ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পান্থ আফজাল

হার না মানা তারুণ্যের গল্প ॥ শীতার্তদের পাশে ঘাসফুল

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

হার না মানা তারুণ্যের গল্প ॥ শীতার্তদের পাশে ঘাসফুল

‘রাত তখন এগারোটা ছুঁইছুঁই। যে অটো করে আমরা আটজন ফিরছিলাম- হুট করেই বন্ধ হয়ে গেল। রাত, সুনসান রাত। কুড়িগ্রাম, চিলমারী থেকে কম্বল বিতরণ শেষ করে ফিরছিলাম। আকাশে ভরা চাঁদ, প্রচণ্ড কুয়াশা চারদিকে। আপাদমস্তক জ্যাকেট, চাদর, মাফলার এসব দিয়ে আবৃত থাকলেও শীত আমাদের হাড় পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছিল। আর গাড়ি পেলাম না। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- পেছনে ফিরে যাব না, যতদূর গাড়ি না পাওয়া যায় হাঁটব। হাঁটছি... কিছুক্ষণ পর মনির জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, কথা বলছেন না কেন?’ বললাম, ‘পায়ের শব্দ শুনছি। জাগরণের শব্দ শুনছি।’- ‘ঘাসফুল’ দলের কাণ্ডারি মাহাদি আলমের এই তারুণ্য উদ্দীপ্ত কথাগুলো দলের অন্যান্য সারথিদের পায়ে চলাকে আরও বেশি বেগবান করেছিল ২৩ ডিসেম্বর কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারীতে এবং ২৪ ডিসেম্বর চিলমারীতে কম্বল ও গরম কাপড় বিতরণ করা শেষে। রাতের নিরবতাকে জাগরণের রূপদানের লক্ষ্যে ‘ঘাসফুল’-এর কর্মীরা কুড়িগ্রামের উদ্দেশে রওনা হয় মানুষের জন্য একটু উষ্ণতার ছোঁয়া দেবে বলে। শীতার্ত মানুষদের জন্য উষ্ণতাকে পুঁজি করে এসব অদম্য তরুণদের বিভিন্ন দুর্যোগময় সময়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে চলার প্রয়াশ যেন সর্বত্র। যে ফুল সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না, কেউ যতœ করে তুলে খোঁপায় কিংবা ফুলদানিতে রাখে না, ঘাসফুল তেমনই এক ফুল। তবে এই লেখার বিষয় সে ঘাসফুল নয়। যে ‘ঘাসফুল’-এর কথা লিখব ভেবে কলম ধরেছি, সে ঘাসফুল এ প্রজন্মের একঝাঁক তরুণের স্বপ্ন-যুদ্ধেরই আরেক নাম। একটি মননশীল জাগরণের অঙ্গীকার। প্রতিবছরের মতো এ বছরও শীতার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে ঘাসফুল। এই মানবতার সংগঠন কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী গ্রামে শিক্ষাবঞ্চিত ছেলে-মেয়েদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘আশার আলো’ সান্ধ্যস্কুলে সকল ছাত্রছাত্রীর মাঝে এবং কুড়িগ্রামের ৪নং রমনা মডেল ইউনিয়নে দরিদ্র ও শীতার্ত মানুষের মাঝে কম্বল বিতরণ করে ঘাসফুল। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে ঘাসফুল-টিম কম্বল নিয়ে রওনা হয় বিভিন্ন দুর্গত এলাকায়। দলের অন্যতম প্রতিভাবান কবি ও নিবেদিত কর্মী রাকিবুল হাসান তাঁর অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করে ফেসবুক পেজে লেখেন- ‘ঘাসফুল’ এর শীতবস্ত্র বিতরণের আয়োজনে টানা কয়েকদিন কাটল রংপুর এবং রংপুরের আশপাশে। রাতভর কবিদের আড্ডা আর দিনভর কম্বল বিতরণ। সব মিলিয়ে দারুণ ছিল দিনগুলো। অবসর সময়ে বাকি রাতজুড়ে কবিতায় চমকে দিয়েছেন কবির কল্লোল, শোয়েব মাহমুদ, শামীম আরেফীন, শাহরিয়ার আলম, ওয়ালিদ হাসান এবং মাহাদি আনাম। আমাদের ক্লান্তিটুকু কখন যে ম্লান হয়ে যেত বুঝতেই পারা যেত না। রংপুর থেকে শীতবস্ত্র নিয়ে নাগেশ্বরে ফেলানীর গ্রামে বিতরণ। সেখান থেকে পিকআপে বসে শীতে কাঁপতে কাঁপতে চিলমারী। পরেরদিন ধরলা নদীর কোলঘেঁষা ওই গ্রামে শীতবস্ত্র বিতরণ শেষ করে বের হতে হতে রাত সাড়ে দশটা বাজিয়ে ফেলা। এরপর যানবাহন জটিলতায় পড়ে টানা ১৫ কিলোমিটার হেঁটে উলিপুর। শীতপূর্ণিমায় অদ্ভুত সেই হাঁটার গল্প সঙ্গে থাকা উদ্যমী কর্মী ও কবিদের আগামী অনেক মানবতার কাজে পাওয়া যাবে বলে আগাম বলে দিলাম না। তবে শহরাঞ্চলে শীতের কনকনে ঠাণ্ডা এখনও অনুভূত না হলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শীত বেশ জাঁকিয়েই শুরু“হয়েছে। আমরা জানি, এখনও অনেক মানুষ শীতে গরম কাপড়ের অভাবে দুর্বিষহ জীবনযাপন করে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক মানুষদের দুর্ভোগ বেশি হয়। ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ‘ঘাসফুল’ -এর আত্মপ্রকাশ ঘটে ছোট্ট একটি সাহিত্যপত্রের মাধ্যমে। ঘাসফুল বলতে তখন কেবল ওই অনাড়ম্বর পত্রিকাটুকুই। নবীন এবং তরুণ কিছু লেখক ছিলেন এর উদ্যোক্তা। উদ্দেশ্য ছিল, সুস্থ শিল্প ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে একটি মননশীল এবং চিন্তাশীল সমাজ বিনির্মাণ। এই উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়েই ‘ঘাসফুল’ পত্রিকাটি চারমাসে পরপর চারবার আলোর মুখ দেখে ফেলে। সম্ভাবনাময়ী উদীয়মান কবি ও লেখকরা পেয়ে যায় বিশ্বস্ত এক প্লাটফর্ম। কিন্তু ততদিনে ঘাসফুলের দৃষ্টিসীমা বিস্তৃত হয় আরও। শিল্প-সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি সামাজিক কার্যক্রমের দিকেও এগিয়ে যায় প্রাণোচ্ছল উদ্যোমী এই তরুণ দল। বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য ফান্ড কালেক্ট করতে নেমে পড়ে রাস্তায়। এরপর চাল-ডাল-ওষুধ ইত্যাদি সাহায্য সামগ্রী বন্যাকবলিত এলাকা গাইবান্ধার ফুলছড়িতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে পৌঁছে দেয়। একইভাবে প্রকট শীতের সময় শীতার্তদের সাহায্যেও ঘাসফুল ছুটে যায় উত্তরবঙ্গে। রংপুর, গাইবান্ধা এবং কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্রদের মাঝে শীতবস্ত্র ও কম্বল বিতরণ করে। ঈদের আনন্দে যখন সারাদেশ মেতে ওঠে, কিছু অসহায় মানুষ তখন নীরবে চোখের জল মোছেন। সেই অসহায় মলিন মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ায় ঘাসফুল। তাদের হাতে তুলে দেয় ঈদের নতুন পোশাক। এছাড়া, রাস্তার পাশে ধুলোয় মলিন সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের শিক্ষার জন্য একটি স্কুলও পরিচালনা করে ঘাসফুল। এভাবেই, দিনদিন বেড়ে যায় স্বপ্নের পরিধি। বেড়ে যায় দেশ এবং মানবতার প্রতি দায়বোধ। এই দায়বোধ বা সচেতনতা থেকেই ঘাসফুলের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে এখনও। গত বছরের সেপ্টেম্বরে, কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলায় বানভাসি এবং নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সফলতার সঙ্গে কাজ করে এসেছে তারা। প্রায় তিন টন চাল বিতরণ করেছে তাদের মাঝে। ঘাসফুলের সামনে আরও অনেক বড় লক্ষ্য। আরও অনেক দূর যাওয়ার স্বপ্ন। স্বপ্নবাজ এই তরুণরাই দেশ এবং মানুষের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাবে। এক পা দুই পা করে ঘাসফুল এখন পরিপূর্ণ রূপেই একটি সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন। সাহিত্য পত্রিকা এবং সংগঠনের সামাজিক কর্যক্রমগুলো আরও বিস্তৃতভাবে পরিচালনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ এ পর্যন্ত দেশের ৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাসফুলের পূর্ণাঙ্গ শাখা কমিটি রয়েছে। এসব শাখা কমিটির তত্ত্বাবধায়নে দিনদিন সামগ্রিক কাজ আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। শিল্পের সব সূক্ষ্ম বিষয় সাজাতে এবং সাহিত্যকে আধুনিকীকরণ ও সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে তাদের ‘ঘাসফুল’ নামে একটি মাসিক সাহিত্যপত্রও আছে। সাহিত্যপত্রটি এপার-ওপার বাংলার নবীন-প্রবীণ লেখক-কবিগণের এক অনন্য মেলবন্ধন। সাহিত্য জগতে বাংলার দেশীয় ঐতিহ্যকে একটি নতুন সুস্থ ধারায় বিকশিত করতে ‘ঘাসফুল’ সাহিত্যপত্র সৃষ্টিশীল নবীন লেখকদের সেরা লেখাগুলো প্রকাশ করতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে। এখানে একদল তরুণ তাদের আকাশছোঁয়া স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে পথ হাঁটছে। সঙ্গে রয়েছে বটবৃক্ষের মতো ছায়াদানকারী সুহৃদ বিজ্ঞজন। ‘সীমাবদ্ধতার অবসানে প্রারম্ভের আহ্বান।’ -এই সেøাগানকে ধারণ করে মাহাদি আনামের নেতৃত্বে কিছু উদ্যমী তরুণ দেশের বিভিন্ন দুর্যোগময় মুহূর্তে হাতে নেয় পথশিশুদের পড়ালেখার ভার, বন্যাদুর্গতদের কিংবা শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ। শুধু ঘাসফুল নয়, সমস্ত ধর্ম-বর্ণের বাঁধ ডিঙিয়ে সবাই এভাবে একদিন অসহায় ও দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। লোকচক্ষুর আড়ালে ঘাসফুলের মতো নীরবে ফুটে থাকা ফুলগুলোকে ভালবেসে কাছে টেনে নেবে। প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে গড়ে তুলবে সুন্দর এক সোনার দেশ। এটাই প্রত্যাশা সবার।
×