ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয়;###;কমতে পারে আটা ডাল গম মাংস ডেইরিপণ্য ভেজিটেবল অয়েল ও চিনির দাম

ট্যারিফ কমিশন রিপোর্টের ভিত্তিতে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

ট্যারিফ কমিশন রিপোর্টের ভিত্তিতে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ

এম শাহজাহান ॥ বিশ্ববাজারের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় করে দেশে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ট্যারিফ কমিশন প্রতিটি নিত্যপণ্যের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারমূল্য পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে। এ প্রতিবেদন প্রস্তুত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে খাতভিত্তিক বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করে খাদ্যপণ্যের মূল্য কমানোর নির্দেশনা প্রদান করবে সরকার। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমানো হয়েছে ভোজ্যতেলের দাম। আগামীতে দাম কমানো হবে- আটা, ডাল, গম, ভুট্টা, মসলা, মাংস, ডেইরি পণ্য, ভেজিটেবল অয়েল ও চিনিসহ প্রভৃতির দাম। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। আন্তর্জাতিক বাজারে যেকোন খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে অভ্যন্তরীণ বাজারে দ্রুত তার প্রভাব পড়ে। ব্যবসায়ীরা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন। কিন্তু বিশ্ববাজারে বর্তমান খাদ্যপণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি নিম্নমুখী হলেও দেশে এর কোন ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বরং অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন অজুহাতে এখনও পণ্যের দাম বাড়িয়ে অতি মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম কমলেও দেশে ভোক্তারা সেই পরিমাণ আর্থিক সুফল পায় না। এতে মূল্য নিয়ে ক্রেতারা প্রতিনিয়ত ঠকছেন। আর তাই ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় এবার বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দাম নির্ধারণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন পাওয়ার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম সমন্বয়ের উদ্যোগ নেবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমছে। ট্যারিফ কমিশন আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বাজার অবজার্ভ (পর্যবেক্ষণ) করে প্রতিবেদন প্রস্তুত করছে। সেই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভোজ্যতেলের দাম লিটারপ্রতি ৫ টাকা কমানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্দেশ ও অনুরোধ রক্ষা করে ভোজ্যতেলের দাম কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ বাস্তবতায় অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কমানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করা হয়েছে। ট্যারিফ কমিশন প্রতিটি নিত্যপণ্যের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ মূল্য পর্যবেক্ষণ করে দাম সমন্বয়ের কৌশল নির্ধারণ করছে। আশা করছি, বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মূল্য নির্ধারণ করা গেলে ভোক্তাস্বার্থ রক্ষা করা যাবে। এদিকে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩০-৩৫ লাখ টন গম, ১৪-১৭ লাখ টন চিনি, সাড়ে ৩ থেকে ৪ লাখ টন সয়াবিন তেল, ১০-১১ লাখ টন পামঅয়েল ও ২৮ লাখ টনের বেশি সার আমদানি করা হয়। তবে অন্যতম কৃষি উপকরণ সারের দাম দেশে দুই বছর ধরে সমন্বয় করে কমানো হলেও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দাম কমেনি। শুধু তাই নয়, আমদানি করা এসব পণ্যের দাম কমার পূর্বাভাস দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। তাদের পক্ষ থেকে জ্বালানি, কৃষি, খাদ্যশস্য, অন্যান্য ভোগ্যপণ্য, সার, কৃষিজাত কাঁচামাল, ধাতু ও খনিজসহ ৪৫ পণ্যের দামের পরিবর্তন বিশ্লেষণ করা হয়। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশ গত বছর যেসব পণ্য আমদানি করেছে, তার মধ্যে খাদ্যপণ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। আর যত খাদ্যপণ্য আমদানি হয়েছে, তার ৭২ শতাংশ হলো গম, ভোজ্যতেল ও চিনি। শুধু তাই নয়, ২০১৪ সালের মে থেকে গত বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তেল, চিনি ও গমের দাম বিশ্ববাজারে এবং দেশে কত কমেছে, তার একটি পরিসংখ্যানও দেয়া হয়েছে। ওই হিসেবে দেখা যায়, গত বছরে বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে ২৭ শতাংশ, কিন্তু দেশে কমেছে ৫ শতাংশ। যদিও দেশী শিল্প রক্ষায় চিনির ওপর নতুন করে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করেছে সরকার। এই শুল্কারোপের ফলে এখন বাজারে চিনির দাম কিছুটা বেড়েছে। প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৪৮ টাকায়। অথচ এক মাস আগেও এই চিনি ৩৭-৪০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে। সব ধরনের সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে ১৯ শতাংশ কমলেও দেশে কমেছে ৬ শতাংশ মাত্র। আর গমের দাম ২৮ শতাংশ কমলেও দেশে কমেছে ৯ শতাংশ। