ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সেনা কর্মকর্তাদের বয়ান

(১৭ জানুয়ারির পর) রাষ্ট্রপতি এতে খুবই বিরক্ত হয়ে তাকে পদত্যাগ করতে বলেন। সেটি জুলাই ১৯৭৫ সালের কথা। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধু প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন জিয়া থেকে পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার। প্রতিমন্ত্রী সে নির্দেশও পালন করেননি। জিয়াও স্বাভাবিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। নুরুল ইসলাম বরং জিয়াকে বলেছিলেন, পদত্যাগপত্র সেপ্টেম্বরে দিলেও চলবে। বঙ্গবন্ধুকেও সেভাবে বুঝিয়েছিলেন। শফিউল্লাহ তার সম্পর্কে লিখেছেন “... he betrayed the trust bestowed on him by Bangabandhu. ১৪ আগস্ট দুটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে। এক. দুপুরে বঙ্গবন্ধু যেখানে বক্তৃতা দেবেন সে জায়গায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। গুজব ছিল যে, ১৫ আগস্ট জাসদ ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে প্রতিবাদ মিছিল করবে। গুজব ছিল, রাষ্ট্রপতিকে হত্যার চেষ্টাও হতে পারে। অনুমান জাসদই এ কাণ্ড ঘটিয়েছিল। ওই সময় এ ধরনের ঘটনা মোকাবেলা করার জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষিত পুলিশ ছিল না। একই দিন দুপুরে ফেনীতে ভারতীয় একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। ফলে এসব ঘটনা মোকাবেলার দায়িত্ব বর্তায় সেনাবাহিনীর ওপর। শফিউল্লাহ কুমিল্লা গ্যারিসনের কমান্ডারকে নির্দেশ দেন ভারতীয় পাইলটদের মৃতদেহ উদ্ধারে। আর কর্নেল জামিলকে দায়িত্ব দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা সমন্বয় করার। জামিলের সঙ্গে রউফও এ কাজে যোগ দেন। এ সমস্ত কিছু পর্যালোচনা ও সমন্বয় করতে করতে বেশ রাত হয়ে যায়। শফিউল্লাহ বেশ রাতে ঘুমাতে যান। পরদিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট ভোর সোয়া পাঁচ বা সাড়ে পাঁচটার দিকে তার ব্যাটম্যান হাবিলদার হায়দার আলী তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। দরজা খুলে তিনি দেখেন মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন ইউনিফর্ম পরে স্টেনগান হাতে দাঁড়িয়ে। শেভ করেননি। শফিউল্লাহ জানতে চান, এ রকম পোশাক পরে আসার হেতু কী? সালাহউদ্দিন সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে জানতে চান, তিনি কি আর্মড ও আর্টিলারি ইউনিটকে শহরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন? শফিউল্লাহ জানালেন, তিনি এ ধরনের কোন নির্দেশ দেননি। সালাহউদ্দিন জানালেন, ওই দুটি ইউনিট শহরে মুভ করেছে এবং গণভবন, রেডিও স্টেশন প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দখল করেছে। শুধু তাই নয়, কয়েকটি ট্যাঙ্কও ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। ‘এ অবস্থায় আমার কী করার ছিল?’ শফিউল্লাহ প্রশ্ন করেছেন নিজেকে। দুটি পন্থা ছিল। এক. যা ঘটছে রাষ্ট্রপতিকে তা অবহিত করা এবং দুই. ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার যিনি ফোর্সের কমান্ডার তাকে নির্দেশ দেয়া যারা এগুলো করছে তাদের প্রতিহত করার। সালাহউদ্দিনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, শাফায়াত জামিল কি ঘটনা জানেন? সালাহউদ্দিন জবাব দিলেন, তা তিনি বলতে পারবেন না। কারণ খবর পেয়েই তিনি তার বাড়িতে ছুটে এসেছেন। তিনি সালাহউদ্দিনকে নির্দেশ দিলেন দ্রুত গিয়ে শাফায়াতকে যেন ১, ২ ও ৪ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টকে তাদের প্রতিহত করতে বলে। এ ধরনের ঘটনা প্রতিহত করার জন্য ঢাকায় ওই তিনটি রেজিমেন্টকে মোতায়েন করা হয়েছিল। এ নির্দেশ দিয়ে তিনি দ্রুত লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করলেন। রেড টেলিফোন এনগেজড। তখন সাধারণ টেলিফোনে ফোন করলেন। সেটিও এনগেজড। সময় বাঁচাবার জন্য স্ত্রীকে লাল টেলিফোনে রিং করে যেতে বললেন। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন অন্য টেলিফোনে শাফায়াতকে ধরার। তার টেলিফোনও এনগেজড। তখন তার বাড়ির এক্সচেঞ্জকে বললেন, যেভাবেই হোক শাফায়াতের সঙ্গে যোগাযোগ করার। অন্য টেলিফোনে তিনি অন্যান্য অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে লাগলেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি যোগাযোগ করতে পারলেন কর্নেল জামিলের সঙ্গে। জামিল জানালেন, রাষ্ট্রপতি তাকে টেলিফোন করে বলেছেন জলদি তার বাসায় যেতে। কারণ তিনি বিপদ আশঙ্কা করছেন। শফিউল্লাহ জানালেন, সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে তিনি ঘটনা জেনেছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন, পারছেন না। জামিল যেহেতু যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতির বাসায় তিনি যেন রাষ্ট্রপতিকে জানান শাফায়াতকে মুভ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সুতরাং সম্ভব হলে রাষ্ট্রপতিকে যেন বাসা থেকে নিরাপদ কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। জামিল জানালেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসায় পৌঁছে সে চেষ্টা করবেন। কর্নেল জামিলের সঙ্গে কথা শেষ করে আবার তিনি শাফায়াতকে ধরার চেষ্টা করলেন। তাকে পেলেন। শফিউল্লাহ লিখেছেন তার গলার স্বর অদ্ভুত বা ঘুম ঘুম লাগছিল, হয়তবা চিন্তা থেকে Shafaat’s voice was a bit funny, probably worrying voice or drowsy] কোন সময় নষ্ট না করে তিনি জানতে চাইলেন, ঘটনা যা ঘটছে শাফায়াত কি তা জানেন? শাফায়াত জানালেন, তিনি জানেন না। শফিউল্লাহ তাকে আবারও সেই নির্দেশ দিলেন এবং মনে হলো শাফায়াত তা বুঝেছেন। শাফায়াত পরে বলেছেন, তিনি কোন নির্দেশ পাননি। লিখেছেন শফিউল্লাহ, “তবে এটুকু স্বীকার করেছেন ওই দিন সকালে তিনি আমার ফোন পেয়েছিলেন। আমি তাকে সে নির্দেশ না দিলে অত সকালে কী কারণে ফোন করেছিলাম? তাকে কি নির্দেশ দেয়ার জন্য ফোন করিনি?” ঢাকা ব্রিগেডকে এই নির্দেশ দেয়ার পর বিমানবাহিনী প্রধান একে খন্দকার ও নৌপ্রধান এমএইচ খানকে ফোন করে ঘটনা জানান। তারাও কিছু জানেন না। তারপর জিয়াকে ফোন করেন। শফিউল্লাহ লিখেছেন, জিয়ার গলার স্বর শুনে মনে হলো সেও প্রথমবার খবর শুনেছে। জিয়া শুধু বললেন, ‘ইজ ইট সো!’ এরপর সিজিএস খালেদ মোশাররফকে ফোন করলেন। তিনিও মনে হলো, খবরটি শফিউল্লাহর কাছ থেকেই জানলেন। এরপর রউফের বাসায়, সেখানে কেউ ফোন ধরলেন না। শফিউল্লাহ যখন এদের সঙ্গে কথা বলছেন, তখন তার স্ত্রী প্রাণপণে লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে ধরার চেষ্টা করছেন। এবার শফিউল্লাহ চেষ্টা করতে লাগলেন। খুব সম্ভব ছয়টা বাজার কয়েক মিনিট আগে তিনি লাইন পেলেন। বঙ্গবন্ধুই ফোন ধরেছেন। শফিউল্লাহর গলা শুনে উত্তেজিত ও ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি এ্যাটাক করছেÑ কামালরে বোধহয় মাইরা ফেলছেÑ তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ শফিউল্লাহ লিখেছেন, “আমি শুধু বলতে পারলাম, ‘আমি কিছু করার চেষ্টা করছি, আপনি কি বাসা থেকে বেরুতে পারবেন?’ রাষ্ট্রপতি কোন জবাব দিলেন না। আমি হ্যালো হ্যালো বলতে লাগলাম। মনে হলো, তার সামনে কেউ আছে যে জন্য তিনি জবাব দিতে পারছেন না। আমার আরও মনে হলো, তিনি ফোনটি টেবিলে নামিয়ে রেখেছেন কারণ এর ৩০ কি ৪০ সেকেন্ড পর টেলিফোনে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলির শব্দ পেলাম। এরপর প্রায় এক মিনিটের মধ্যে টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।” শফিউল্লাহ ভেবেছেন কেন বঙ্গবন্ধু তাকে সরাসরি ফোন করলেন না। তিনি অন্যদের সঙ্গে নিশ্চয় যোগাযোগের চেষ্টা করছিলেন। কারণ তার টেলিফোন সব সময় ব্যস্ত ছিল। বা তিনি চেষ্টা করছিলেন কিন্তু শফিউল্লাহর ফোন ব্যস্ত ছিল। বা এমনও হতে পারে, তার বাসায় সৈন্যসামন্ত দেখে তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন শফিউল্লাহর ওপর। চলবে...
×