ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(১৮ জানুয়ারির পর) রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলার পর শফিউল্লাহ নিশ্চিত হতে চাইলেন শাফায়াত সম্পর্কে। শাফায়াত কি সৈন্য পাঠিয়েছে? তার টেলিফোন ব্যস্ত। অপারেটরকে বললেন, তিনি অন্য লাইনে কথা বলতে থাকলে তা কেটে যেন তার লাইন দেয়া হয়। কিন্তু তার টেলিফোন এনগেজড। শফিউল্লাহর মনে হলো, হয় সেটের টেলিফোন ঠিক করে রাখা হয়নি অথবা বিদ্রোহী সৈন্যরা তাকে নিশ্চল করে ফেলেছে। ‘কিন্তু পরে দেখা গেল, আমার দুটি ধারণাই ভুল।’ লিখেছেন শফিউল্লাহ, “তার পরবর্তী কার্যকলাপে প্রমাণ করেছে তিনি ঠিক পথে চলেননি। তিনি সৈন্য চলাচলের নির্দেশ না দিয়ে চুপ করে ছিলেন। তিনি আমার নির্দেশ শোনেননি।” [... his subsequent actions made me think that he was not in the right track. He instead of mobili“ing his troops remained inactive. He therefore disobeyed my orders as he did not order his troops to move.] পরে শফিউল্লাহ জেনেছেন, বঙ্গবন্ধু সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক, কর্নেল জামিল এবং আরও কয়েকজনকে ফোন করেছিলেন। শফিউল্লাহ আফসোস করে লিখেছেন, তার সঙ্গে খানিকটা আগে যোগাযোগ করলে হয়ত তিনি খানিকটা সময় পেতেন কিছু করার। কারণ তিনি যখন খবর পেয়েছেন তখন হত্যাকারীরা ৩২ নম্বরের পথে। সৈন্য দেখেই বঙ্গবন্ধু তার ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন। কিন্তু তার ফোন পাওয়ার পর হয়ত তিনি বুঝেছিলেন শফিউল্লাহ এর সঙ্গে জড়িত নয়। লিখেছেন তিনি, “আগে পরে আমাদের সবাইকে মরতে হবে। আমার এইটেই সান্ত¡না যে, বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর আগে অন্তত এটুকু জেনে গেলেন যে, শফিউল্লাহ তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। [“I feel aggrieved that I could not protect my President.”] ॥ ছয় ॥ মেজর ডালিম রেডিওতে তার ঘোষণা দিচ্ছেন। শফিউল্লাহর ব্যাটম্যান একটি রেডিও এনে দিলে তিনি তা শুনলেন। তখন সোয়া ছয়টা বা ছয়টা কুড়ি। সে সময় জিয়াউর রহমান এলেন পরিপাটি হয়ে ইউনিফর্ম পরে। তার সরকারী গাড়িতে। জিয়ার সঙ্গে যখন তিনি কথা বলছেন তখন খালেদ তার নিজের গাড়ি চালিয়ে এলেন। তার পরনে রাতের পোশাক, শেভও করেননি। তিনি তাদের জানালেন শাফায়াতকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেনা চলাচলের কিন্তু তিনি তা করেননি। শফিউল্লাহ ঠিক করলেন অফিসে যাবেন। খালেদকে বললেন ইউনিফর্ম পরে ৪৬ ব্রিগেডে গিয়ে শাফায়াতকে সক্রিয় করতে যাতে তিনি বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করেন। অফিসে যাওয়ার মুহূর্তে দেখলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ আসছেন। পরনে লুঙ্গি, গেঞ্জি। দেয়াল টপকে এসেছেন। করিডর দিয়ে বেরুবার পথে রউফ তাকে বললেন, জিয়াকে যেন শফিউল্লাহ সঙ্গে না নেন। শফিউল্লাহ ঠিক বুঝতে পারছিলেন না রউফ কেন এ কথা বলছেন। জিয়া বৈঠকখানায় বসে আছেন তার অপেক্ষায়। তিনি রউফকে বললেন, কাপড় বদলে যেন আসেন। রউফ তখন শফিউল্লাহর স্ত্রীকে বললেন, যেন তিনি শফিউল্লাহকে জিয়ার সঙ্গে না যেতে দেন। শফিউল্লাহ অফিসে রওনা হলেন। পেছনে জিয়া। ‘জিয়া আমার উপ-প্রধান’, লিখেছেন শফিউল্লাহ, “সেদিন তিনি আমাকে অতিসৌজন্য দেখাচ্ছিলেন, প্রতিমুহূর্তে আমাকে স্যার বলে সম্বোধন করছিলেন। জিয়া সরকারী কাজের সময় আমাকে স্যার বলতেন অন্য সময় নাম ধরেই ডাকতেন।” যা হোক, অফিসে পৌঁছে আমার এডিসি হুমায়ূন