ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

২৮ জানুয়ারি ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক

পোশাক খাতে টেকসই কমপ্যাক্ট মূল্যায়নের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

পোশাক খাতে টেকসই কমপ্যাক্ট মূল্যায়নের উদ্যোগ

এম শাহজাহান ॥ রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পর এবার পোশাক খাতের সাসটেইনেবলিটি কমপ্যাক্ট মূল্যায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। বড় এই দুর্ঘটনার পর কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল পোশাক শিল্প খাত। সে সময় ২০১৩ সালে ক্রেতা জোটের পরামর্শে বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যান-২০১৩, সাসটেইনেবলিটি কমপ্যাক্ট এবং জাতীয় ত্রিপক্ষীয় কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়। বলা হয়েছিল, পরিকল্পনা তিনটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। একই সঙ্গে শ্রমিক যে কারখানায় কাজ করেন তার কর্মপরিবেশ হবে শতভাগ নিরাপদ। তিন বছর পর এবার সাসটেইনেবলিটি কমপ্যাক্ট মূল্যায়নে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। গত তিন বছরে দেশের পোশাক শিল্পের অগ্রগতি কতটুকু? যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যানের ১৬ শর্তের কতটুকু পূরণ করা হয়েছে? এসব বিষয় সামনে রেখে সাসটেইনেবলিটি কমপ্যাক্ট মূল্যায়ন করা হবে। এই মূল্যায়নের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ক্রেতা দেশগুলোর সব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে পোশাক খাত। জিএসপি পুনর্বহাল না হলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানি বেড়েছে। কেটে যাচ্ছে ইমেজ সঙ্কট। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অধিকার, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কর্মপরিবেশের উন্নতির ইস্যুগুলো অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেই সময় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সাস্টেইনেবলিটি কমপ্যাক্ট গঠন করে। এই কমপ্যাক্ট তৈরি পোশাক ও নিট খাতে শ্রমিক অধিকার ও কারখানা নিরাপত্তার উন্নয়নে কাজ করছে। যদিও আন্তর্জাতিক ক্রেতা জোট এ্যাকোর্ড এবং এ্যালায়েন্স কয়েকটি বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে পোশাক খাতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে আরও মনিটরিং প্রয়োজন বলেও বলে মনে করছে ক্রেতা জোট। ২৮ জানুয়ারি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কমপ্যাক্ট বাস্তবায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিষয়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। ওই বৈঠকে পোশাক শিল্পের জন্য এ পর্যন্ত গৃহীত সকল পদক্ষেপ এবং এর অগ্রগতি তুলে ধরা হবে। জানা গেছে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত তিন বছরে মারাত্মক ত্রুটি পাওয়া গেছে শতকরা ২ ভাগ গার্মেন্টস কারখানায়। যে কোন শিল্পের ২ শতাংশ কারখানায় ত্রুটি থাকা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। এই বাস্তবতায় দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির সক্ষমতায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, মালিক, শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে গত তিন বছরে পোশাক কারখানায় কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। কারখানাগুলোতে কর্মবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে, শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অগ্নিকা- প্রতিরোধে ফায়ার সেফটি ডোর আমদানি শুল্কমুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া সাসটেইনেবলিটি কমপ্যাক্ট সামনে রেখে শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ, ইপিজেড আইন সংশোধন, সাধারণের প্রবেশযোগ্য ডাটাবেজ স্থাপন, রফতানিমুখী গার্মেন্টস কারখানা যাচাই-বাছাই, ২৩৬ ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যানের ১৬ শর্ত পূরণ করা হয়েছে। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন জনকণ্ঠকে বলেন, সাসটেইনেবলিটি কমপ্যাক্টের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তারপরও ক্রেতা জোটগুলো এ নিয়ে তেমন সন্তুষ্ট নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া এ্যাকশন প্ল্যানের ১৬ শর্ত পূরণ হওয়ার পরও জিএসপি পুনর্বহালে বিলম্ব হচ্ছে। তিনি বলেন, ক্রেতা জোটের বিভিন্ন শর্ত পূরণ এ শিল্পের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হলেও তা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাচ্ছে গার্মেন্টস খাত। আর তাই এতসব প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও গার্মেন্টস পণ্যের রফতানি বেড়ে চলছে। আশা করছি, ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীই পোশাক শিল্পের রফতানি প্রবৃদ্ধি হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকার জিএসপি পুনর্বহাল না করলেও ওই দেশে রফতানি কিন্তু বেড়েছে। সরকার ও মালিকপক্ষের যৌথ প্রচেষ্টায় এ শিল্পের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। পোশাক শিল্প খাতের বড় সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত তিন বছরে দেশের গার্মেন্টস শিল্পে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি নজর দিচ্ছেন। এ কারণে দেশে এখন গ্রীন গার্মেন্টস গড়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, নিরাপদ কর্মপরিবশে তৈরির অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা। তাই আগামীতে দেশের এ শিল্পে শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি হবে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মতো আর যাতে কোন ট্র্যাজেডি না হয় সে লক্ষ্যে বিজিএমইএ থেকে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারী বিভিন্ন সংস্থাও এখন নিয়মিত তদারকি করছে। ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন নয় ॥ রফতানি প্রক্রিয়া অঞ্চলে (ইপিজেড) ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন দেয়া হবে না। এ বিষয়ে সরকার কঠোর সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। যদিও ক্রেতা জোটের পক্ষ থেকে ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেয়ার কথা বলা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী আরও বলেছেন, বাংলাদেশে ইপিজেডগুলোতে আর কোন ট্রেড ইউনিয়ন করা হবে না। ইপিজেডে ২১৭ কারখানায় ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন সিবিএ হিসেবে কাজ করছে। এজন্য আলাদা ট্রেড ইউনিয়নের প্রয়োজন নেই। তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর যে ইমেজ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল তা কেটে যাচ্ছে। শ্রম আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রধান রফতানি খাত ॥ তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রফতানি আয়ের প্রধান খাত। ২০২১ সালের মধ্যে ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির স্বপ্ন দেখা হচ্ছে এ শিল্পকে সামনে রেখে। এ খাতে ৪০ লাখের বেশি শ্রমিক সরাসরি কাজ করেন, যার শতকরা ৮০ ভাগ কম সুবিধাভোগী নারী। শুধু তাই নয়, তৈরি পোশাক খাতের কল্যাণে সহায়ক খাত হিসেবে দেশে ব্যাংক, বীমা, আইটি, পরিবহন, ট্যুরিজমসহ অন্যান্য খাত গড়ে উঠেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ শিল্পের ভবিষ্যত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তৈরি পোশাক রফতানিতে উদ্ভূত সমস্যাবলী নিরসন, নতুন বাজার অনুসন্ধান, পোশাক শিল্পে কমপ্লায়েন্স প্রতিপালনে নীতিগত সহায়তা, শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে কার্যক্রম গ্রহণ ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিতকরণ, তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার এবং জিএসপি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এ সেল কাজ করে থাকে। পোশাক কারখানায় অভিযান অব্যাহত ॥ রানা প্লাজা ধসের পর এ পর্যন্ত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর ১৪৭৫ তৈরি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেছে। রানা প্লাজা ধসে ১২শ’র বেশি শ্রমিকের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কারখানার নিরাপত্তা ও শ্রমিক অধিকারের বিষয়টিতে বহির্বিশ্বের নজরে পড়ে এবং রফতানিমুখী তৈরি পোশাক খাত পর্যবেক্ষণের আওতায় আসে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী পরিচিত ফ্যাশন চেন ইনডিটেক্স ও এইচএ্যান্ডএমসহ ১৮০টির বেশি ব্র্যান্ড ও বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ্যাকোর্ড গঠন করে, যারা ১৩৫৬ কারখানা পরিদর্শনের পর নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবে ছাড়পত্র না পাওয়ায় ২৬ কারখানা বন্ধ হয়। এছাড়া ওয়ালমার্ট ও গ্যাপসহ উত্তর আমেরিকার কোম্পানিগুলোর সমন্বয়ে বাংলাদেশের শ্রমিক নিরাপত্তা জোট তৈরি হয়, যারা ৮২৯ কারখানা পরিদর্শন করে।
×