ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আ ব ম ফারুক

ওষুধের পেটেন্ট ছাড় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

ওষুধের পেটেন্ট ছাড় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন

সুখবরটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অনেক মানুষই জেনে গেছেন। ওষুধের পেটেন্ট আইন না মানার যে ছাড় বাংলাদেশ ইতোপূর্বে ২০১৫ পর্যন্ত পেয়েছিল, সব উদ্বেগের অবসান ঘটিয়ে সরকার তা ২০৩২ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করে আনতে সক্ষম হয়েছে। এই সুখবরটি আনার জন্য সরকারকে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিনন্দন। কারণ তিনি ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম এই দাবিটি উত্থাপন করেছিলেন। জাতিসংঘে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এই দাবিটি করার পেছনে একটু ইতিহাস আছে। এর আগে ১৫-১৭ সেপ্টেম্বর ২০১০ জেনেভাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় ‘ট্রেড রিলেটেড এসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস’ সংক্ষেপে ‘ট্রিপস’ বা মেধাস্বত্ব আইনের ভবিষ্যত বিষয়ে নীতি নির্ধারণী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এই বিশেষ অধিবেশনটিতে ২০১৫ সালের পরে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ট্রিপসের আওতায় আনা যাবে কি না, আনা গেলে কিভাবে আনতে হবে, মেধাস্বত্ব¡ নিয়ে কতটুকু কড়াকড়ি করা যাবেÑ এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে একজন অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক আবুল বারকাত, সেখানে যোগ দিয়ে আমাদের যৌক্তিক দাবিটিকে তুলে ধরেছিলেন। বিশ্ব অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে মেধাস্বত্ব আইন নিয়ে গরিব দেশগুলো ক্রমাগত প্রতিবাদ করতে থাকলেও উন্নত বিশ্ব শক্ত অবস্থান নিয়েছে বিগত দশক থেকেই। আমরা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ওষুধের পেটেন্ট আইন থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। গত ২০০৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সেমিনার ঢাকাতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে ট্রিপস ও বাংলাদেশের ওষুধে এর প্রভাব বিষয়ে কান্ট্রি পেপার উপস্থাপনের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক অফিস আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সেই ফোরামে গরিব দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ও অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে সব সময়ের জন্য ট্রিপসের আওতার বাইরে রাখতে বাংলাদেশের জনগণ ও ওষুধবিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে আমি কান্ট্রি পেপারের মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছিলাম। পরবর্তীকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই আবেদন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। ট্রিপস বা মেধাস্বত্ব আইনের বিষয়টি বিভিন্ন কারণে শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, বরং স্বল্পোন্নত পঞ্চাশ দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওষুধ বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির বর্তমান পর্যায়ে উন্নত বিশ্ব যৌন সমস্যা, টাক ও স্থূলতার মতো কম গুরুত্বপূর্ণ অসুখগুলোর ওষুধ আবিষ্কারের গবেষণায় বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে ব্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো অসংখ্য সংক্রামক রোগসহ ম্যালেরিয়া, ওষুধ-প্রতিরোধী যক্ষ্মা ও এইডসের মতো মারাত্মক প্রাণঘাতী অসুখের হাত থেকে নিজেদের জনস্বাস্থ্য রক্ষায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। গরিব দেশের এসব রোগের নিরাময়ী ওষুধ আবিষ্কারে উন্নত বিশ্বের ওষুধ কোম্পানিগুলো তেমন আগ্রহী নয়। কারণ এসব অসুখ ‘তৃতীয় বিশ্ব’ বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতেই প্রধানত হয় এবং দারিদ্র্যের কারণে বিশ্বের মোট বার্ষিক ওষুধ বাজারের