ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পুলিশ ও অন্যান্য সংস্থার পাশাপাশি তদন্তে নেমেছে র‌্যাবও

আসামিদের চিনে ফেলায় দুই শিশুকেও হত্যা ॥ উদ্ঘাটিত হয়নি না’গঞ্জে এক পরিবারের পাঁচ খুন রহস্য

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬

আসামিদের চিনে ফেলায় দুই শিশুকেও হত্যা ॥ উদ্ঘাটিত হয়নি না’গঞ্জে এক পরিবারের পাঁচ খুন রহস্য

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ নারায়ণগঞ্জ শহরের বাবুরাইল এলাকায় মা, মেয়ে ও ছেলেসহ একই পরিবারের ৫ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা ঘটনার রহস্য এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে কয়েকটি বিষয় ধরে তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে পুলিশ জানায়। এ হতাকা-ের ঘটনায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। রবিবার দুপুরে নিহত তাসলিমা বেগমের স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে এ হত্যা মামলা দায়ের করেন। বিকেলে নিহত পাঁচজনের লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। এদিকে খুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ জানিয়েছেন, এক পরিবারের পাঁচজনকে হত্যার ঘটনাটি পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি র‌্যাবও ছায়া তদন্ত করছে। রবিবার সকালে ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই নম্বর বাবুরাইল এলাকায় পাঁচতলা ভবনের নিচতলার ওই ফ্ল্যাট পরিদর্শন করেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দু’জন শিশু, দু’জন মহিলা ও একজন পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাটি জেলা পুলিশ তদন্ত করছে। অন্যান্য সংস্থাও ঘটনার তদন্ত করছে, পাশাপাশি র‌্যাবও ছায়া তদন্ত করছে। আমরা আশা করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে যারা জড়িত, তাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে পারব। র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আরও বলেন, দুই শিশুকে খুন করা হয়েছে তারা যাতে এ ঘটনার সাক্ষী না হতে পারে। বিশেষ করে একটি বাড়িতে পাঁচজনকে খুন করাÑ আমাদের জন্য এটি একটি মারাত্মক ঘটনা। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। বিষয়টি পারিবারিক বা বিভিন্ন কারণেও ঘটে থাকতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, সব বিষয় মাথায় রেখেই তদন্ত চলছে। আসামিদের চিনে ফেলায় ॥ দুপুরে ঢাকা রেঞ্জের পুলিশের ডিআইজি এসএম মাহাফুজুল হক নুরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্ত করছি। বিভিন্ন সংস্থা আমাদের সঙ্গে তদন্ত কাজ করছে। আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। তিনি বলেন, সাক্ষী না রাখার জন্যই নাবালক দুটি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ধারণা করছেন, আসামিদের চিনে ফেলার কারণেই দুই শিশুকে হত্যা করা হতে পারে। ওই ফ্ল্যাটে খাবার টেবিলে ভাত, তরকারি ও হালুয়াসহ বিভিন্ন খাবার পাওয়া গেছে। হত্যাকা-ের আগে ওই খাবারের সঙ্গে কিছু মিশিয়ে তাদের খাওয়ানো হয়েছিল কিনা, তার নমুনাও সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তিন ঘণ্টার সুরতহাল ও সিআইডির তদন্ত ॥ মা, মেয়ে ও ছেলেসহ পাঁচ খুনের আলামত সংগ্রহ শেষে শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটায় নারায়ণগঞ্জ সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার এহসান উদ্দিন চৌধুরী বলেন, খুনীরা পেশাদার নয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাতের পর তাদের গলায় কাপড় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। তাদের আগে অচেতন করে এ হত্যাকা- ঘটানো হয়ে থাকতে পারে। আমাদের ফরেনসিক টিম সব আলামত সংগ্রহ করেছে। সেগুলো পরীক্ষার পর কখন, কিভাবে হত্যা করা হয়েছেÑ তা নিশ্চিত করে বলা যাবে। তবে হত্যার আগে ধর্ষণ এবং নিহতদের খাবারে বিষ কিংবা চেতনানাশক কিছু মেশানো হয়েছিল কিনাÑ সেসবও আমলে নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তদন্তে দুটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে জানিয়ে এর আগে নারায়ণগঞ্জের সহকারী পুলিশ সুপার ফোরকান আহমেদ জানান, মোরশেদুলের সঙ্গে কারও আর্থিক লেনদেন থাকতে পারে। অন্যটি হলো সেখানে ধর্ষণের কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা বা খাবারে বিষ দেয়া হয়েছে কিনা। কারণ ঘটনাস্থলে ধস্তাধস্তির কোন আলামত নেই, প্রতিবেশীরাও কোন চেঁচামেচি শোনেনি। সম্ভবত খাবারে চেতনানাশক কিছু মিশিয়ে সবাইকে অচেতন করে হত্যা করা হয়েছে। দুই শিশুসহ ৫ জনকে শ্বাসরোধে ও মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে ॥ নারায়ণগঞ্জ শহরের দুই নম্বর বাবুরাইল এলাকায় ফ্ল্যাট বাড়িতে দুই শিশুসহ ৫ জনকে শ্বাসরোধে ও মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। খুনীরা পেশাদার নয়। রবিবার বিকেল তিনটায় নিহত ৫ জনের ময়নাতদন্ত শেষ হয়েছে বলে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) মোঃ আসাদুজ্জামান জানান। তিনি জানান, আঘাতের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মাথায় ভোতা অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। খাবারে বিষক্রিয়ার বিষয়টি তদন্তের জন্য ভিসেরা রিপোর্টের জন্য পরীক্ষাগারে নমুনা পাঠানো হয়েছে। তবে ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি। গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে তিনি জানান। ৫ জনকে হত্যার ঘটনায় সদর থানায় মামলা দায়ের ॥ দুই শিশুসহ ৫ জনকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় নিহত তাসলিমা বেগমের স্বামী শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলায় বাদী শফিকুল ইসলাম উল্লেখ করেন, তিনি পেশায় প্রাইভেটকারচালক। তিনি সপ্তাহে একবার বাড়িতে আসেন এবং তার ভাই শরীফ ঢাকার মোতালেব প্লাজায় মোবাইল সার্ভিসিং কাজ করেন। ঘটনার সময় তারা দুই ভাই বাসায় ছিলেন না। তার বাসায় কে বা কারা তার স্ত্রী তাসলিমা, দুই সন্তান শান্ত ও সুমাইয়া, তার শ্যালক মোশারফ হোসেন মোরশেদ এবং ভাই শরীফের স্ত্রী লামিয়াকে হত্যার পর ঘরের দরজা তালা বন্ধ করে পালিয়ে যায়। খুনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি ॥ বাবুরাইলের বাসিন্দা তাসলিমা বেগম, তার ছেলে শান্ত ও সুমাইয়া, তাসলিমার ভাই মোরশেদুল ও তাসলিমার জা লামিয়া খুনের রহস্য একদিন অতিবাহিত হওয়ার পরও উদ্ঘাটিত হয়নি। তবে পুলিশ কয়েকটি বিষয় ধরে তদন্তকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন জানান, নগরীর বাবুরাইলে দুই শিশুসহ ৫ জন হত্যাকা-ের ঘটনা অপেশাদার খুনীরা ঘটিয়ে থাকতে পারে। হত্যাকা-ের মোটিভ দেখে আমাদের ধারণা খুনীরা পূর্বপরিচিত। প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। হত্যাকা-ের পেছনে ব্যক্তিগত সর্ম্পক বা দেনা-পাওনার বিষয় থাকতে পারে। আমরা আশা করছি আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এ হত্যাকা-ের রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারব। নিহতের স্বজনদের বক্তব্য ॥ নিহত তাসলিমার মা মোর্শেদা বেগম জানান, তাসলিমা এক মাস আগে ঢাকার কিছু লোকের হুমকির কারণেই নারায়ণগঞ্জে চলে আসে একেবারে। তাসলিমা প্রায় আট-দশজনের কাছ থেকে সুদে বেশ কিছু টাকা আনে। ওই টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তাদের বিভিন্নভাবে হুমকি দিত তারা। তিনি বলেন, ‘আমি এই লেনদেনের কথা জানতে পেরে গ্রামের দুটি জমি বিক্রি করে তাদের টাকা দেই। তবুও তারা কেন অগরে মারল বুঝতাছি না।’ মোর্শেদা বেগম আরও জানান, ‘মোর্শেদুল আমাকে কয়েক দিন আগে ফোন করে বলেছিলেন যেন তার নানির কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়ে দেই। এই টাকা দিয়ে সে ব্যবসা করবে। পরে ফিরিয়ে দিবে। কিন্তু আমি তখন বুঝতে পেরেছিলাম যে তাদের ঢাকা থেকে টাকার জন্য হুমকি দিচ্ছে, আর তাই জরুরী টাকার দরকার।’ তাসলিমার ননদ শহরের খানপুরের বাসিন্দা হাজেরা বেগম জানান, তাসলিমা ছেলেমেয়ে নিয়ে বাবুরাইল এলাকার ইসমাইল হোসেনের ছয়তলা বাড়ির নিচতলায় কয়েক মাস আগে ভাড়া নেন। তার ভাই ময়মনসিংহ থেকে এসে দরজা বন্ধ দেখতে পেয়ে সবাইকে খবর দেন। পরে তালা ভেঙ্গে পাঁচজনের গলাকাটা লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। তবে কখন এ হত্যাকা- ঘটেছে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। নিহত তাসলিমার খালাত ভাই দেলোয়ার জানান, ‘আমি শুনে এখানে এসেছি, এত নির্মম কিভাবে হয় মানুষ। বাচ্চাদেরও অনেক কষ্ট দিয়ে মারছে। জামাইরে ঢাকায় খবর দিছি অই শুইন্না অজ্ঞান হইয়া গেছে। অই সকালে আইলে বুঝতে পারমু আসলে কি অইছে।’ সাত খুনের পর এবার পাঁচ খুন ॥ নারায়ণগঞ্জে গত ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার লামাপাড়া এলাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম ও সিনিয়র আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুল ইসলামের বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করা হয়। ৩০ এপ্রিল নজরুলসহ ৬ জন ও ১ মে লিটনের লাশ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করা হয়। এবার সর্বশেষ শনিবার খুনের শিকার হলেন শহরের বাবুরাইলের ১৩১/১১ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা তাসলিমা বেগম, তার ছেলে শান্ত ও সুমাইয়া, তাসলিমার ভাই মোরশেদুল ও তাসলিমার জা লামিয়া। এ হত্যাকা-ের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জবাসী ক্ষুব্ধ হয়েছে। পাঁচ লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর ॥ সন্ধ্যায় নিহত তাসলিমা বেগম, তার ছেলে শান্ত ও সুমাইয়া, তাসলিমার ভাই মোরশেদুল ও তাসলিমার জা লামিয়ার লাশ নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। তাসলিমা বেগম, তার ছেলে শান্ত, মেয়ে সুমাইয়া, তাসলিমার ভাই মোরশেদুলের লাশ গ্রহণ করেন নিহত তাসলিমার স্বামী শফিকুল ইসলাম। তাদের চারজনের লাশ নারায়ণগঞ্জ শহরের পাইপপাড়া করবস্থানে দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে লামিয়ার লাশ গ্রহণ করেন লামিয়ার স্বামী শরিফ।
×