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে পণ্যের দাম কমবে কিনা, সেটি নির্ভর করে সরকারের আমদানি নীতি ও মজুদ ব্যবস্থাপনার ওপর। এর সঙ্গে ব্যবসায়ীদেরও সদিচ্ছা প্রয়োজন। কিন্তু দাম সমন্বয়ে আমদানিকারক ও বিপণনকারীদের কোন উদ্যোগ নেই। তাছাড়া বাংলাদেশে বাড়তি চাহিদা মেটাতে আমদানির বিষয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। এর সুযোগ নেন আমদানিকারকরা। তাছাড়া যে হারে আমদানি মূল্য কমছে, সে হারে খুচরা ও পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম কমছে কিনা, তা তদারক করা হয় না। এ জন্যই বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের ভোক্তারা। যে কারণে কমছে খাদ্যপণ্যের দাম ॥ বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস, ডলারের মূল্য শক্তিশালী হওয়া, খাদ্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে চীনের চাহিদা কমে যাওয়া এবং রাশিয়ার অবরোধে প্রতিনিয়ত দাম কমেছে। খাদ্যপণ্যের দাম গত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’র তথ্যমতে, গত ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পর মাংস ছাড়া সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম এখন সবচেয়ে কম। গত জুলাই থেকে আগস্টের মধ্যে খাদ্যপণ্যের দাম কমেছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বাজারে প্রচুর সরবরাহ, জ্বালানি মূল্য হ্রাসসহ বিভিন্ন কারণে পণ্যের দাম কমেছে বলে দাবি করেছে সংস্থাটি। ফাওয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে বিশ্ববাজারে চিনির দাম কমেছে। সেখানে দেখা গেছে, আগস্টে চিনির মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারে গড়ে ১৬৩ দশমিক ২ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে, যা গত জুলাইয়ের তুলনায় ১৮ পয়েন্ট কম। আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে গুঁড়োদুধের দামও। ফাও বিশ্ববাজারের মূল্য পর্যালোচনা করে বলেছে আগস্টে গুঁড়োদুধের গড় মূল্যের দাম কমেছে ১৩৫ দশমিক ৫ পয়েন্ট। কিন্তু গত জুলাই মাসের তুলনায় আগস্টে এসে কমেছে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ মূল্য কমার বড় একটি কারণ হিসেবে বলা হয় গত তিন মাস চীন গুঁড়োদুধ আমদানি হ্রাস করেছে। এছাড়া বিশ্বে গত বছর গমের মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭২ কোটি ৮০ লাখ টন, যা গত বছরের চেয়ে ৫০ লাখ টন বেশি। চীন এবং ভারত পামঅয়েলের আমদানি কমিয়ে দেয়ায় বিশ্ববাজারে দাম কমে যাচ্ছে। মজুদ বাড়ছে পামঅয়েলের ॥ মালয়েশিয়া থেকে সিংহভাগ ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়। বর্তমানে দেশটিতে পামঅয়েলের মজুদ বেড়েই চলছে, যা পাঁচ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় শীর্ষ উৎপাদনকারী এ দেশ থেকে পণ্যটির রফতানি হ্রাস পাওয়ায় মজুদ বেড়েছে। মালয়েশিয়ান পামঅয়েল বোর্ডের (এমপিওবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিলে দেশটিতে মজুদ হয়েছে ২১ লাখ ৯০ হাজার টন পামঅয়েল, যা আগের মাসের চেয়ে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। দেশটির পামঅয়েল উৎপাদনকারী অন্যতম অঞ্চল সাবাহা ও সারাওয়াকে সবচেয়ে বেশি পণ্য উৎপাদন হয়েছে। এদিকে উৎপাদন ও মজুদ বাড়ায় নিম্নমুখী রয়েছে পণ্যটির দাম। বিশ্ববাজারে দাম কমায় দেশেও ভোজ্যতেলের দাম কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী ও সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমান বলেন, লিটারপ্রতি ভোজ্যতেলের দাম ৫ টাকা কমানো হয়েছে। বিশ্ববাজারে দাম কমায় দেশেও দাম কমানো হয়েছে বলে জানান তিনি। জ্বালানি তেলের দাম কমছেই ॥ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বর্তমানে ব্যারেলপ্রতি ৩০ ডলারের নিচে নেমে আসে, যা ২০০৩ সালের পর সবচেয়ে কম। তিন বছর আগেও এ দর ব্যারেলে ১২০ ডলারের কাছাকাছি ছিল। বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম ২০১৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছিল ১০০ ডলারের বেশি। সেখান থেকে দেড় বছরের মধ্যে তা এভাবে নেমে আসার মূল কারণ চাহিদার তুলনায় অতি সরবরাহ। ওপেকভুক্ত দেশগুলো প্রতিদিন ১০ লাখ ব্যারেল চাহিদাতিরিক্ত তেল উৎপাদন করছে। গত বছরের অতিরিক্ত উৎপাদনের ফলে জমা হয়েছে ৩০০ কোটি ব্যারেল তেল। জ্বালানি তেলের দাম কমায় উৎপাদন ও সরবরাহ খরচ কমে আসছে। এ কারণে নিত্যপণ্যের মূল্য দ্রুত কমে আসছে।
×