কবিরকে বললাম শেষ মুহূর্তের পরিস্থিতি জানাতে। একই সঙ্গে অপেক্ষা করছিলাম খালেদের ফোনের। কারণ ৪৬ ব্রিগেডের কথা আমাকে জানানোর কথা। উদ্বিগ্নবোধ করছিলাম।” কর্নেল শাফায়াত জামিল তখনও শফিউল্লাহকে কিছু জানাননি। সকালে শফিউল্লাহ যখন খালেদকে পাঠাচ্ছিলেন তখন জিয়া তাকে বার বার মানা করছিলেন। খালেদ চলে যাওয়ার পর মৃদু স্বরে বলেছিলেন, সে ঝামেলা বাধাবে। খালেদকে ৪৬ ব্রিগেডে পাঠানো উচিত হয়নি। অফিসে এসে শফিউল্লাহ ফরমেশন কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের পরিস্থিতি জানাচ্ছিলেন। এই সময় জিয়া শান্তভাবে তার সামনে বসেছিলেন। শফিউল্লাহ যখন ফরমেশন কমান্ডারদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তখন জিয়া হঠাৎ বললেন, খালেদকে দ্রুত ডেকে পাঠানো উচিত। খালেদের ফিরে এসে দ্রুত একটি অপারেশন অর্ডার তৈরি করা উচিত, যদি ভারত আক্রমণ করে তাহলে সৈন্যরা তা প্রতিহত করার জন্য যেন প্রস্তুত থাকতে পারে। এমন সময় খালেদ ফোন করলেন। শফিউল্লাহ জানতে চাইলেন তার নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে শাফায়াত কী করেছেন। খালেদ তার উত্তর না দিয়ে জানালেন, তার দ্রুত ৪৬ ব্রিগেডে আসা উচিত। তিনি আবারও তার প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলেন তখন খালেদ জানালেন, তারা তাকে এ বিষয়ে টেলিফোনে কথা বলতে দিতে চাচ্ছে না। শফিউল্লাহ জানতে চাইলেন, কে তাকে বাধা দিচ্ছে? খালেদ জানালেন, তারা তাকে আর কিছু বলতে দিচ্ছে না। শফিউল্লাহ তাকে জানালেন, তিনি জানেন না কীভাবে তবে খালেদকে যেভাবেই হোক অফিসে এসে তাকে সব জানাতে হবে। খালেদ জানালেন, তারা কিছুক্ষণের জন্য তাকে তার অফিসে আসতে দেবে। খালেদ আসার আগেই এডিসি হুমায়ুন কবির এসে তাকে জানালেন যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। শফিউল্লাহ লিখেছেন, “আমি তখনও ভাবতে পারিনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হবে। এ খবর আমার জন্য ছিল কষ্টদায়ক। খবরটি বেদনাদায়ক। আমাকে করে তুলল আবেগী। আমি বসেছিলাম বিষণœ মুখে। তখন খালেদ ঢুকল অফিসে। খালেদকে ক্লান্ত এবং চিন্তান্বিত দেখাচ্ছিল। খালেদকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, শাফায়াত কি সৈন্য মুভ করেছে? খালেদ বলল, না স্যার, পুরো ট্রুপস আপনার নির্দেশে বিদ্রোহ করেছে।” শফিউল্লাহ লিখেছেন, তিনি বুঝতে পারছিলেন না কে এই নির্দেশ দিয়েছে বা গুজব ছড়াচ্ছে। খালেদ আরও জানালেন, পুরো গ্যারিসনের ধারণা সেনাবাহিনী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। সুতরাং এর বিরুদ্ধে সৈন্য মুভ করা সম্ভব নয়। জিয়া তখনও শফিউল্লাহর রুমে বসেছিলেন। খালেদের রিপোর্টিং শেষ হওয়া মাত্র তিনি বললেন, খালেদের এখন আর কোথাও যাওয়া ঠিক হবে না। তার এখনই বসে ভারতীয়দের বিরুদ্ধে একটি ‘অপস অর্ডার’ তৈরি করা উচিত। ফরমেশন কমান্ডারদের সতর্ক করে দেয়া উচিত, যাতে অল্প সময়ে সৈন্য চলাচল করা যায়। শফিউল্লাহ বললেন, এই ধারণা হয়ত ঠিক হতে পারে কিন্তু এখনই উপসংহারে পৌঁছা ঠিক হবে না। “আমাদের এখন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা উচিত যাতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেয়া যায়। ওই সময় আমাদের সামনে সিরিয়াস পরিস্থিতি। আমাদের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া উচিত সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। তবে খালেদ একটি ‘অপস অর্ডার’ রেডি করতে পারে। এর জন্য যেন সে আমার পরামর্শ নেয়।” চলবে...
×