ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আ ব ম ফারুক

ওষুধের পেটেন্ট ছাড় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

ওষুধের পেটেন্ট ছাড় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন

(শেষাংশ) এর ফলে বাংলাদেশের গরিব মানুষ যেমন স্বল্পমূল্যে ওষুধ কিনতে পেরেছে, জনস্বাস্থ্য যেমন রক্ষিত হয়েছে, তেমনি ওষুধ শিল্প নামে একটি নতুন শিল্প সেক্টর বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে। যে দেশে স্বাধীনতার আগে প্রকৃতপক্ষে তেমন কোন শিল্পই ছিল না, সে দেশে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক এসব পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশে অনেক দেশীয় ওষুধ কোম্পানি গড়ে ওঠে এবং ওষুধের বাজার সৃষ্টি হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ওষুধের পেটেন্ট আইন না মানার সিদ্ধান্তটি ছিল এদেশের জন্য সঠিক এবং এটি বাংলাদেশের আজকের গৌরবময় ওষুধ শিল্পের ভিত রচনা করেছে। বাংলাদেশে গরিব মানুষের জন্য পেটেন্ট আইন না মানার যে পথ তিনি সদ্য স্বাধীন দেশটির নানাবিধ সমস্যা-সঙ্কুল, এমনকি প্রতিকূল অবস্থাতেও দেখিয়ে গেছেন আজ আমরা কেন সে পথে এগিয়ে যেতে পারব না? আমাদের অনেক ভাল ওষুধ কোম্পানি আছে যারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ‘গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্রাকটিস’ অনুসরণ করে উন্নত কারখানায় আন্তর্জাতিক মানের ওষুধ তৈরি করছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখবর যে, তারা দেশের অভ্যন্তরীণ ওষুধের বাজারকে প্রায় স্বনির্ভর করতে পেরেছে এবং যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপের ইইউ, উপসাগরীয় দেশগুলোর জিসিসি, অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ, ব্রাজিলের আনভিসা এবং গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ সনদসহ অনেক সনদ পেয়েছে এবং বর্তমানে ১০৪ দেশে ওষুধ রফতানি করছে। এছাড়া আরও আশা করছি যে, এসব কোম্পানির অনেকেই এ বছর না হলেও আগামী বছর থেকে চীন ও ভারতের মতো ‘কন্ট্রাক্ট ম্যানুফ্যাকচারিং’ করবে অর্থাৎ উন্নত বিশ্বের ওষুধ কোম্পানিকে এখান থেকে ওষুধ তৈরি করে দেবে। ফলে আমাদের যেমন আয় বাড়বে, তেমনি স্বল্পোন্নত দেশগুলোর এবং অনেক উন্নত দেশেরও তুলনামূলক গরিব মানুষরা সস্তায় ওষুধ পাবে। কিন্তু আমাদের ওষুধ সেক্টরের এসব অর্জন সবই বৃথা হয়ে যাবে যদি ২০১৫ সালের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপসের অধীন ওষুধের পেটেন্ট আইন আমাদের ওপর চেপে বসে। কারণ তাহলে ওষুধের দাম দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ বেড়ে যাবে, দরিদ্র মানুষরা ওষুধ কিনতে গিয়ে মহাদুর্ভোগে পড়বে, আমাদের সরকারী প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সরকারের পক্ষে হাসপাতালগুলো পরিচালনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে, উপরিউক্ত বিবিধ কারণে অনেক মানুষ বিনা চিকিৎসায় বা সঠিক ওষুধের অভাবে মারা যাবে- এক কথায় আমাদের জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশ্বের বিজ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষরা যদি বিগত দশকে পৃথিবীজুড়ে প্রতিবাদ না করতেন তাহলে ২০০০ সালের ‘দোহা ঘোষণা’ আসত না। এই ‘দোহা ঘোষণা ২০০০’ না এলে ২০০৫ সাল থেকে আমাদের ওপর ট্রিপসের পেটেন্ট আইনের খ—গ নেমে আসত, আমাদের দেশে উপরিউক্ত সব সমস্যা দেখা যেত, আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ত এবং অসংখ্য লোক মারা যেত। পঞ্চাশটি স্বল্পোন্নত দেশে হিসাব করলে হয় তো ওষুধের অভাবে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা হতো কোটি কোটি। এ পরিপ্রেক্ষিত ও আশঙ্কাকে উপলব্ধি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের অনেক আগেই ২০১০ সালের জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ট্রিপস চুক্তির পেটেন্ট ছাড়ের সময়সীমা ২০১৫ থেকে বাড়িয়ে দেয়ার দাবি করেছিলেন। এটি ছিল একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। বঙ্গবন্ধু পেটেন্ট অস্বীকার করেছিলেন ১৯৭২ সালে, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ট্রিপসের ছাড়ের সময়সীমা ২০১৫ সাল থেকে বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তারই ধারাবাহিকতায়। এরপর ২০১৩ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের উদ্যোগে বিশ^বিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন বিশ^ বাণিজ্য সংস্থার মহাপরিচালক প্যাসকেল লামি। সেখানেও উপাচার্য আনুষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের গরিব মানুষগুলোর জীবন বাঁচানোর স্বার্থে ওষুধের ক্ষেত্রে পেটেন্ট ছাড়ের সীমা ২০১৫ থেকে বাড়ানোর জন্য জোরালো দাবি তোলেন। দেশের ফার্মাসিস্টদের পক্ষে বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি থেকে আমরা এই দাবিতে মহাপরিচালককে স্মারকলিপিও প্রদান করেছিলাম। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকার যে শক্ত ভূমিকা নিয়েছে তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে উত্থাপিত দাবির ক্রমধারায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বিশ^ বাণিজ্য সংস্থার নির্বাহী সভাগুলোতে একনাগাড়ে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তার এই প্রচেষ্টা এতটাই আন্তরিক ও জোরালো ছিল যে তিনি একসময় এই দাবিটিকে শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং সব স্বল্পোন্নত দেশের সাধারণ দাবিতে রূপান্তর ঘটাতে পেরেছিলেন। স্বল্পোন্নত দেশগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রীকে ট্রিপস ইস্যুতে তাদের সবার মুখপাত্রে পরিণত করে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে তিনি একে দাবি থেকে একটি মানবিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পক্ষে বাংলাদেশের এই নেতৃত্ব গ্রহণ ছিল একটি যুগান্তকারী অগ্রগতি। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের প্রসারে বিমুগ্ধ স্বল্পোন্নত দেশগুলো মতপ্রকাশ করে যে, পেটেন্ট ছাড় পেলে তারা তাদের দেশে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে স্বল্প দামে উন্নতমানের ওষুধ কিনতে পারবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি। তাদেরসহ অনেকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ২০৩২ সাল পর্যন্ত ট্রিপসের আওতায় ওষুধের ক্ষেত্রে পেটেন্ট ছাড় পেয়েছে। গত মাসের নাইরোবি সম্মেলনে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই বিরাট অর্জনের সুফল এখনই বুঝতে পারা যাবে না। কিন্তু এই অর্জন সব অর্থেই ঐতিহাসিক। এর ফলে আমাদের দেশের বাজারে ওষুধের দাম দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকল না, দরিদ্র মানুষরা ওষুধ কিনতে গিয়ে দুর্ভোগে পড়বে না, আমাদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য নেটওয়ার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, প্রধানমন্ত্রী স্থাপিত ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আরও ভালভাবে গ্রামের গরিব মানুষগুলোকে সেবা দিতে পারবে, এগুলো থেকে বিনামূল্যে দেয়া ওষুধের সংখ্যা ৩০ থেকে আরও বাড়ানো যাবে, উপজেলা থেকে শুরু করে জেলা ও কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সরকারী হাসপাতালগুলো পরিচালনা সহজ ও আরও সম্প্রসারিত হতে পারবে, গরিব মানুষ বিনা চিকিৎসায় বা সঠিক ওষুধ কিনতে না পারার কারণে মারা যাবে না, আমাদের জনস্বাস্থ্য একটি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেল এবং দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষই দারুণভাবে উপকৃত হলো। ২০৩২ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা পাওয়াতে আমাদের ওষুধ শিল্প নতুন এক প্রাণ পেল। এখন তারা নব উদ্যমে নিজেদের আরও উন্নত করার জন্য কাজ করতে পারবে। লেখক : অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ এবং সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×