মাত্র ৯% এসব দেশে অবস্থিত। তাই মুনাফার পরিমাণও অনেক কম। কিছু বিদেশী ওষুধ কোম্পানি স্বল্পোন্নত দেশের এসব ছোট বাজারও হাতছাড়া করতে চায় না। তারা তাই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব আইনের অধীনে নতুন আবিষ্কৃত বিভিন্ন ওষুধের পেটেন্ট নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশের বাজারে আসে। সেসব ওষুধের দামও হয় অনেক, গরিব মানুষের আওতার বাইরে। নতুন ওষুধ আবিষ্কারে পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় অবশ্যই। আমরা অবশ্যই চাই যথেষ্ট মুনাফাসহ এই পুঁজি ওষুধটির আবিষ্কারক বিনিয়োগকারী কোম্পানির কাছে ফেরত আসুক। কিন্তু পেটেন্ট আইনের সুযোগ নিয়ে আবিষ্কারক কোম্পানিগুলো ওষুধের আকাশচুম্বী দাম নির্ধারণ করে। ফলে গরিব দেশের গরিব মানুষরা অসুস্থ হলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওষুধ কিনতে পারে না। অনেকে বাধ্য হয়ে দৈনন্দিন খাদ্য কমিয়ে বা খাদ্যের পুষ্টি মূল্যকে বিসর্জন দিয়ে সেই টাকায় বেশি দাম দিয়ে ওষুধ কেনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা উচ্চমূল্যের কারণে ওষুধের প্রয়োজনীয় কোর্সও পুরো করতে পারে না। এসব পেটেন্ট আগে দেয়া হতো সাত বছরের জন্য, পরে কোন কোন দেশ তা বাড়িয়ে বারো বছর করেছিল। এখন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস আইনে তা আরও বাড়িয়ে বিশ বছর করা হয়েছে। অর্থাৎ আবিষ্কারক কোম্পানি সুদীর্ঘ বিশ বছর ধরে নিজের ইচ্ছামতো দামে ওষুধটির একচেটিয়া ব্যবসা করে যাবে। ট্রিপস আইনটি তাই গরিব দেশের জন্য, এমনকি উন্নত দেশের গরিব মানুষদের জন্যও অমানবিক। সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি তার পেটেন্ট করা এন্টিবায়োটিক সেফট্রিয়াক্সোন ইনজেকশন বাংলাদেশে একসময় বিক্রি করত প্রতিটি বারো শ’ টাকা দামে। পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর একই ইনজেকশন এখন এদেশের আন্তর্জাতিক মানের দেশী কোম্পানিগুলো বিক্রি করছে এক শ’ টাকায়। শুধু পেটেন্টের কারণে আগে আমাদের কোন দেশী কোম্পানি এই ওষুধটি উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারত না। আবিষ্কারক কোম্পানির পেটেন্টের নামে এমন অমানবিকতার উদাহরণ অজস্র। আবিষ্কারক কোম্পানি যদি শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ ইনজেকশনটিকে দুই শ’ টাকা দামে বিক্রি করত তাহলে আমাদের কোন আপত্তি থাকত না, এই ভেবে যে ওষুধটির আবিষ্কারের পেছনে কোম্পানির অনেক খরচ হয়েছে, এ জন্য সে এক শ’ টাকার মুনাফা করতেই পারে। কিন্তু খরচের অসিলায় পেটেন্টের নাম করে যে অবিশ্বাস্য ও অমানবিক মুনাফা করা হয় তাতে যে কোন বিবেকবান মানুষই আপত্তি করবেন। পেটেন্ট করে যদি সহনীয় পর্যায়ে মুনাফা করা হতো তাহলে এই বিবেকবান মানুষরাই তা সমর্থন করতেন। পেটেন্টের মাধ্যমে ওষুধ বিক্রির একচেটিয়া অধিকার পেয়ে যাওয়াতে আবিষ্কারক কোম্পানিগুলো কোন নিয়মনীতি ও মানবিকতার তোয়াক্কা না করে একচেটিয়াভাবেই অতি উচ্চমূল্য ঠিক করে। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষগুলো অতি প্রয়োজনীয়, এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধগুলোও কিনতে পারে না। বাধ্য হয়ে তাদের কিনতে হয় কম দামের পুরনো ওষুধগুলো, এন্টিবায়োটিক হলে হয় তো সেটি ইতোমধ্যে হয়ে পড়েছে জীবাণুর দ্বারা প্রতিরোধী। এসব এন্টিবায়োটিকে রোগ সারবে না, বরং সমস্যা জটিলতর হবে। সারাবিশ্বেই তাই গরিব মানুষরা অধিকাংশই মারা যাচ্ছে কোন দুরারোগ্য অসুখে নয়, বরং আরোগ্যযোগ্য অসুখে। তারা যেসব অসুখে মারা যাচ্ছে সেগুলোর ওষুধ আছে, তবে দাম বেশি বলে তারা সেগুলো কিনতে পারে না। তারা বেঁচে যেত যদি আবিষ্কারক ওষুধের কোম্পানিগুলো তাদের আবিস্কার করা ওষুধকে পেটেন্ট করে আকাশচুম্বী দাম না রাখত। এ কারণেই বিগত দশকে মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়ন শুরুর পর বিশ্বের দেশে দেশে বিজ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষরা প্রতিবাদ করতে শুরু করেন। বিগত দশকে উন্নত বিশ্বের যে শহরেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সভা বসেছে, সেখানেই