ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে

রাজনীতি তিনি ছেড়ে দিয়েছেন, তা নয়। তবে দলীয় পরিচয়ে আর রাজনীতি না করার অঙ্গীকার করেছেন। যদিও তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত একটি দলের সভাপতি। বোধ হয় তাই দলকে এখনই বিলুপ্ত করেননি। দলহীন রাজনীতিক হিসেবে তিনি নিজেকে এখন প্রতিষ্ঠিত করতে চান। হতাশার চোরাবালিতে আচ্ছন্ন হয়ে তিনি এমন কথা বলতেই পারেন। কারণ গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে নিজের অবস্থানকে শক্তপোক্ত করতে না পারলেও নানা সময়ে তিনি বিতর্কিত যেসব বক্তব্য রেখেছেন, শাণিত আক্রমণাত্মক বাক্য ছুড়েছেন, তাতেও অর্জন কিছু হয়নি। ২২ বছর আগে দল গঠনের প্রক্রিয়া যখন শুরু করেন, তখন তাতে ভিড় কম হয়নি। হারিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া, শতধা-বিভক্ত দলের নেতাকর্মীদের তিনি জড়ো করতে পেরেছিলেন। বাম, ডান, মধ্যপন্থী কট্টরপন্থীরা তার পেছনে এসে ভিড় জমিয়েছিল। সমাজকে বদলে দেয়ার, দেশকে উচ্চাসনে নিয়ে যাওয়ার নানা অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে দল ভারি হওয়া দূরে থাক, নেতা-কর্মীশূন্যতায় পূর্ণ হয়ে উঠেছে। দল থেকে একে একে সবাই সরে গেছেন। রাজনীতির কোথাও তার অস্তিত্ব আজ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্বাচন নিয়ে তিনি অনেক কথাই বলেন, কিন্তু নির্বাচনে তার দল থেকে কেউ নির্বাচিত হতে পারেনি। এমনকি সব আসনে প্রার্থী দেয়ার মতো অবস্থাও শুরুতে তৈরি হয়নি। মানুষ তাকে উচ্চাসনে ঠাঁই দিতে চাইলেও নিজেকে সে অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেননি। সাধারণ জনগণ, এমনকি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ধারে-কাছেও তিনি পৌঁছাতে পারেননি কখনও। জনবিচ্ছিন্ন নেতা হিসেবে তিনি কথিত সুশীল সমাজের সমর্থন পেলেও কার্যকর কোন কিছুই গড়ে তুলতে পারেননি। কথার চমক ছাড়া সারবস্তু কোন কিছুই মেলে না তার ভাষ্যে। ‘ইউটোপিয়ান’ কথাবার্তার আড়ালে তিনি কী চান, তা বুঝতে হয় তো তার অনুসারীরা না পারলেও জনগণ ঠিকই বুঝে নেয় যে, তিনি জনগণের নেতা নন। জনগণের ভাষা বুঝতে না পারা এবং জননেতায় পরিণত হতে না পারার কারণেই তিনি অবলীলায় বলতে পেরেছেন, ‘আমি আমার আদর্শ থেকে সরব না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত যা বিশ্বাস করি, তা বলে যাব। কে রাগ করল আর কে রাগ করল না, তাতে কিছু যায় আসে না।’ এই বক্তব্যই পরিষ্কার করে তিনি আত্মচিন্তা, আত্মস্বার্থ, আত্মগরিমার বাইরে গিয়ে জনগণের স্বার্থকে গুরুত্ব দেন না। অবশ্য তার সমগ্র জীবনধারায় জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার কোন প্রতিফলন দেখা যায় না। প্রশ্ন জাগে, কী তার আদর্শ? কোন্্ আদর্শকে তিনি লালন করেন? সমাজ বাস্তবতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তিনি যে আদর্শের কথা বলেন, মনে হবে, তিনি আইনের শাসন, গণতন্ত্র, জনস্বার্থ রক্ষা করতে চান। কিন্তু এসব ধূলিসাত হয়ে যায়, যখন তিনি ওয়ান-ইলেভেনের পর অনির্বাচিত ‘তিন উদ্দিন’-এর সরকারকে অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় রাখার জন্য সচেষ্ট শুধু নয়, প্রাণপণ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ড. কামাল হোসেন স্বাধীনতা-পূর্বকালে তথা ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেও বিরোধের জের ধরে ১৯৯২ সালে গণতান্ত্রিক ফোরাম গঠন করেন। পরে নামকরণ করা হয় গণফোরাম। কিন্তু এই দল দেশ ও রাজনীতিতে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তিনি রাজনীতি নিয়ে প্রায় সময়ই সরব থেকেছেন। থেকেছেন আলোচনায়। বঙ্গবন্ধুর আলোয় আলোকিত কিংবা বটবৃক্ষের মতো বঙ্গবন্ধুর ছায়ায় বেড়ে ওঠা কামাল হোসেন নিজস্ব আলোয় আলোকিত হতে পেরেছেন, তা বলা যাবে না। যদিও হতেন, তবে মহীরুহ হিসেবে এদেশের রাজনীতিতে তিনি নিজস্ব অবস্থানকে সমুন্নত রাখতে পারতেন। যে আওয়ামী লীগ তাকে রাজনীতিতে তুলে এনেছে, আজকে সেই দল এবং সরকারের বিরোধিতা, এমনকি শেখ হাসিনার কট্টরবিরোধী হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার কাজটি করে আসছেন সচেতনভাবেই। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর ড. কামালের উচিত ছিল দলীয় রাজনীতি থেকে সরে যাওয়া শুধু নয়, রাজনীতির অঙ্গন পরিত্যাগ করাই ছিল শ্রেয়। ১৯৭০ ও ৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হওয়া ছাড়া তার ললাটে আর কখনও বিজয়টিকা জোটেনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনও করেছিলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়নে। নির্বাচনী প্রচারণাকালে বিএনপি সরকারের হুমকির মুখে তিনি দেশ ছেড়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য দেশের যে কোন সঙ্কট, ক্রান্তিকালে তিনি বিদেশে অবস্থান করেন। বলা যায়, গত তিন দশকের বেশি সময় ধরে তিনি মাঝে মধ্যে দেশে আসেন। তারপর কোন একটি ইস্যু নিয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা বলেন। তবে তাতে কাজের কাজ কিছুই হয় না। বিভিন্ন সময় কত আন্দোলন, সংগ্রামের ঘোষণা দিয়েছেন, কিন্তু ঘোষণা দিয়েই তিনি দেশ ত্যাগ করেন। ফলে সেসব কর্মসূচী ধোঁয়াশায় পরিণত হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু সরকারে ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী হিসেবে তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য তিনিসহ পুরো কমিটি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। আর এই একটি কাজ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসে তার অবদান খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৯৭৩ থেকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার সাফল্যের ঝুড়িতে শুধু পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায় ছাড়া আর কিছুই নেই। যদিও তার সবটাই বঙ্গবন্ধু নিজে সক্রিয় থেকে করেছেন। তবে ড. কামাল সিমলায় তিন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে পাকিস্তানী কূটচালের কাছে হেরে গেছেন বলা যায়। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচার ছাড়াই ছেড়ে দেয়া হয়। অবশ্য এটুকু শর্ত আদায় করতে পেরেছিলেন যে, পাকিস্তান সরকার তাদের বিচার করবে। পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের প্রাপ্ত ন্যায্য হিস্যাটুকুও আদায় করতে পারেননি। ’৭৫-এর আগস্টে তিনি বিদেশে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়েও তিনি প্রতিবাদ বা বিদেশে জনমত তৈরি করার কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছেনÑ তা নয়। বরং আত্মগোপন করেছিলেন বলা যায়। সামরিক জান্তা শাসকদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে দেশে ফিরে আসেন, ’৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনের অনেক পরে। জান্তা শাসক জিয়ার মৃত্যুর পর তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বিএনপির ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন। নির্বাচনে তিনি বিপুল ব্যবধানে হেরেছিলেন। অবশ্য শাসকগোষ্ঠী সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা না করে ভোট ডাকাতি করেছিল। পরাজয়ের পর তিনি দেশের বাইরে চলে যান। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর ড. কামাল রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। সে সময় ড. কামাল তার চিন্তাধারায় দলকে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন। শেখ হাসিনার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৮৬ সালে জান্তা শাসকের অধীনে সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশ নিতে বাধ্য করেছিলেন তিনি। এজন্য শেখ হাসিনার সঙ্গে কঠোর আচরণও করেছিলেন। যা অভভ্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। সেই নির্বাচনে দু’টি আসনে দাঁড়িয়ে ড. কামাল হেরেছিলেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে হেরে যাবার পর তিনি দলীয় সভানেত্রীকে অভিযুক্ত করে দীর্ঘ পত্র লিখে দল ত্যাগ করেন। এরপর তিনি নিজে দল গঠন করেন। এক পর্যায়ে তিনি বামপন্থীদের সমর্থনে গঠিত জোটের আহ্বায়কও হন। এই বামেরা বঙ্গবন্ধুর সরকারের মন্ত্রী ড. কামালকে ‘সাম্রাজ্যবাদের দালাল’ বলতে কসুর করত না। সেই বামেরাও এক সময় তাকে ত্যাগ করেন। সর্বশেষ তিনি মাহমুদুর রহমান মান্নাকে নিয়ে নাগরিক ঐক্যও গঠন করে হালে পানি যোগাড় করতে পারেননি। ২০১৫ সালের জানুয়ারি-এপ্রিলে বেগম জিয়ার ডাকা হরতাল-অবরোধকালে দেশব্যাপী পেট্রোলবোমা মেরে যখন মানুষ হত্যা চলছিল, তখন তিনি তার প্রতিবাদ করেননি। এমনকি এসব থেকে নিবৃত্ত হওয়ার জন্য বেগম জিয়াকে অনুরোধও জানাননি। অথচ তিনি মান্নাকে নিয়ে বেগম জিয়ার সঙ্গে গুলশান কার্যালয়ে গিয়ে বৈঠক করেন। কিন্তু মানুষ হত্যা বন্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। সেই কামাল হোসেন আজ বলছেন, দেশে এখন সুস্থ ধারার রাজনীতি করার পরিবেশ নেই। কেন নেই; সে কথা তিনি কথার মার প্যাঁচে ফেলে দেন। রাজনীতির পরিবেশে কলঙ্কমুক্ত করার জন্য তার কোন উদ্যোগ কখনও দেখা যায়নি। ছাত্রলীগ নেতা হত্যায় জড়িতকে নিয়ে দল চালানো ড. কামাল সন্ত্রাসমুক্তির কথা কিভাবে বলেন, তা পরিষ্কার নয়। ড. কামাল জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, ধর্মান্ধতার বিষয়ে কোন বাক্য ব্যয় করেন না। তার সব বাক্যই ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে নির্গত হয়। বর্তমান সরকার মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এবং গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। তাই যদি হতো, তবে তিনি গত ৬ বছর ধরে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তাতে লাগাম টেনে ধরা হতো। কিন্তু তা হয়নি। দেশের বর্তমান অবস্থায় রাজনীতি করা ড. কামালের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে বলে নিজেই দাবি করেছেন কিন্তু তিনি রাজনীতি করছেন কোথায়? জনবিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল বক্তৃতাসর্বস্ব রাজনীতি চালিয়েছেন, যাতে ষড়যন্ত্রের নানা গন্ধও ছিল। তিনি জনগণকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলেন। কিন্তু সেই জনগণকে সংগঠিত করার ন্যূনতম প্রচেষ্টাও কখনও দেখা যায়নি। গত শুক্রবার প্রেসক্লাবে এক স্মরণ সভায় ড. কামাল যা বলেছেন, তা এক হতাশ রাজনীতিকের ভাষ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আবার এটাও বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে দেশে জনগণের ঐক্য আছে। এই ঐক্যকে ধরে এগিয়ে যাওয়ার স্বার্থে তিনি দলীয় পরিচয়ে থাকবেন না।’ স্বপ্নের ভেতর বসবাস করা ড. কামালের এই জনগণ কারা? বিএনপি-জামায়াত জোট সমর্থিত জনগণ, নাকি দু’বেলা দু’মুঠো নিয়মিত খেতে পাওয়া জনগণÑ তা পরিষ্কার নয়। বর্তমান সরকারকে ‘স্বৈররাজতন্ত্র’ অভিধায় ভূষিত করে এটাও বলেছেন, ফিলিপাইনের মার্কোস ও আশির দশকের স্বৈরাচারের মতো বিদায় নিতে হবে। ওনার এই অলীক ভাবনা বিস্মিত করে। কারণ বঙ্গবন্ধু কন্যা স্বৈরাচারীও নন, রাজতন্ত্রের ধারকও নন। জনগণের ভোটে নির্বাচিত তিনি। দেশে দলীয় রাজনীতিই মুখ্য হয়ে ওঠায় তিনি এই পথ পরিহার করেছেন বোঝা যায়। কতোটা ক্ষোভ থাকলে সরকারের প্রতি, তিনি বলতে পারেন, ‘আমি চাই না স্বপ্নের বাংলাদেশের কিছু গরু-ছাগল আর লুটেরার জন্য সর্বনাশ হোক।’ এটা এ দেশের সব জনগণেরই চাওয়া। কিন্তু এই সর্বনাশ ঠেকানোর মতো ব্যক্তিত্ব, সাংগঠনিক শক্তি কোন কিছুই নেই ড. কামালের স্বভাবে-গুণে, গরিমায়। পথহারা পাখির মতো তিনি দেশে-বিদেশে উড়ে বেড়াতে পারেন। কিন্তু জনগণের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষমতা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে।
×