ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এনামুল হক

ধ্রুপদী সঙ্গীতের উৎস সন্ধানে

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

ধ্রুপদী সঙ্গীতের উৎস সন্ধানে

আমেরিকা বা ইউরোপে বসবাসরত যে কোন শিল্পকলা অনুরাগী ইউরোপের বাইরের অনেক লেখক-সাহিত্যিক, শিল্পী ও ভাস্করকে চেনেন, জানেন। তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন। কিন্তু তাদের খুব কমজনই এমন একজন সুরকার বা সুরস্রষ্টার নাম বলতে পারবেন যিনি চীনের বা তুরস্কের। তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোন তথ্য পরিবেশন করতে পারা তো আরও দূরের কথা। তারা যে এদিক দিয়ে কতখানি বঞ্চিত হচ্ছেন সেটাই দেখান হয়েছে ‘দি আদার ক্লাসিক্যাল মিউজিকস নামক প্রবন্ধ সঙ্কলনে। ব্রিটিশ সমালোচক মাইকেল চার্চ সম্পাদিত এই সঙ্কলন গ্রন্থে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিল্পকলার নিয়মনীতি দেখান হয়েছে। গ্রন্থে ভারত ও চীনের ওপর আলাদা আলাদা কিছু অধ্যায় আছে। তবে লাতিন আমেরিকা সেখানে উৎপক্ষিত থেকেছে। বিভিন্ন প-িতজনের লেখা প্রতিটি অধ্যায়ের একটি অভিন্ন কাঠামো আছে। সেখানে বাদ্যযন্ত্রের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা, সঙ্গীতের রীতি এবং এর পেছনের সামাজিক সম্পর্কগুলো তুলে ধরা হয়েছে। প্রচুর সুন্দর সুন্দর ছবি এবং সঙ্গীতের স্বরলিপির সমাবেশ আছে সেখানে। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের ওপর যেসব অধ্যায় আছে সেগুলো অনেক পাঠকের কাছে বিশেষ আগ্রহের সঞ্চার করতে পারে। ভারতের সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল জ্যোতিস্ক রবিশঙ্করের সঙ্গীতকর্মের মধ্য দিয়ে তাদের হয়ত এই ধ্রুপদী সঙ্গীত সম্পর্কে আগে থেকেই অস্পষ্ট কিছু ধারণা আছে। গ্রন্থে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে উত্তর (হিন্দুস্থানী) ও দক্ষিণ (কর্নাটকি) ভারতীয় রীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য দেখান হয়েছে। যেমন তবলা বা ঢোলের ব্যবহার হিন্দুস্থানী সঙ্গীতের ক্ষেত্রেই অধিকতর দেখা যায়। এসব বাদ্যযন্দ্রের মাথার দিকটা সাধারণত ছাগলের চামড়ায় নির্মিত। অন্যদিকে কর্নাটকি সঙ্গীতে অলঙ্করণ ও ঝঙ্কারের আধিক্যই বেশি। রবিশঙ্কর মূলত হিন্দুস্থানী সঙ্গীতই পরিবেশন করতেন। সাধারণ পাঠকের জন্য এই তথ্যাবলী যথেষ্ট সহায়ক। তবে যারা এতে লিখেছেন তারা সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ইতিহাসগত সূক্ষ্ম তারতম্যের উপর তীক্ষè দৃষ্টি বুলাতে ভুল করেননি। তাদের অনেকেই ধ্রুপদী শব্দটার উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের যুক্তি হলো লোকে যা এখন সনাতনী বা চিরায়ত কিংবা ধ্রুপদী সঙ্গীত বলে মনে করে তা কালের প্রবাহে সর্বক্ষণ পরিবর্তিত হয়েছে। ধ্রুপদী জাপানী সঙ্গীতের উপর একটি অধ্যায়ে সঙ্গীতের দুই শীর্ষ স্বরলিপির ভারী চমৎকার ছবি আছে। একটি ১৩০৩ সালের। অন্যটি বর্তমান সময়কার। এগুলোর ভিন্ন ভিন্ন রীতি থেকে আভাস মেলে কিভাবে রূপগত পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটেছে। এইইভাবে ধ্রুপদী ইরানী সঙ্গীতেরও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৫০-এর দশকে এই সঙ্গীত ইউরোপীয় সঙ্গীত রীতির দ্বারা পরিবর্তিত হয়। তবে এই পাশ্চাত্য প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে সরকার এতে পারসিক বৈশিষ্ট্য নতুন করে আনমনের উদ্যোগে পৃষ্ঠপোষকতা যোগায়। ভারতে বিংশ শতাব্দীর আগে সে দেশীয় সঙ্গীত বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর পরিবেশিত নানা ধরনের সঙ্গীতের ঐতিহ্যের চাইতে অধিক কিছু ছিল না। কিছু কিছু ইতিহাসবিদের বক্তব্য হলো ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীত আসলে বিংশ শতাব্দীর জাতীয়তাবাদীদের একত্রে মিশেল দেয়া সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারার একটা সংহত রূপের চেয়ে বেশি কিছু নয়। বইটিতে তাজিকিস্তান, উত্তর আফ্রিকা ও জাভার সঙ্গীতের ওপর অধ্যায়ের পাশাপাশি ইউরোপীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের একটি অধ্যায় আছে। অনেক পাঠক হয়ত এই অধ্যায়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে পরিচিত। কিন্ত যারা পেরোটিন কিংবা জন ডানস্টেবল সম্পর্কে তেমন কিছু শোনেননি তাদের কাছে বইটি বেশ কৌতূহলোদ্দীপক মনে হবে। পেরোটিন ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্যারিসের এক স্বণামধন্য সুরকার আর ডানস্টেবল ছিলেন পঞ্চদশ শতকের ইংল্যা-ে পলিকোনিক সঙ্গীতের এক বিখ্যাত সুরস্রষ্টা। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×