সচেতন বিজ্ঞানী ও বিবেকবান মানুষরা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। তাদের সংগঠিত এই প্রবল প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ২০০০ সালে ‘দোহা ঘোষণা’র মাধ্যমে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে মেধাস্বত্ব আইন বাস্তবায়নের কড়াকড়ির ক্ষেত্রে কিছু ছাড় দেয়। এতে বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অতি প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোর পেটেন্ট ২০১৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর হবে না। এর ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলো তাদের দেশে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধগুলোর দাম কম রাখতে সক্ষম হয় এবং এর ফলে বিশ্বের শত কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পায়। মেধাস্বত্ব আইন আসলে বিজ্ঞানকে অমানবিকভাবে বাণিজ্যিকীকরণের কৌশল, উন্নত বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির মুনাফা লোটার হাতিয়ার এবং পরোক্ষভাবে নব্য-ঔপনিবেশিক শোষণের নামান্তর। এর ফলে উন্নত বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির বিপুল মুনাফা অর্জনের পথ সহজ হলেও উন্নয়নশীল কিংবা স্বল্পোন্নত দেশ কারও কোন লাভ হয়নি, এমনকি উন্নত বিশ্বের গরিব মানুষরাও এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা তাই সারাবিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অর্থাৎ নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বার্থে মেধাস্বত্ব আইন, বিশেষ করে পেটেন্ট আইন ইতিবাচকভাবে পর্যালোচনার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে আহ্বান জানিয়েছিলাম। এর ফলে উন্নত বিশ্বের বৃহৎ পুঁজির মুনাফা মারাত্মক হ্রাস পাওয়ারও কোন সম্ভাবনা নেই, কারণ আগেই বলেছি, বাংলাদেশসহ ৫০টি স্বল্পোন্নত দেশে যে পরিমাণ ওষুধ বিক্রি হয় তা বিশ্বের মোট বার্ষিক ওষুধ বাজারের মাত্র ৯%। বৃহৎ পুঁজি যদি এখান থেকে সামান্য মুনাফাটুকু না করে তাহলে ওষুধের দাম কম থাকার কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর কোটি কোটি মানুষ প্রতি বছর বেঁচে যেতে পারে। একটি যৌক্তিক পৃথিবী গড়ার স্বার্থে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কর্তৃক আমাদের এ দাবি মেনে নেয়া উচিত। আমরা এই দাবি করাটি শিখেছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে। তিনি ১৯৭২ সালে পেটেন্ট আইন না মেনে মেট্রোনিডাজোল, প্রমেথাজিন, পেনিসিলিন জি, পেনিসিলিন ভি, টেট্রাসাইক্লিন ইত্যাদি অসংখ্য ওষুধ বাংলাদেশের সব ওষুধ কোম্পানির জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, পেটেন্টের মাধ্যমে গুটিকয় কোম্পানির স্বার্থরক্ষার চাইতে দেশের জনস্বাস্থ্য রক্ষা অনেক জরুরী। এ জন্য তখনকার সরকারের বিরুদ্ধে কোন কোন বিদেশী ওষুধ কোম্পানি মামলার হুমকিও দিয়েছিল। কিন্তু তিনি সেসবের পরোয়া করেননি। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানি ও জনগণ এ জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে ঋণী। তখন বঙ্গবন্ধু পেটেন্ট আইন মানলে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো আজ অনেক ওষুধ তৈরি করতে পারত না, আমাদের হয় বেশি দাম দিয়ে বিদেশী কোম্পানির পেটেন্ট করা ওষুধ খেতে হতো কিংবা বিদেশ থেকে প্রায় সব ওষুধই আমদানি করতে হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ওষুধের পেটেন্ট না মেনে অতি প্রয়োজনীয় ওষুধের সবই দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলোকে উৎপাদনের লাইসেন্স দিতে তখনকার ওষুধ প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তা তদারকও করেছিলেন। ফলে ওষুধের দেশীয় উৎপাদন বাড়ে এবং বিদেশ থেকে ওষুধ আমদানিও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়। (বাকি অংশ আগামীকাল) লেখক : অধ্যাপক, ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ এবং সাবেক ডিন, ফার্মেসি অনুষদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধনসভধৎড়য়ঁব@ুধযড়ড়.পড়স
×