন ধান কেটে নেয়ার ১০-১২ দিন আগে জমিতে প্রয়োজনীয় সার ও সরিষার বীজ ছড়িয়ে দেয়া হয়। এতে পাকা ধান কেটে নিলেও সরিষার কোন ক্ষতি হয় না। এই পদ্ধতি বেশ কাজে লাগে এবং ওই সব পতিত জমিতে শুরু হয় সরিষার আবাদ। আসারুল জানান, সরিষার আবাদ হলেও তাতে আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই ফলন বৃদ্ধির জন্যই এবার সরিষার জমিতে স্থাপন করা হয়েছে মৌমাছি। ফুলে ফুলে মৌমাছি বিচরণের ফলে পরাগধানী ও পারাগরেণু এই দুই ফুলের মধ্যে ঘটে পরাগায়ণ। এতে সরিষার দানা পুষ্টসহ ফলন বৃদ্ধি পায়। এ পদ্ধতিতে ২০-৩০ ভাগ পাওয়া যাবে অতিরিক্ত ফলন। কুষ্টিয়া সদর উপজেলা কৃষি অফিসার সেলিম হোসেন বলেন, তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সরিষার জমিতে মৌমাছি পালন করছি। এখানে মৌ খামারিদের উদ্দেশ্য মধু সংগ্রহ করা। আর কৃষি বিভাগের উদ্দেশ্য পরাগায়ণের মাধ্যমে সরিষার ফলন বৃদ্ধি করা। পাশাপাশি মৌমাছি চাষে স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে তোলা, যাতে তারা এই চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানো। তিনি জানান, বিত্তিপাড়া থেকে দেড় মাসে আমাদের ৪ টন মধু উৎপাদনের লক্ষমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে গত ১ মাসেই আমরা ৩ টনেরও বেশি মধু সংগ্রহ করেছি। এবার আশানুরূপ সরিষার ফলন হবে বলেও আমরা আশা করছি। স্থানীয় কৃষক হারুন আলী বলেন, মৌ চাষের এই দৃশ্য আমাদের উদ্বুদ্ধ করছে। আগামীতে এ পদ্ধতিতে মধু আহরণের উদ্যোগ নেবেন বলেও জানান তিনি।
×